নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
মক্কা বিজয় (غزوة فةح مكة) (৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান সোমবার মোতাবেক ৮ই জানুয়ারী ৬৩০ খৃ.)

৮ম হিজরীর ৭ই রামাযান[1] মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর শুক্রবার ১০,০০০ ছাহাবী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা হ’তে রওয়ানা হন এবং ১৭ই রামাযান মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারী সোমবার এক প্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়।[2] মুসলিম পক্ষে দলছুট ২ জন শহীদ ও কাফের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আবু রুহুম কুলছূম(أبو رُهْمٍ كُلثومُ بنُ حُصَينِ) বিন হোছায়েন আল-গেফারী।[3] এটি ছিল একটি সিদ্ধান্তকারী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর রাসূল (ছাঃ)-এর সত্যতার ব্যাপারে সমগ্র আরব বিশ্বে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। কেননা ইতিপূর্বে কা‘বাগৃহের উপর কর্তৃত্বের কারণে মানুষ কুরায়েশ নেতাদের প্রতি একটা অন্ধ আবেগ ও আনুগত্য পোষণ করত। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-

জন্মভূমি মক্কা হ’তে হিজরত করার ৭ বছর ৩ মাস ২৭ দিন পর বিজয়ীর বেশে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, নবীকুল শিরোমণি শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। বিনা যুদ্ধেই মক্কার নেতারা তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণ করলেন। এতদিন যারা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের মূল। বিজয়ী রাসূল (ছাঃ) তাদের কারু প্রতি কোনরূপ প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপরে কোনরূপ অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’। কিন্তু কি ছিল এর কারণ? কিভাবে ঘটলো হঠাৎ করে এ ঐতিহাসিক বিজয়? দু’বছর আগেও যে মুসলিম বাহিনীতে তিন হাযার লোক সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য ছিল, তারা কোথা থেকে কিভাবে দশ হাযার লোক নিয়ে ঝড়ের বেগে হঠাৎ ধূমকেতুর মত আবির্ভূত হ’ল মক্কার উপরে? অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল মক্কার নেতারা ফ্যালফ্যাল করে। টুঁ শব্দটি করার সাহস কারু হ’ল না? নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল মক্কা-মদীনার সংঘাত। পৌত্তলিক মক্কা দু’দিনের মধ্যেই হয়ে গেল তাওহীদবাদী মুসলমান। কা‘বাগৃহ হ’ল মূর্তিশূন্য। ‘উয্যার বদলে শুরু হ’ল আল্লাহর জয়গান। শিরকী সমাজ পরিবর্তিত হ’ল ইসলামী সমাজে। সমস্ত আরব উপদ্বীপে বয়ে চলল শান্তির সুবাতাস। কি সে কারণ? কিভাবে সম্ভব হ’ল এই অসম্ভব কান্ড? এক্ষণে আমরা সে বিষয়ে আলোকপাত করব।-

[1]. ইমাম যুহরী (৫০-১২৪হিঃ) বলেন, মক্কা বিজয়ের সফরে রাসূল (ছাঃ) রাস্তায় ১২ দিন(أَقَامَ فِي الطَّرِيقِ اثْنَيْ عَشَرَ يَوْمًا) অতিবাহিত করেন’ (ফাৎহুল বারী, ‘রামাযানে মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; হা/৪২৭৫-এর আলোচনা)। সে হিসাবে মদীনা থেকে রওয়ানার তারিখ ৭ই রামাযান হয়। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

[2]. আর-রাহীক্ব ৪০১ পৃঃ; মানছূরপুরী ২০শে রামাযান বৃহস্পতিবার বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১১৮, ২/৩৬৮)। মক্কা বিজয়ের তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে সেটা যে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে হয়েছিল তাতে কোন মতভেদ নেই (ফাৎহুল বারী হা/৪২৭৫-এর আলোচনা)।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে মক্কায় ১৯ দিন ছিলাম এবং ছালাতে ক্বছর করেছিলাম’। ইবনু হাজার বলেন, উক্ত সফর ছিল মক্কা বিজয়ের সফর (বুখারী হা/৪২৯৬-এর পরে ‘মক্কা বিজয়কালে রাসূল (ছাঃ) কত দিন সেখানে অবস্থান করেন’ অনুচ্ছেদ)। জীবনীকারগণের মতে রাসূল (ছাঃ) ৬ই শাওয়াল শনিবার হোনায়েন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন (ওয়াক্বেদী ৩/৮৮৯; ফাৎহুল বারী হা/৪৩১৩-এর পরে সূরা তওবা ২৫ আয়াতের তাফসীর অনুচ্ছেদ)। এক্ষণে মক্কায় ১৯ দিন অবস্থানকাল ঠিক রাখতে গেলে রাসূল (ছাঃ)-এর মক্কা বিজয়ের তারিখ হয় ১৭ই রামাযান সোমবার।

১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২/১৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত শেষ রাতে মক্কা থেকে হিজরত শুরু হয় (আর-রাহীক্ব ১৬৪ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৩৬৭)। অতঃপর ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারী সোমবার মক্কা বিজয় পর্যন্ত মোট সময়কাল হয়, ৭ বছর ৩ মাস ২৭ দিন। যদিও ইমাম বুখারী গড় হিসাবে বলেছেন সাড়ে ৮ বছর এবং ইবনু হাজার বলেছেন সাড়ে ৭ বছর (ফাৎহুল বারী হা/৪২৭৬-এর আলোচনা)। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

[3]. ইবনু হিশাম ২/৩৯৯; আর-রাউযুল উনুফ ৪/১৫৩।