নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
বিভিন্ন এলাকায় প্রেরিত সেনাদল (إرسال السرايا لكسر الأصنام)

৭৩. সারিইয়া খালেদ বিন অলীদ (‘উযযা’ মূর্তি ধ্বংস;(سرية خالد لكسر العزى : মক্কা বিজয়ের এক সপ্তাহ পরে ২৫শে রামাযান তারিখে খালেদ বিন অলীদের নেতৃত্বে ৩০ জনের একটি অশ্বারোহী দল মক্কা থেকে উত্তর-পূর্বে ত্বায়েফের পথে ৪০ কি. মি. দূরে নাখলায় প্রেরিত হয় ‘উযযা’ (الْعُزَّى) মূর্তি ধ্বংস করার জন্য। এই মূর্তিটি ছিল কুরায়েশ ও বনু কেনানাহ গোত্রের পূজিত সবচেয়ে বড় মূর্তি। খালেদ বিন অলীদ (রাঃ) মূর্তিটি ভেঙ্গে দিয়ে চলে এলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,هَلْ رَأَيْتَ شَيْئًا؟ ‘কিছু দেখেছ কি’? বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে তুমি ভাঙ্গোনি। আবার যাও ওটা ভেঙ্গে এসো’। এবার খালেদ উত্তেজিত হয়ে কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে ছুটলেন এবং সেখানে যেতেই এক কৃষ্ণাঙ্গ ও বিস্রস্ত চুল বিশিষ্ট নগ্ন মহিলাকে তাদের দিকে বেরিয়ে আসতে দেখেন। তাকে দেখে মন্দির প্রহরী চিৎকার দিয়ে উঠলো। কিন্তু খালেদ তাকে এক কোপে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে ফিরে এসে রিপোর্ট করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,نَعَمْ تِلْكَ الْعُزَّى وَقَدْ أَيِسَتْ أَنْ تُعْبَدَ فِي بِلاَدِكُمْ أَبَدًا ‘হ্যাঁ এটাই ‘উযযা। তোমাদের দেশে পূজা পাওয়ার ব্যাপারে সে এখন চিরকালের জন্য নিরাশ হয়ে গেল’।[1]إِنْ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ إِلاَّ إِنَاثًا ‘মূর্তিপূজারীরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নারীদের আহবান করে’ (নিসা ৪/১১৭)-এর ব্যাখ্যায় উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন,مَعَ كُلِّ صَنَمٍ جِنِّيَّةٌ ‘প্রত্যেক মূর্তির সাথে একজন করে নারী জিন থাকে’ (আহমাদ হা/২১২৬৯, সনদ হাসান)। এরা মানুষকে অলক্ষ্যে থেকে প্রলুব্ধ করে এবং দলে দলে লোকেরা বিভিন্ন মূর্তি, প্রতিকৃতি, বেদী, মিনার ও কবরে গিয়ে অযথা শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং মিথ্যা আশায় প্রার্থনা করে। যে বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ হ’তে কোনরূপ দলীল অবতীর্ণ হয়নি।[2]

৭৪. সারিইয়া আমর ইবনুল ‘আছ (‘সুওয়া‘ মূর্তি ধ্বংস;(سرية عمرو لكسر سواع : আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে একদল সৈন্যসহ রামাযান মাসেই পাঠানো হয় হুযায়েল(بنو هُذَيل) গোত্রের পূজিত সুওয়া‘ (سُوَاع) নামক বড় মূর্তিটি চূর্ণ করার জন্য। যা ছিল মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২৫ কি. মি. দূরে রিহাত্ব (رِهَاط) অঞ্চলে। আমর সেখানে পৌঁছলে মন্দির প্রহরী বলল, কি চাও তোমরা? আমর বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটাকে ভাঙ্গার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন’। সে বলল, তোমরা সক্ষম হবে না’। আমর বললেন, কেন? সে বলল, তোমরা (প্রাকৃতিকভাবে) বাধাপ্রাপ্ত হবে’। আমর বললেন,حَتَّى الآن أَنْتَ عَلَى الْبَاطِلِ؟ فَهَلْ يَسْمَعُ أَوْ يَبْصِرُ؟ ‘তুমি এখনো বাতিলের উপরে রয়েছ? সে কি শুনতে পায়, না দেখতে পায়?’ বলেই তিনি ওটাকে গুঁড়িয়ে দিলেন। অতঃপর প্রহরীকে বললেন, এবার তোমার মত কি? সে বলে উঠলো, أَسْلَمْتُ للهِ ‘আমি আল্লাহর জন্য ইসলাম কবুল করলাম’।[3]

