নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
ইহূদীদের কপট চরিত্র (النفاق الطبيعى لليهود) :

হিজরতের পূর্ব থেকেই ইহূদীরা মক্কায় রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে জানত। এখন যখন তিনি মদীনায় হিজরত করে এলেন এবং মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন করলেন। যার ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও হিংসা-হানাহানিতে বিপর্যস্ত ইয়াছরিবের গোত্র সমূহের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ, মধুর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল, তখন তা ইহূদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। তাদের আশংকা হ’ল যে, এইভাবে যদি সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও আপোষে ভাই ভাই হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের ‘বিভক্ত কর ও শোষণ কর’ নীতি মাঠে মারা যাবে। এর ফলে তাদের সামাজিক নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। সাথে সাথে ইসলামে সূদ হারাম হওয়ার কারণে তাদের রক্তচোষা সূদী কারবার একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, যা তাদের পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ধ্বস নামাবে। এমনকি চক্রবৃদ্ধি হারে ফেঁপে ওঠা সূদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অত্যাচারমূলক চুক্তির ফলে ইয়াছরিব বাসীদের যে বিপুল ধন-সম্পদ তারা কুক্ষিগত করেছিল, তার সবই তাদেরকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হ’তে হবে। ফলে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে গোপনে শত্রুতা শুরু করে দেয়। পরে যা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তাদের কপট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় পদার্পণের প্রথম দিনেই ঘটে। নিম্নের দু’টি ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।-

দু’টি দৃষ্টান্ত (نظيران للنفاق) :

(১) আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব-এর আগমন (قدوم ياسر بن أخطب) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমনের পর প্রথম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব। তিনি তার লোকদের নিকট ফিরে গিয়ে বলেন,أَطِيْعُوْنِىْ فَإِنَّ هَذَا هُوَ النَّبِىُّ الَّذِىْ كُنَّا نَنْتَظِرُ ‘তোমরা আমার আনুগত্য কর। কেননা ইনিই সেই নবী আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম’। কিন্তু হুয়াই বিন আখত্বাব, যিনি তার ভাই ও গোত্রের নেতা ছিলেন, তার বিরোধিতার কারণে সাধারণ ইহূদীরা ইসলাম কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।[1]

উল্লেখ্য যে, ইহূদী আলেম ও সমাজনেতাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, لَوْ آمَنَ بِىْ عَشْرَةٌ مِنَ الْيَهُوْدِ لَآمَنَ بِى الْيَهُوْدُ ‘যদি আমার উপরে দশজন ইহূদী নেতা ঈমান আনত, তাহ’লে গোটা ইহূদী সম্প্রদায় আমার উপরে ঈমান আনতো’।[2] এতে বুঝা যায় যে, সমাজনেতা ও আলেমগণের দায়িত্ব সর্বাধিক। অতএব তাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য।

