১০. সারিইয়া ওমায়ের বিন ‘আদী আল-খিত্বমী (سرية عمير بن عدي الخطمي) : ২য় হিজরীর ২৫শে রামাযান। একাকী স্বীয় সম্পর্কিত বোন ‘আছমা (عَصْمَاء) বিনতে মারোয়ান খিত্বমিয়াকে হত্যা করেন। কেননা মহিলাটি সর্বদা তার গোত্রকে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচনা দিত। সে ইসলাম ও ইসলামের নবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলত। ওমায়ের ছিলেন তার গোত্রের প্রধান এবং সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী। তার পিতা ‘আদী বিন খারশাহ ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কবি। ওমায়ের অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাত্রির অন্ধকারে একাকী ঐ মহিলার বাড়ীতে গিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এক আঘাতে শেষ করে দেন। ফিরে এসে ফজরের ছালাত শেষে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে উক্ত খবর দেন। তিনি তার জন্য দো‘আ করেন ও ‘আল-বাছীর’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকে ওমায়ের ‘আয-যারীর’-এর বদলে ‘আল-বাছীর’ নামে প্রসিদ্ধ হন। আয-যারীর (الضرير) অর্থ অন্ধ এবং আল-বাছীর (البصير) অর্থ দৃষ্টি সম্পন্ন।[1]
১১. সারিইয়া সালেম বিন ওমায়ের আনছারী (سرية سالم بن عمير) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাস। তিনি একাকী ১২০ বছরের বৃদ্ধ ইহূদী কবি আবু ‘আফাক(أبو عَفَك)-কে হত্যা করেন। কারণ সে সর্বদা ইহূদীদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কবিতার মাধ্যমে যুদ্ধের উস্কানী দিত। সালেম বিন ওমায়ের (রাঃ) তাকে হত্যা করার মানত করেন। তিনি বদর, ওহোদ ও খন্দকসহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে শরীক ছিলেন। এছাড়া তাবূক যুদ্ধে যানবাহনের অভাবে যেতে না পারায় ‘ক্রন্দনকারীদের’ (وَهُوَ أحدُ الْبَكَّاءِين) অন্যতম ছিলেন। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন।[2]
১২. গাযওয়া বনু সুলায়েম(غزوة بني سليم) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাস। বদর যুদ্ধ হ’তে প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাতদিন পরে এটি সংঘটিত হয়। বনু গাত্বফান গোত্রের শাখা বনু সুলায়েম মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে জানতে পেরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং ২০০ উষ্ট্রারোহীকে নিয়ে মক্কা ও সিরিয়ার বাণিজ্যপথে ‘কুদ্র’ (الْكُدْرُ) নামক ঝর্ণাধারার নিকটে পৌঁছে তাদের উপরে আকস্মিক হামলা চালান। তারা হতবুদ্ধি হয়ে ৫০০ উট রেখে পালিয়ে যায়। ইয়াসার (يسار) নামে একটি গোলাম আটক হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে মুক্ত করে দেন। অতঃপর তিনি সেখানে তিনদিন অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসেন। এই সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন সিবা‘ বিন উরফুত্বাহ আল-গিফারী অথবা আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।[3]
১৩. সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী(سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে আগ্রাসী বনু সুলায়েম বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে তিন দিন অবস্থান শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন। পরে শত্রুরা পুনরায় সংগঠিত হয়েছিল। তখন তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়। যাতে শত্রুপক্ষের কয়েকজন এবং মুসলিম পক্ষের তিন জন মারা যায়।[4]
১৪. গাযওয়া বনু ক্বায়নুক্বা(غزوة بني قينقاع) : ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবার থেকে ১৫ দিন অবরোধ করে রাখার পর এই বিশ্বাসঘাতক ও সমৃদ্ধিশালী ইহূদী গোত্রটি ১লা যিলক্বা‘দ আত্মসমর্পণ করে। এরা ছিল খাযরাজ গোত্রের মিত্র। ফলে মাত্র একমাস পূর্বে ইসলাম কবুলকারী খাযরাজ গোত্রভুক্ত মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের একান্ত অনুরোধে ও পীড়াপীড়িতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে ৭০০ জন ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা এবং মদীনার সেরা ইহূদী বীর। এরা সবকিছু ফেলে সিরিয়ার দিকে চলে যায় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যুবরণ করে। মানছূরপুরী বলেন, তারা খায়বরে যেয়ে বসতি স্থাপন করে।[5]
