রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পুরা জীবনটাই ছিল দাওয়াত ও জিহাদের জীবন। দাওয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের প্রয়োজন হয়। মাক্কী জীবন ছিল এককভাবে দাওয়াতী জীবন। মাদানী জীবনে সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি পেলেও তার মধ্যে তিনি সবসময় দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়েছেন। বিভিন্ন গোত্রে দাওয়াতী কাফেলা পাঠিয়েছেন। কখনো সফল হয়েছেন, কখনো বিফল হয়েছেন। ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে আযাল ও ক্বারাহ গোত্রে ‘আছেম বিন ছাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১০ জনের এবং একই সময়ে নাজদের বনু সুলায়েম গোত্রে মুনযির বিন ‘আমের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৭০ জনের যে তাবলীগী কাফেলা পাঠান, তারা সবাই আমন্ত্রণকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হয়ে যান। শেষোক্তটি বি’রে মাঊনার ঘটনা হিসাবে পরিচিত (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ২৪ ও ২৫)। আবার ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে সিরিয়ার দূমাতুল জান্দালের বনু কালব খ্রিষ্টান গোত্রের নিকটে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে যে তাবলীগী কাফেলা পাঠানো হয়, তা সফল হয় এবং খ্রিষ্টান গোত্রনেতাসহ সবাই মুসলমান হয়ে যান (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ৪৪)। এছাড়া নবী ও ছাহাবীগণ সকলে ব্যক্তিগতভাবে সর্বদা দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করতেন। কেননা দাওয়াতই হ’ল ইসলামের রূহ। মাদানী জীবনে মুশরিক-মুনাফিক ও ইহূদীদের অবিরতভাবে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধবাদী কর্মকান্ডের ফলে ইসলামের সুস্থ দাওয়াত বাধাগ্রস্ত হয় এবং যুদ্ধসমূহ সংঘটিত হয়।
৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে প্রধান প্রতিপক্ষ কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরের ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের জীবনে অনেকটা স্বস্তি ফিরে আসে। ফলে এ সময়টাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইসলামের দাওয়াত প্রসারের জন্য একটি মহতী সুযোগ হিসাবে কাজে লাগান। এই সময় তৎকালীন আরব ও পার্শ্ববর্তী রাজা-বাদশা ও গোত্রনেতাদের নিকটে পত্র প্রেরণের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রসারে তিনি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। পত্র বাহকের হাতে পত্রসমূহ প্রেরিত হয় এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী পত্রের শেষে সীলমোহর ব্যবহার করা হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর আংটিতে মুদ্রিত সীলমোহরটি ছিল রৌপ্য নির্মিত এবং যাতে ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ (محمد رسول الله) খোদিত ছিল।[1] এতে তিনটি লাইন ছিল। মুহাম্মাদ এক লাইন, রাসূল এক লাইন এবং আল্লাহ এক লাইন’।[2]
ওয়াক্বেদী, ত্বাবারী প্রমুখ জীবনীকারগণের হিসাব মতে হোদায়বিয়া থেকে ফিরেই ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরবের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্রসমূহ প্রেরণ করেন। ইবনু সা‘দ ও ইবনুল ক্বাইয়িমের মতে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসের একই তারিখে ছয় জন পত্র বাহককে পত্রসহ প্রেরণ করা হয়।[3] উভয় তারিখের মধ্যে সমন্বয় করে ইবনু হাজার বলেন, কোন কোন পত্র যিলহাজ্জের শেষ দিকে পাঠানো হয়েছে, যা ৭ম হিজরীর মুহাররমে প্রাপকের নিকট পৌঁছেছে। যেমন হেরাক্লিয়াসের নিকটে প্রেরিত চিঠি (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৫)। এতদ্ব্যতীত যাকে যেখানে পাঠানো হয়েছিল, তাদের প্রত্যেকে সেখানকার ভাষায় কথা বলতে পারতেন’ (ইবনু সা‘দ ১/১৯৮)।
উল্লেখ্য যে, হেরাক্বলের নিকট লিখিত একটি মাত্র চিঠি ব্যতীত অন্য কোন পত্র সনদে ও মতনে হুবহু ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে পত্রসমূহ যে পাঠানো হয়েছিল, তা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আনাস (রাঃ) বলেন, كَتَبَ إِلَى كِسْرَى وَإِلَى قَيْصَرَ وَإِلَى النَّجَاشِىِّ وَإِلَى كُلِّ جَبَّارٍ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ تَعَالَى وَلَيْسَ بِالنَّجَاشِىِّ الَّذِى صَلَّى عَلَيْهِ النَّبِىُّ– صلى الله عليه وسلم ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পত্র লেখেন কিসরা, ক্বায়ছার, নাজাশী এবং অন্যান্য সকল সম্রাটের নিকটে। তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করেন। তবে ঐ নাজাশী নন, যার মৃত্যুর পরে রাসূল (ছাঃ) তার গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন (কারণ তিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন)’ (মুসলিম হা/১৭৭৪)। অন্য বর্ণনায় দূমাতুল জান্দাল-এর খ্রিষ্টান শাসক উকায়দির-এর নিকটে পত্র লেখার বিষয়টি প্রমাণিত হয়’ (আহমাদ হা/১২৩৭৮, হাদীছ ছহীহ)।
