রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌঁছে। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তাঁর আদেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান (ইবনু হিশাম ১/৬৪৪-৪৫)। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য। অতঃপর তিনি ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নছীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হ’তে পারে। কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হস্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিলেন। জামাতা আবুল ‘আছ সহ কয়েকজনকে রক্তমূল্য ছাড়াই মুক্তি দেন। আবুল ‘আছ ছিলেন খাদীজার সহোদর বোনের ছেলে এবং রাসূল-কন্যা যয়নবের স্বামী। ফিদইয়া দিতে অক্ষম কয়েকজনকে মাথা প্রতি ১০ জনকে লেখাপড়া শিখানোর বিনিময়ে মদীনাতেই রেখে দেন। তাদের মেয়াদ ছিল উত্তম রূপে পড়া ও লেখা শিক্ষা দান করা পর্যন্ত। এর দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর আকুল আগ্রহের প্রমাণ মেলে। যা কোন যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ইতিহাসে ছিল নযীরবিহীন। ওছমান (রাঃ)সহ নয় জন ছাহাবীকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও গণীমতের অংশ দেন তাদের যথার্থ ওযর ও অন্যান্য সহযোগিতার কারণে।
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় রাসূল-কন্যা রুক্বাইয়া মৃত্যু শয্যায় থাকার কারণে ওছমান গণী (রাঃ) ও উসামা বিন যায়েদ-কে রাসূল (ছাঃ) মদীনায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৭০)। রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ বিন রবী‘-এর রক্তমূল্য বাবদ তাঁর কন্যা যয়নবের যে কণ্ঠহারটি পেশ করা হয়, তা ছিল হযরত খাদীজার দেওয়া। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, إِنْ رَأَيْتُمْ أَنْ تُطْلِقُوا لَهَا أَسِيرَهَا وَتَرُدُّوا عَلَيْهَا الَّذِى لَهَا ‘যদি তোমরা যয়নাবের জন্য তার বন্দীকে মুক্তি দিতে এবং তার কণ্ঠহারটিকে তার কাছে ফেরৎ দিতে’! তখন সবাই বলল, হ্যাঁ। অতঃপর কন্যা যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়ার শর্ত করা হয়। অতঃপর বদর যুদ্ধের কাছাকাছি এক মাস পর যায়েদ বিন হারেছাহ ও একজন আনছার ছাহাবীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁকে মদীনায় ফিরিয়ে আনা হয়।[1] উক্ত কণ্ঠহার বিষয়ে ‘অনন্য কণ্ঠহার’ (الْعِقْدُ الْفَرِيدُ) নামে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখিত আরবী নিবন্ধ বাংলাদেশের সরকারী ডিগ্রী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসাবে রয়েছে।
হিজরতকালে হাববার ইবনুল আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব(هَبَّارُ بْنُ الْأَسْوَدِ) যয়নাবকে তার হাওদায় বর্শা দিয়ে আঘাত করে। তাতে তিনি উটের পিঠ থেকে একটি পাথরের উপর পতিত হ’লে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। যাতে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায় ও প্রচুর রক্তক্ষরণ হ’তে থাকে। এসময় আবু সুফিয়ান দলবল নিয়ে এসে উটচালক তাঁর দেবর কেনানাহ বিন রবী‘-কে বললেন, মুহাম্মাদের আহত মেয়েটিকে নিয়ে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে যাওয়াটা আমাদের জন্য হীনকর। তাকে আটকিয়ে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তুমি ওকে নিয়ে ফেরৎ যাও। অতঃপর রাতের বেলা গোপনে গিয়ে তার বাপের হাতে মেয়েকে পৌঁছে দাও। তার কথামতে কিনানাহ ফিরে যান এবং কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান শেষে একটু সুস্থ হ’লে রাতের বেলা তাকে নিয়ে যায়েদ বিন হারেছাহর নিকট পৌঁছে দেন। এভাবে ইসলামের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে যয়নব মদীনায় পিতৃগৃহে এবং আবুল ‘আছ মক্কায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে থাকেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন,هِيَ أَفْضَلُ بَنَاتِي أُصِيبَتْ فِيَّ ‘সে আমার সেরা মেয়ে। আমার জন্য সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে’।[2]
পরবর্তীতে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে আবুল ‘আছ মুসলমান হয়ে মদীনায় এলে যয়নবকে ছয় বছর পরে তার স্বামীর কাছে ন্যস্ত করা হয় এবং তাদের পূর্ব বিবাহ বহাল রাখা হয়।[3] যয়নব ৮ হিজরীর প্রথম দিকে এবং আবুল ‘আছ ১২ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে মৃত্যুবরণ করেন।[4]
উল্লেখ্য যে, হাববার মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬২)।
বন্দীমুক্তির পরের দিনই সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শের প্রতি আল্লাহর সমর্থন প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) ক্রন্দন করতে থাকেন। উক্ত আয়াতে বলা হয়,
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- لَوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ-
‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তজ্জন্য তোমাদেরকে ভয়ংকর শাস্তি পাকড়াও করত’ (আনফাল ৮/৬৭-৬৮)।
উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত পূর্ব বিধানটি ছিল নিম্নরূপ:
فَإِذا لَقِيْتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوْهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنّاً بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا-