১৫. গাযওয়া সাভীক্ব(غزوة سويق) : ২য় হিজরীর ৫ই যিলহাজ্জ রবিবার। বদর যুদ্ধে লজ্জাকর পরাজয়ে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান শপথ করেছিলেন যে, মুহাম্মাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত তার মস্তক নাপাকীর গোসলের পানি স্পর্শ করবে না। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য তিনি ২০০ উষ্ট্রারোহী নিয়ে রাতের বেলায় গোপনে মদীনায় এসে ইহূদী গোত্র বনু নাযীর নেতা ও তাদের কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের সঙ্গে শলা পরামর্শ শেষে রাতেই মক্কায় রওয়ানা হয়ে যান। কিন্তু যাওয়ার আগে একটি দল পাঠিয়ে দেন। যারা মদীনার উপকণ্ঠে ‘উরাইয’ (العُرَيض) নামক স্থানে একটি খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দেয় এবং সেখানে দায়িত্বরত একজন আনছার ও তার এক মিত্রকে হত্যা করে ফিরে যায়।
এখবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্রুত গতিতে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। আবু সুফিয়ান ভয়ে এত দ্রুত পলায়ন করেন যে, বোঝা হালকা করার জন্য তাদের বহু রসদ সম্ভার এবং ছাতুর বস্তা রাস্তার পাশে ফেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বারক্বারাতুল কুদর(قَرْقَرَةُ الْكُدْر) পর্যন্ত ধাওয়া করে ফিরবার পথে তাদের ফেলে যাওয়া পাথেয় ও ছাতুর বস্তাগুলো নিয়ে আসেন। ছাতুকে আরবীতে ‘সাভীক্ব’ (السَّوِيق) বলা হয়। সেজন্য এই অভিযানটি ‘গাযওয়া সাভীক্ব’ বা ছাতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছে। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আবু লুবাবাহ বাশীর বিন মুনযির (রাঃ)।[6]
১৬. গাযওয়া যী আমর(غزوة ذي أمر) : ৩য় হিজরীর ছফর মাস। উদ্দেশ্য নাজদের বনু গাত্বফান গোত্র। তাদের বনু ছা‘লাবাহ ও বনু মুহারিব গোত্রদ্বয় বিরাট এক বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমন করবে মর্মে খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাড়ে চারশ’ সৈন্য নিয়ে মুহাররম মাসেই তাদের মুকাবিলায় বের হন। পথিমধ্যে বনু ছা‘লাবাহ গোত্রের জাববার (جَبَّار) নামক জনৈক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে মুসলমান হয়ে যায় এবং মুসলিম বাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে। শত্রুপক্ষ পালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ঘাঁটি এলাকায় পৌঁছে যী আমর(ذي أمر) নামক ঝর্ণাধারার পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে পুরা ছফর মাস বা তার কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করেন। যাতে মুসলিম শক্তির প্রভাব ও প্রতিপত্তি শত্রুদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন হযরত ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)।[7]
১৭. সারিইয়া মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ(سرية محمد بن مسلمة فى قتل كعب بن الأشرف) (কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ড); হিজরতের ২৫ মাস পরে ৩য় হিজরীর ১৪ই রবীউল আউয়াল) :