তবে হুবহু প্রমাণিত না হ’লেও হেরাক্বলের নিকট প্রেরিত পত্রের নমুনায় অন্যান্য পত্রগুলি লিখিত হওয়ায় তা ঐতিহাসিকভাবে মূল্যায়নযোগ্য। যদিও তা আক্বীদা ও শরী‘আত বিষয়ে দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৯)।
হেরাক্বলের চিঠির শেষে সূরা আলে ইমরানের ৬৪ আয়াতটি উল্লেখিত থাকায় বিদ্বানগণ সন্দেহে পতিত হয়েছেন। কেননা তাঁদের ধারণায় উক্ত আয়াত ৯ম হিজরীতে নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলের মদীনায় আগমনের সময় নাযিল হয়। ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[4] বরং তাফসীরে ত্বাবারীর বর্ণনা (হা/৭১৯১), যার সনদ ক্বাতাদাহ (৬১-১১৮ হিঃ) পর্যন্ত ‘হাসান’ হিসাবে প্রমাণিত। সেখানে বলা হয়েছে যে, উক্ত আয়াত মদীনার ইহূদীদের বহিষ্কারের পূর্বে নাযিল হয়েছে। আর ইহূদীদের বহিষ্কার চূড়ান্ত হয় ৫ম হিজরীর শেষে খন্দক যুদ্ধের পর। আর হেরাক্বলের নিকট পত্র প্রেরিত হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষে হোদায়বিয়া সন্ধির পর (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৬-৫৭)। অতএব পত্রে উক্ত আয়াত লেখায় কোন সমস্যা নেই।
উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক চিঠি ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে যেমন আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা হয়েছে, তেমনি বাদশাহদেরকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদবী উল্লেখ করার মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে। সাথে সাথে তাদেরকে ইসলামের প্রতি ও পরকালীন পুরস্কার লাভের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
এক্ষণে যে সকল সম্রাট ও শাসকের নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল, সেই ৬ জন বিখ্যাত পত্রবাহক ও শাসকগণ হ’লেন, দেহিইয়া বিন খলীফা কালবীকে রোম সম্রাট ক্বায়ছারের নিকটে, আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমীকে পারস্য সম্রাট কিসরা-র নিকটে, হাত্বেব বিন আবু বালতা‘আহ লাখমীকে মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস-এর নিকটে, সালীত্ব বিন ‘আমর আল-‘আমেরীকে ইয়ামামার শাসক হাওযাহ বিন ‘আলী হানাফীর নিকটে, শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদীকে বালক্বা (দামেশক্ব)-এর শাসক হারেছ বিন আবু শিমর আল-গাসসানীর নিকটে এবং বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র নিকটে (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৪; যাদুল মা‘আদ ১/১১৬, ১১৯)।
এতদ্ব্যতীত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাসূল (ছাঃ) আরও কয়েকজন পত্র বাহককে বিভিন্ন শাসকের নিকট প্রেরণ করেন’ (যাদুল মা‘আদ ১/১১৯-২০)। নিম্নে পত্রগুলি উল্লেখ করা হ’ল।-
রাবী আনাস ও ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে উক্ত আংটি হযরত আবুবকর, পরে ওমর এবং তার পরে ওছমান (রাঃ) ব্যবহার করেন। কিন্তু তাঁর খেলাফতের শেষ দিকে এক সময় আংটিটি ‘আরীস’ (بِئْرُ أَرِيسَ) কূয়ায় পড়ে যায়’ (বুখারী হা/৫৮৬৬, ৫৮৭৩)। ইবনু হাজার বলেন, ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের ৬ বছর পর একদিন তাঁর হাত থেকে আংটিটি ‘আরীস’ কূয়ায় পড়ে যায়। যা তিনদিন ধরে খুঁজে এমনকি কূয়ার পানি সব সেঁচে ফেলেও আর পাওয়া যায়নি। অনেকে এই ঘটনায় বরকত বঞ্চিত হওয়ার কথা বলেছেন। কেননা এরপর থেকে ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের বাকী অর্ধাংশ বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে কাটে। যেমন আংটি হারানোর ফলে সোলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব চলে গিয়েছিল’ (ফাৎহুল বারী হা/৫৮৭৮-এর আলোচনা দ্রঃ)।
[2]. বুখারী হা/৩১০৬, ৫৮৭৮; মিশকাত হা/৪৩৮৬।
ইবনু হাজার বলেন, উক্ত বিষয়ে হাদীছসমূহে স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, লেখার নকশা ছিল, নীচে মুহাম্মাদ, তার উপরে রাসূল এবং তার উপরে আল্লাহ’ (ফাৎহুল বারী হা/৫৮৭৮-এর আলোচনা; সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/২৮১)।
[3]. ইবনু সা‘দ ১/১৯৮; যাদুল মা‘আদ ১/১১৬, ১১৯।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৫৫৩, ৫৭৬; ঐ, তাহকীক ক্রমিক ৬৩৩, সনদ যঈফ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ৬৪ আয়াত।