‘অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দান মার। অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ নাও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শত্রু অস্ত্র সমর্পণ করে.. (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)।
উল্লেখ্য যে, নাখলা যুদ্ধের পরে ও বদর যুদ্ধের পূর্বে শা‘বান মাসে যুদ্ধ ফরয করে সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যাতে যুদ্ধের বিধি-বিধান সমূহ বর্ণিত হয়। এজন্য এ সূরাকে ‘সূরা ক্বিতাল’(سُوْرَةُ الْقِتَالِ) বলা হয়। তবে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে সূরা হজ্জের ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয় হিজরতের সময়কালে, কুরায়েশদের অব্যাহত সন্ত্রাস ও হামলা মুকাবিলার জন্য।
উক্ত সূরা মুহাম্মাদ ৪ আয়াতে অনুগ্রহ অথবা মুক্তিপণের কথা বলা হয়েছে। সেই বিধান মতেই বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সূরা আনফালে বর্ণিত ধমকির আয়াত দু’টি (৬৭-৬৮) সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে নাযিল হওয়ার মধ্যে আল্লাহর অশেষ করুণা নিহিত ছিল। যাতে বনু হাশেম সহ মুসলমানদের অনেক হিতাকাংখী বন্দী মুক্তি পান ও পরে তারা প্রকাশ্যে মুসলমান হয়ে যান। এই সময় বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। যেমন হযরত সা‘দ বিন নু‘মান (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় গেলে আবু সুফিয়ান তাকে আটকে দেন। পরে বদর যুদ্ধে বন্দী তার পুত্র আমর বিন আবু সুফিয়ানকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা হয়।[5]
[2]. হাকেম হা/৬৮৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৭১; আল-বিদায়াহ ৩/৩৩১।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬৫৭-৫৯; তিরমিযী হা/১১৪৩; আবুদাঊদ হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ হা/২০০৯, সনদ ছহীহ। যে হাদীছে নতুন বিবাহ ও নতুন মোহরের কথা এসেছে, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/১১৪২; ইবনু মাজাহ হা/২০১০)। অন্য বর্ণনায় ‘দুই বছর’ পরের কথা এসেছে (আবুদাঊদ হা/২২৪০ সনদ ছহীহ)। তার অর্থ হ’ল ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর কাফির ও মুসলিমে বিবাহ ছিন্ন হওয়ার যে নির্দেশ আসে, তার দু’বছর পরে (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুমতাহিনা ১০ আয়াত)।
[4]. আল-ইছাবাহ, যয়নব ক্রমিক ১১২১৭; ঐ, আবুল ‘আছ ক্রমিক ১০১৭৬।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৬৫০-৫৩।
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, বদর যুদ্ধে ‘খতীবু কুরায়েশ’ বলে খ্যাত বন্দী সুহায়েল বিন ‘আমরকে মুক্ত করার জন্য কুরায়েশরা যখন লোক পাঠায়, তখন ওমর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন, আমি সুহায়েল-এর দু’টি দাঁত উপড়ে ফেলি এবং জিহবা টেনে বের করে ফেলি। যাতে সে আপনার বিরুদ্ধে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কখনো বক্তৃতা করতে না পারে। জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি কখনোই তার অঙ্গহানি করব না। তাহ’লে আল্লাহ আমার অঙ্গহানি করবেন। যদিও আমি নবী’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি ওমরকে এ কথাও বলেন, সত্তর সে এমন স্থানে দাঁড়াবে যে, তুমি তাকে তিরষ্কার করবে না’ ( ইবনু হিশাম ১/৬৪৯)। বর্ণনাটি মু‘যাল বা যঈফ (মা শা-‘আ ১১৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, সুহায়েল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা শেষে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হয়। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন। বলা হয়েছে যে, তিনি ১৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
(২) বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরে মক্কার নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার কুপরামর্শে দুষ্টমতি ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী (عُمَيْرُ بن وَهْبٍ الْجُمَحِي) তীব্র বিষ মিশ্রিত তরবারি নিয়ে মদীনায় আগমন করে। তখন তার পুত্র ওয়াহাব বিন ওমায়ের মদীনায় বদর যুদ্ধে বন্দী হিসাবে ছিল। ছাফওয়ান তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারলে সে তার সকল ঋণ পরিশোধ করে দিবে এবং তার সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করবে। অতঃপর সে মদীনায় আসে এবং রাসূল (ছাঃ)-কে জাহেলী যুগের রীতি অনুযায়ী انْعَمُوا صَبَاحًا (সুপ্রভাত) বলে অভিবাদন করে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে তোমার চাইতে সুন্দর জান্নাতবাসীদের পারস্পরিক অভিবাদন السَّلام (সালাম) দ্বারা সম্মানিত করেছেন। অতঃপর সে তার ছেলের প্রতি সহনুভূতি দেখানোর অনুরোধ জানায়। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তোমার কাঁধে তরবারি কেন? জবাবে সে আসল উদ্দেশ্য লুকাতে চাইল। তখন রাসূল (ছাঃ) তার নিকট মক্কায় বসে ছাফওয়ান ও তার মধ্যকার গোপন পরামর্শ এবং তাঁকে হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক ও ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয়ে যায়। পরে মক্কায় ফিরে গিয়ে তার দাওয়াতে বহু লোক ইসলাম কবুল করে’ (ইবনু হিশাম ১/৬৬১; আল-বিদায়াহ ৩/৩১৩; আর-রাহীক্ব ২৩৫-৩৬ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৮২৬)।