মদীনার নামকরা ইহূদী পুঁজিপতি ও কবি কা‘ব বিন আশরাফ সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহূদীদেরকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিত। তার পিতা ছিল বনু ত্বাঈ গোত্রের এবং মা ছিল মদীনার ইহূদী বনু নাযীর গোত্রের। বদর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সে মক্কায় গিয়ে কুরায়েশ নেতাদের পুনরায় যুদ্ধে উস্কে দেয়। তারপর মদীনায় ফিরে এসে ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলতে থাকে। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেমতে আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি দল ১৪ই রবীউল আউয়াল চাঁদনী রাতে তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে হত্যা করে।[8] এই ঘটনার পর ইহূদীরা সম্পূর্ণরূপে হিম্মত হারিয়ে ফেলে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করে (আবুদাঊদ হা/৩০০০)। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আভ্যন্তরীণ গোলযোগের আশংকা হ’তে মুক্ত হন এবং বহিরাক্রমণ মুকাবিলার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
কা‘ব বিন আশরাফ ছিল একজন খ্যাতনামা ইহূদী পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তার দুর্গটি ছিল মদীনার পূর্ব-দক্ষিণে দু’মাইল দূরে বনু নাযীর গোত্রের পশ্চাদভূমিতে। বদর যুদ্ধে কুরায়েশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে ও কুরায়েশ নেতাদের প্রশংসা করে সে কবিতা বলতে থাকে। কিন্তু তাতে তার ক্ষোভের আগুন প্রশমিত না হওয়ায় সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। সে যুগে কবিতাই ছিল সাহিত্যের বাহন এবং কারু প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করার প্রধান হাতিয়ার। কোন বংশে কোন কবি জন্মগ্রহণ করলে সে বংশ তাকে নিয়ে গর্ব করত এবং তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হ’ত। আবু সুফিয়ান এবং মক্কার নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, أَدِينُنَا أَحَبُّ إِلَى اللهِ أَمْ دِينُ مُحَمَّدٍ وَأَصْحَابِهِ وأَيُّ الْفَرِيقَينِ أَهْدَى سَبيلاً؟ ‘আমাদের দ্বীন আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয় না মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দ্বীন? আর এ দু’টি দলের মধ্যে কোন দলটি অধিক সুপথপ্রাপ্ত? সে বলল, أَنْتُمْ أَهْدَى مِنْهُمْ سَبِيلاً ‘তোমরাই তাদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’।[9]
উক্ত প্রসঙ্গে সূরা নিসা ৫১-৫২ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلاَءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلاً- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيرًا ‘তুমি কি তাদের (ইহূদীদের) দেখোনি, যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং (মক্কার) কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’। ‘এদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাৎ করেন, তুমি তার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নিসা ৫১-৫২ আয়াত)।
এরপর সে মদীনায় ফিরে এসে একই রূপ আচরণ করতে থাকে। এমনকি ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা রটনা করতে থাকে ও নানাবিধ ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বলতে থাকে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مَنْ لِكَعْبِ بْنِ الأَشْرَفِ فَإِنَّهُ قَدْ آذَى اللهَ وَرَسُولَهُ‘কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে আছ? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে’। তখন আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ أَتُحِبُّ أَنْ أَقْتُلَهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে কিছু উল্টা-পাল্টা কথা বলার অনুমতি দিন’। রাসূল (ছাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর তার নেতৃত্বে ‘আববাদ বিন বিশর ও কা‘ব বিন আশরাফের দুধভাই আবু নায়েলাহ সহ পাঁচ জন প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। সে মোতাবেক প্রথমে মুহাম্মাদ ও পরে আবু নায়েলাহ কা‘বের কাছে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে অনেক কথার মধ্যে একথাও বলেন যে, এ ব্যক্তি আমাদের কাছে ছাদাক্বা চাচ্ছে। এ লোক আমাদেরকে দারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। অতএব আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের কষ্ট