নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
আনছারগণের অপূর্ব ত্যাগ(الإيثار الرائع للأنصار)

আল্লাহপাক ঈমানের বরকতে আনছারগণের মধ্যে এমন মহববত সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যে, মুহাজিরগণকে ভাই হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রত্যেকে লালায়িত ছিলেন। যদিও তাদের মধ্যে সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু তারা ছিলেন ঈমানী প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। সবাই মুহাজিরগণকে স্ব স্ব পরিবারে পেতে চান। ফলে মুহাজিরগণকে আনছারদের সাথে ভাই ভাই হিসাবে ঈমানী বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়। তারা তাদের জমি, ব্যবসা ও বাড়ীতে তাদেরকে অংশীদার করে নেন। এমনকি যাদের দু’জন স্ত্রী ছিল, তারা একজনকে তালাক দিয়ে স্ত্রীহারা মুহাজির ভাইকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। রাসূল (ছাঃ) ও মুহাজিরগণের প্রতি এইরূপ অকুণ্ঠ সহযোগিতার জন্য তাঁরা ইতিহাসে ‘আনছার’ (সাহায্যকারী) নামে অভিহিত হয়েছেন।[1] যাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلاَ يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

‘আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে (মদীনায়) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে, তারা (আনছাররা) তাদেরকে (মুহাজিরদেরকে) ভালবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে কোনরূপ আকাংখা পোষণ করে না। আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তারা নিজেরা ছিল অভাবগ্রস্ত। বস্ত্ততঃ যারা মনের সংকীর্ণতা হ’তে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের প্রশংসায় বলেন, لَوْلاَ الْهِجْرَةُ لَكُنْتُ امْرَأً مِنَ الأَنْصَارِ ‘যদি হিজরতের বিষয়টি না থাকত, তাহ’লে আমি আনছারদের একজন হিসাবে গণ্য হ’তাম’ (বুখারী হা/৭২৪৫)।لَوْ سَلَكَتِ الأَنْصَارُ وَادِيًا أَوْ شِعْبًا، لَسَلَكْتُ وَادِىَ الأَنْصَارِ أَوْ شِعْبَهُمْ ‘যদি আনছারগণ কোন উপত্যকা বা ঘাঁটিতে অবতরণ করে, তাহ’লে আমিও তাদের সেই উপত্যকা বা ঘাঁটিতে অবতরণ করব’ (বুখারী হা/৩৭৭৮)। আর হিজরতকারী ও সাহায্যকারী উভয়দলের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং (পরবর্তীতে) যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবাহ ৯/১০০)

[বিস্তারিত ‘মাদানী জীবন’-এর ‘আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য]

[1]. আজকাল অনেক বাঙ্গালী মুসলমানকে তাদের নামের শেষে ‘কুরায়শী’ ও ‘আনছারী’ লিখতে দেখা যায়। অথচ এ লকব স্রেফ কুরায়েশ বংশীয়দের জন্য এবং মদীনার আনছারদের জন্য খাছ। অন্যদের জন্য নয়। এখন এসব ‘লকব’ ব্যবহার করা স্রেফ রিয়া ও অহংকারের পর্যায়ভুক্ত হবে। যাকে হাদীছে ‘জাহেলিয়াতের অহংকার’ (عُبِّيَّةُ الْجَاهِلِيَّةِ) বলা হয়েছে (তিরমিযী হা/৩৯৫৫; মিশকাত হা/৪৮৯৯)। এগুলিকে রাসূল (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন পায়ের তলে (كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوعٌ) পিষ্ট করেছেন’ (মুসলিম হা/১২১৮)। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ ‘নেতা হবে কুরায়েশদের মধ্য হ’তে’ (ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৭)। এটি ছিল সে সময় খলীফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে, (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নয় (ইরওয়া হা/৫২০-এর আলোচনা)। উক্ত হাদীছ দ্বারা সে সময় মদীনার মুহাজির কুরায়েশ নেতা আবুবকর, ওমর প্রমুখদের বুঝানো হয়েছিল। সাধারণ কুরায়েশদের নয়। কেননা আবু জাহল-আবু লাহাবরাও কুরায়েশ নেতা ছিলেন। কিন্তু তারা মুসলমানদের নেতা ছিলেন না। অতএব এসব লকব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।