৭৫. সারিইয়া সা‘দ বিন যায়েদ আশহালী (‘মানাত’ মূর্তি ধ্বংস; (سرية سعد لكسر مناة : একই মাসের মধ্যে ২০ জন অশ্বারোহী সহ সা‘দ বিন যায়েদ আশহালীকে পাঠানো হয় আরেকটি প্রসিদ্ধ মূর্তি মানাত (مَنَاة)-কে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য। যা ছিল মক্কা থেকে উত্তর-পূর্বে ১৫০ কি. মি. দূরে কুদাইদ(قُدَيْد) এর নিকটবর্তী মুশাল্লাল(مُشَلَّل) নামক স্থানে অবস্থিত এবং যা ছিল আউস, খাযরাজ, গাসসান ও অন্যান্য গোত্রের পূজিত দেবমূর্তি। সা‘দ মূর্তিটির দিকে অগ্রসর হ’তেই একটি নগ্ন, কৃষ্ণাঙ্গ ও বিক্ষিপ্ত চুল বিশিষ্ট নারীকে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে আসতে দেখেন। এই সময় সে কেবল হায় হায়(تَدْعُو بِالْوَيْلِ) করছিল। সা‘দ তাকে এক আঘাতে খতম করে দিলেন। অতঃপর মূর্তি ও ভান্ডার গৃহ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৫)

৭৬. সারিইয়া খালেদ বিন অলীদ (বনু জুযায়মাহ গোত্রের প্রতি;(سرية خالد إلى بنى جذيمة) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে খালেদ বিন অলীদের নেতৃত্বে মুহাজির, আনছার ও বনু সুলায়েম গোত্রের সমন্বয়ে ৩৫০ জনের একটি দলকে বনু জুযায়মাহ(بَنُو جُذَيْمَة) গোত্রে পাঠানো হয় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য, লড়াই করার জন্য নয়। বনু জুযায়মা মক্কা থেকে দক্ষিণে জেদ্দার নিকটবর্তী ইয়ালামলামের কাছে ৮০ কি. মি. দূরে অবস্থিত (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৯২-৯৩)। কিন্তু যখন তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হ’ল, তখন তারা أَسْلَمْنَا ‘আমরা ইসলাম কবুল করলাম’ না বলেصَبَأْنَا صَبَأْنَا ‘আমরা ধর্মত্যাগী হয়েছি’ ‘ধর্মত্যাগী হয়েছি’ বলল। এতে খালেদ তাদেরকে হত্যা করতে থাকেন ও বন্দী করতে থাকেন এবং পরে প্রত্যেকের নিকটে ধৃত ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বনু সুলায়েম ব্যতীত মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ কেউ এই নির্দেশ মান্য করেননি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) ও তাঁর সাথীগণ ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সব ঘটনা খুলে বললে তিনি খুবই ব্যথিত হন এবং আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দু’বার বলেন,اللَّهُمَّ إِنٍّيْ أَبْرَأُ إِلَيْكَ مِمَّا صَنَعَ خَالِدٌ ‘হে আল্লাহ! খালেদ যা করেছে আমি তা থেকে তোমার নিকটে নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করছি’।[4]

পরে আলী (রাঃ)-কে পাঠিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিহত ব্যক্তিদের রক্তমূল্য এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণ দান করেন।[5] উল্লেখ্য যে, খালেদ বিন অলীদ ও আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে এবং বনু সুলায়েম মুতা যুদ্ধের পর ৮ম হিজরীর শেষার্ধ্বে ইসলাম কবুল করেন। সে হিসাবে এঁরা সবাই ছিলেন প্রথম দিকের ছাহাবীগণের তুলনায় নূতন মুসলমান।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৫; নাসাঈ কুবরা হা/১১৫৪৭; ত্বাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ২/১৪৫-৪৬।

[2]. মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৯০২ সনদ ছহীহ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৪-৬৫।

[3]. তারীখ ত্বাবারী ৩/৬৬; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৫; ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ২/১৪৬।

[4]. বুখারী হা/৪৩৩৯; ঐ, মিশকাত হা/৩৯৭৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায়-১৯, ‘বন্দীদের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-৫।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খালেদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, مَهْلاً يَا خَالِدُ، دَعْ عَنْكَ أَصْحَابِى، فَوَ اللهِ لَوْ كَانَ لَكَ أُحُدٌ ذَهَبًا ثُمَّ أَنْفَقْتُهُ فِي سَبِيلِ اللهِ مَا أَدْرَكَتْ غَدْوَةَ رَجُلٍ مِنْ أَصْحَابِي وَلاَ رَوْحَتَهُ ‘থেমে যাও খালেদ! আমার ছাহাবীগণ থেকে বিরত হও। আল্লাহর কসম! যদি তোমার জন্য ওহোদ পাহাড় সোনা হয়ে যায়। আর তা সবটাই তুমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তথাপি আমার একজন ছাহাবীর একটি সকাল বা একটি সন্ধ্যার (নেকীর) সমপর্যায়ে তুমি পৌঁছতে পারবে না’ (আর-রাহীক্ব ৪১০-১১ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৬; আল-বিদায়াহ ৪/৩১৪; ইবনু হিশাম ২/৪৩১, সনদ মু‘যাল বা যঈফ; (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭২০)। এ বিষয়ে ছহীহ হাদীছ হ’ল, لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ ‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালি দিয়োনা। যদি তোমাদের কেউ ওহোদ পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তথাপি সে তাদের একজনের সিকি ছা‘ বা তার অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না’ (বুখারী হা/৩৬৭৩; মুসলিম হা/২৫৪০-৪১; মিশকাত হা/৫৯৯৮)।

[5]. মানছূরপুরী তাঁর প্রদত্ত যুদ্ধ তালিকার ৭৩ ক্রমিকে কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এখানে নিহতের সংখ্যা ৯৫ লিখেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২০০)।