নিবারণের জন্য আপনার নিকটে কিছু খাদ্য-শস্য কামনা করছি। কা‘ব কিছু বন্ধকের বিনিময়ে দিতে রাযী হ’ল। প্রথমে নারী বন্ধক, অতঃপর পুত্র বন্ধক, অবশেষে অস্ত্র বন্ধকের ব্যাপারে নিষ্পত্তি হ’ল। আবু নায়েলাহ বলল, আমারই মত কষ্টে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনি তাদেরও কিছু খাদ্য-শস্য দিয়ে অনুগ্রহ করুন। অতঃপর পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে (৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখের) চাঁদনী রাতে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ তার দলবল নিয়ে কা‘বের বাড়ীতে গেলেন (বুখারী হা/৪০৩৭, জাবের (রাঃ) হ’তে)। কা‘ব বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে তার বিরুদ্ধে একদল লোক পাঠাতে বললেন, যেন তারা তাকে হত্যা করে। তখন তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে পাঠালেন (আবুদাউদ হা/৩০০০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বাকী‘ গারক্বাদ পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং বলেন,انْطَلِقُوا عَلَى اسْمِ اللهِ وَقَالَ: اللهُمَّ أَعِنْهُمْ ‘তোমরা আল্লাহর নামে অগ্রসর হও। হে আল্লাহ তুমি এদের সাহায্য কর’ (আহমাদ হা/২৩৯১)।
দুধভাই আবু নায়েলাহ কা‘বের দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে ডাক দিল। এ সময় কা‘বের নববধূ তাকে বাধা দিয়ে বলল, أَسْمَعُ صَوْتًا كَأَنَّهُ يَقْطُرُ مِنْهُ الدَّمُ ‘আমি এমন এক ডাক শুনলাম, মনে হ’ল তা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে’। কিন্তু কা‘ব কোনরূপ সন্দেহ না করে বলল, এরা তো আমার ভাই। তাছাড়াإِنَّ الْكَرِيمَ لَوْ دُعِىَ إِلَى طَعْنَةٍ بِلَيْلٍ لأَجَابَ ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি রাত্রিতে যদি তরবারির দিকেও আহুত হন, তথাপি তিনি তাতে সাড়া দিয়ে থাকেন’।
মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ অপর দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদেরকে বলেছিলেন, যখন সে আসবে তখন আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকতে থাকব। যখন তোমরা আমাকে দেখবে যে, খুব শক্তভাবে আমি তার মাথা অাঁকড়িয়ে ধরেছি, তখন তোমরা তরবারি দিয়ে তাকে আঘাত করবে।
অতঃপর কা‘ব চাদর গায়ে দিয়ে নীচে নেমে আসলে তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আজকের মতো এত উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো দেখিনি। উত্তরে কা‘ব বলল, আমার নিকট আরবের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন সুগন্ধি ব্যবহারকারী মহিলা আছে। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তার মাথা শুঁকলেন এবং এরপর তার সাথীদেরকে শুঁকালেন। তারপর তিনি আবার বললেন, ‘আমাকে আর একবার শুঁকবার অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তাকে কাবু করে ফেলে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা একে হত্যা করো। তারা তাকে হত্যা করলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে খবর দিলেন’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ সময় রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে দো‘আ করে বলেন, أفلَحَتِ الوجوهُ ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’ (হাকেম হা/৫৮৪০, সনদ ছহীহ)।
কা‘ব বিন আশরাফকে গোপনে হত্যা করায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের স্বার্থে এরূপ দুশমনকে গুপ্তহত্যা করা চলে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী ও অপপ্রচারকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড (তাওবাহ ৯/৬৫-৬৬)। মুসলিম মহিলাদের ইয্যত নিয়ে কুৎসা রটনাকারীদের জন্য একই শাস্তি নির্ধারিত। এই ধরনের দুশমন নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন বোধে যেকোন কৌশলের আশ্রয় নেয়া যাবে। তবে এর জন্য সর্বোচ্চ সরকারী নির্দেশ আবশ্যিক হবে। এককভাবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য এরূপ করা সিদ্ধ নয়। কেননা এখানে রাসূল (ছাঃ) ছিলেন সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা।