(২) আব্দুল্লাহ বিন সালাম-এর ইসলাম গ্রহণে প্রতিক্রিয়া(رجعية من إسلام عبد الله بن سلام) : ক্বোবার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ইয়াছরিবে তাঁর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জার গোত্রে অবতরণ করেন, তখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন ইহূদীদের সবচেয়ে বড় আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি ছিলেন বনু ক্বায়নুক্বা‘ ইহূদী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত (আবুদাঊদ হা/৩০০৫)। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যার উত্তর নবী ব্যতীত কারু পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সব প্রশ্নের সঠিক জবাব পেয়ে তিনি সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে, إِنَّ الْيَهُوْدَ قَوْمٌ بُهُتٌ إِنْ عَلِمُوْا بِإِسْلاَمِىْ قَبْلَ أَنْ تَسْأَلَهُمْ بَهَتُوْنِىْ عِنْدَكَ ‘ইহূদীরা হ’ল মিথ্যা অপবাদ দানকারী এক ঘৃণিত সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করার আগেই যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জেনে ফেলে, তাহ’লে তারা আপনার নিকটে আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিবে’। তখন তিনি আব্দুল্লাহকে পাশেই আত্মগোপন করতে বলে ইহূদীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদের নিকটে আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল,سَيِّدُنَا وَابْنُ سَيِّدِنَا، خَيْرُنَا وَابْنُ خَيْرِنَا ‘আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র। আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَأَعْلَمُنَا وَابْنُ أَعْلَمِنَا ‘আমাদের মধ্যে সেরা জ্ঞানী ও সেরা জ্ঞানীর পুত্র’ (বুখারী হা/৩৯১১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَفَرَأَيْتُمْ إِنْ أَسْلَمَ عَبْدُ اللهِ؟ ‘আচ্ছা যদি আব্দুল্লাহ মুসলমান হয়ে যায়’? জবাবে তারা দু’বার বা তিনবার বলল, أَعَاذَهُ اللهُ مِنْ ذَلِكَ ‘আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন’! অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন সালাম গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। এটা শোনামাত্র ইহূদীরা বলে উঠলো, شَرُّنَا وَابْنُ شَرِّنَا ‘আমাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ও নিকৃষ্ট ব্যক্তির পুত্র’।[3] আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেন,يَا مَعْشَرَ الْيَهُوْدَ اتَّقُوا اللهَ فَوَ اللهِ الَّذِىْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ، إِنَّكُمْ لَتَعْلَمُوْنَ أَنَهُ رَسُوْلُ اللهِ وَأَنَّهُ جَاءَ بِحَقٍّ ‘হে ইহূদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তোমরা ভালভাবেই জানো যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং ইনি সত্যসহ আগমন করেছেন’। জবাবে তারা বলল, كَذَبْتَ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’।[4] বলা বাহুল্য এটাই ছিল ইহূদীদের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা, যা তিনি মদীনায় পদার্পণের শুরুতেই অর্জন করেন।

আজকেও ইহূদী-নাছারাদের উক্ত বদস্বভাব অব্যাহত আছে। তাদের মিডিয়াগুলি রাসূল (ছাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বদা লাগামহীনভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিন যেমন মদীনার মুনাফিকরা ইহূদীদের দোসর ছিল, আজও তেমনি মুসলিম নামধারী বস্ত্তবাদীরা তাদের দোসর হিসাবে কাজ করছে।

[1]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৩৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ৭/২৭৫ পৃঃ। উল্লেখ্য যে, ইহূদী নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সম্পর্কে তার কন্যা ছাফিইয়াহ, যিনি পরবর্তীতে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী হয়ে উম্মুল মুমেনীন রূপে বরিত হন, তিনি বলেন, আমি আমার বাপ-চাচাদের নিকটে তাদের সকল সন্তানের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ছিলাম এবং সকলের আগেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তারা আদর করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথম ইয়াছরিবে আগমন করেন ও ক্বোবায় বনু ‘আমর বিন ‘আওফের গোত্রে অবতরণ করেন, সেদিন অতি প্রত্যুষে আমার পিতা ও চাচা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আমি ছুটে তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম তারা এত চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এ সময় আমি আমার চাচাকে বলতে শুনলাম তিনি আমার আববাকে বলছেন, أَهُوَ هُوَ؟ ‘ইনিই কি তিনি? আববা বললেন, نَعَمْ وَاللهِ ‘আল্লাহর কসম, ইনিই তিনি’। চাচা বললেন, فَمَا فِي نَفْسِكَ مِنْهُ؟ ‘এখন তাঁর সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী’? আববা বললেন, عَدَاوَتُهُ وَاللهِ مَا بَقِيتُ ‘স্রেফ শত্রুতা। আল্লাহর কসম! যতদিন আমি বেঁচে থাকব’ (ইবনু হিশাম ১/৫১৯; আল-বিদায়াহ ৩/২১২, আর-রাহীক্ব ১৮১ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ১২২ পৃঃ)।

অবশ্য মুসলমানদের প্রতি ইহূদীদের হিংসা ও শত্রুতা প্রমাণের জন্য এইরূপ যঈফ বর্ণনার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এজন্য পবিত্র কুরআনের সূরা বাক্বারায় বর্ণিত ১০৯, ৮৯, ১৪৬, ১২০ ও সূরা মায়েদাহ ৫১ আয়াতগুলিই যথেষ্ট।

[2]. বুখারী হা/৩৯৪১, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায় ৫২ অনুচ্ছেদ।

[3]. বুখারী হা/৩৩২৯; মিশকাত হা/৫৮৭০, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জিযা’ অনুচ্ছেদ-৭।

[4]. বুখারী হা/৩৯১১ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৪৫ অনুচ্ছেদ।