[2]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/৩; ইবনু সা‘দ ২/২১; আল-ইছাবাহ, সালেম ক্রমিক ৩০৪৮; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৭। মুবারকপুরী এটা ধরেননি।
ইবনু হিশাম এখানে সারিইয়া সালেম বিন ওমায়েরকে আগে এনেছেন। তিনি বলেন, হারেছ বিন সুওয়াইদ বিন ছামেতকে হত্যা করার পর আবু ‘আফাক-এর মুনাফেকী স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার আদেশ দেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৫-৩৬)। অতঃপর আবু ‘আফাক-এর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ‘আছমা বিনতে মারওয়ান আল-খিত্বমিয়াহ মুনাফিক হয়ে যান এবং ইসলাম ও ইসলামের নবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলেন। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে ওমায়ের বিন ‘আদী তাকে হত্যা করেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৬-৩৭)।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৪৩; আল-বিদায়াহ ৩/৩৪৪; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৯; আর-রাহীক্ব ২৩৪ পৃঃ।
[4]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৮। এটি অন্য কেউ ধরেননি।
[5]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৭০; ইবনু হিশাম ২/৪৭-৪৯; ইবনু সা‘দ ২/২১-২২; আর-রাহীক্ব ২৩৬ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩০, ২/১৮৭।
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, বনু ক্বায়নুক্বার শাস বিন ক্বায়েস (شَاسُ بْنُ قَيْسٍ) নামক জনৈক বৃদ্ধ ইহূদী মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একদিন সে ছাহাবায়ে কেরামের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ছাহাবী ছিলেন। দুই গোত্রের লোকদের মধ্যকার এই প্রীতিপূর্ণ বৈঠক তার নিকটে অসহ্য ছিল। কেননা উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রেখে উভয় গোত্রের নিকটে অস্ত্র বিক্রি ও সূদ ভিত্তিক ঋণদান ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে। ইসলাম আসার পর এসব বন্ধ হয়েছে এবং তারা পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেছে। যাতে দারুণ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় মদীনার কুসিদজীবী ইহূদী গোত্রগুলি।
ঐ বৃদ্ধ একজন যুবক ইহূদীকে উক্ত মজলিসে পাঠাল এই নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন সেখানে গিয়ে উভয় গোত্রের মধ্যে পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত বু‘আছ (بعاث) যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হ’তে যেসব বিদ্বেষমূলক ও আক্রমণাত্মক কবিতা সমূহ পঠিত হ’ত, তা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। যুবকটি যথারীতি তাই-ই করল এবং উভয় গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে লড়াইয়ের অবস্থা তৈরী হয়ে গেল। এমনকি উভয় পক্ষ ‘হার্রাহ’ (الْحَرَّةُ) নামক স্থানের দিকে ‘অস্ত্র অস্ত্র’ (السَّلاح السَّلاح) বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
এ খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন মুহাজির ছাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হ’লেন এবং সবাইকে শান্ত করলেন। তখন সবাই বুঝলেন যে, এটা শয়তানী প্ররোচনা (نَزْغَةٌ مِنْ الشَّيْطَانِ) ব্যতীত কিছুই নয়। তারা তওবা করলেন ও পরস্পরে বুক মিলিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এভাবে শাস বিন ক্বায়েস ইহূদী শয়তানের জ্বালানো আগুন দ্রুত নিভে গেল। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে আলে ইমরান ৯৮-১০০ আয়াতগুলি নাযিল হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৫৫৫-৫৫৭)। ঘটনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। ফলে এর সনদ ‘মু‘যাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৩৫-৩৬ পৃঃ)।
(২) প্রসিদ্ধ আছে যে, বদর যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে উপস্থিত হ’লেন ও তাদের ডেকে নানাভাবে উপদেশ দিলেন। অবশেষে বললেন, يَا مَعْشَرَ يَهُودَ أَسْلِمُوا قَبْلَ أَنْ يُصِيبَكُمْ مِثْلُ مَا أَصَابَ قُرَيْشًا- ‘হে ইহূদী সম্প্রদায়! তোমরা অনুগত হও কুরায়েশদের ন্যায় অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার আগেই’। এতে তারা উত্তেজিত হয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কিছু কুরায়েশকে হত্যা করে ধোঁকায় পড়ো না। ওরা আনাড়ী। ওরা যুদ্ধবিদ্যার কিছুই জানে না। যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, তবে তুমি আমাদের মত কাউকে পাবে না’। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে আলে ইমরান ১২ আয়াতটি নাযিল হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৫৫২; আবুদাঊদ হা/৩০০১ সনদ যঈফ; মা শা-‘আ ১৩৪ পৃঃ)।
(৩) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, একদিন জনৈকা মুসলিম মহিলা বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহূদী স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে বসেন। তখন কতগুলো দুষ্টমতি ইহূদী তার মুখের অবগুণ্ঠন খুলতে চায়। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তখন ঐ স্বর্ণকার ঐ মহিলার অগোচরে তার কাপড়ের এক প্রান্ত তার পিঠের দিকে গিরা দেয়। কাজ শেষে মহিলা উঠে দাঁড়াতেই কাপড়ে টান পড়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। দুর্বৃত্তরা তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এতে মহিলাটি লজ্জায় ও ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠেন। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান ঐ স্বর্ণকারের উপরে লাফিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলেন। প্রত্যুত্তরে এক ইহূদী ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলমানটিকে হত্যা করে। ফলে সংঘাত বেধে যায়’ (ইবনু হিশাম ২/৪৮)। ঘটনাটির সনদ ‘যঈফ’। প্রকৃত প্রস্তাবে বনু ক্বাইনুক্বার বহিষ্কারের প্রত্যক্ষ কোন কারণ পাওয়া যায় না। বরং তাদের লাগাতার ষড়যন্ত্র থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াই ছিল এর মূল কারণ’ (মা শা-‘আ ১৩৩-৩৪ পৃঃ)।
[6]. ইবনু সা‘দ ২/২২-২৩; ইবনু হিশাম ২/৪৪-৪৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৯-৭০; আর-রাহীক্ব ২৪০ পৃঃ।
[7]. ইবনু হিশাম ২/৪৬; আর-রাহীক্ব ২৪১ পৃঃ।
[8]. ইবনু সা‘দ ২/২৪; ইবনু হিশাম ২/৫১; বুখারী হা/৪০৩৭ ‘কা‘ব বিন আশরাফ হত্যাকান্ড’ অনুচ্ছেদ।
[9]. ইবনু কাছীর, সীরাহ নববিইয়াহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ ১৩৯৫/১৯৭৬ খৃ.) ৩/১২।
[10]. বুখারী হা/৪০৩৭, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ; আহমাদ হা/২৩৯১; আবুদাঊদ হা/২৭৬৮; ইরওয়া হা/১১৯১ সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ২/৫১-৫৭; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭১; আর-রাহীক্ব ২৪২-৪৫ পৃঃ।
প্রসিদ্ধ আছে যে, কাজ সেরে তার মাথা নিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদে ফিরে এসে তারা জোরে তাকবীর ধ্বনি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তাকবীর ধ্বনি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং খুশী হয়ে বলেন, أفلَحَتِ الوجوهُ ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’। তারাও বললেন, وَوَجْهُكَ يا رسولَ الله ‘এবং আপনার চেহারাও হে আল্লাহর রাসূল’! এ সময় ঐ দুষ্টের কাটা মাথাটা তার সামনে রাখা হ’লে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করেন (আর-রাহীক্ব ২৪৪-৪৫ পৃঃ)। ঘটনাটি ওয়াক্বেদী ও ইবনু সা‘দ স্ব স্ব গ্রন্থে বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। অতএব তা গ্রহণযোগ্য নয়।