ইয়াছরিবের উপকণ্ঠে পৌঁছে বনু সালেম বিন ‘আওফ গোত্রের ‘রানূনা’ (رَانُونَاء) উপত্যকায় তিনি ১ম জুম‘আর ছালাত আদায় করেন। যাতে একশত জন মুছল্লী শরীক হন।[1] এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর আদায়কৃত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুম‘আ। কেননা হিজরতের পূর্বে মদীনার আনছারগণ আপোষে পরামর্শক্রমে ইহূদী ও নাছারাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিনের বিপরীতে নিজেদের জন্য একটি ইবাদতের দিন ধার্য করেন ও সেমতে আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মদীনার বনু বায়াযাহ গোত্রের ‘নাক্বী‘উল খাযেমাত’ (نَقِيعُ الْخَضِمَاتِ) নামক স্থানের ‘নাবীত’ (هَزْمُ النَّبِيْتِ) সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত চালু হয়। যেখানে চল্লিশ জন মুছল্লী অংশগ্রহণ করেন।[2]
জুম‘আ পড়ে রাসূল (ছাঃ) পুনরায় যাত্রা করে দক্ষিণ দিক থেকে ইয়াছরিবে প্রবেশ করেন। এদিন ছিল ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার (আর-রাহীক্ব ১৮৪ পৃঃ)। ইয়াছরিবের শত শত মানুষ তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়। বহু পুরুষ ও নারী বাড়ী-ঘরের ছাদের উপরে আরোহন করেন। এমনকি ছোট্ট শিশু-কিশোররা বলতে থাকে, هَذَا رَسُولُ اللهِ قَدْ جَاءَ (এই যে, আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন (বুখারী হা/৪৯৪১ ‘তাফসীর’ অধ্যায়)। جَاءَ نَبِىُّ اللهِ، جَاءَ نَبِىُّ اللهِ (এই যে, আল্লাহর নবী এসে গেছেন (বুখারী হা/৩৯১১)। يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللهِ يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللهِ (হে মুহাম্মাদ! হে আল্লাহর রাসূল!-মুসলিম হা/২০০৯)। প্রত্যক্ষদর্শী ছাহাবী বারা বিন ‘আযেব আনছারী (রাঃ) বলেন, فَمَا رَأَيْتُ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرِحُوا بِشَىْءٍ فَرَحَهُمْ بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (ছাঃ)-এর আগমনে আমি মদীনাবাসীকে যত খুশী হ’তে দেখেছি, এত খুশী তাদের কখনো হ’তে দেখিনি’ (বুখারী হা/৩৯২৫)। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-এর আগমনের দিনের চেয়ে অধিক সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল দিন আর কখনো দেখিনি।[3] আনন্দে উচ্ছ্বসিত মানুষ ঐদিন থেকে তাদের শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘মদীনাতুর রাসূল’ (রাসূলের শহর) বা সংক্ষেপে ‘মদীনা’।[4]
ইয়াছরিবে প্রবেশের পর প্রত্যেক বাড়ীওয়ালা তার বাড়ীতে রাসূল (ছাঃ)-কে মেহমান হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে উটের লাগাম ধরে টানতে থাকে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) বলতে থাকেন, তোমরা ওকে ছাড়। কেননা সে আদেশপ্রাপ্ত’ (دَعُوهَا فَإِنَّهَا مَأْمُورَةٌ)। অতঃপর উষ্ট্রী নিজের গতিতে চলে বর্তমানের মসজিদে নববীর দরজার স্থানে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) নামেননি। পরে উষ্ট্রী পুনরায় উঠে কিছু দূর গিয়ে আবার পূর্বের স্থানে ফিরে এসে বসে পড়ে। এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের মহললা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চেয়েছিলেন এখানে অবতরণ করে তার মাতুল বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে। আল্লাহ তার সে আশা পূরণ করে দেন। এখন বনু নাজ্জার গোত্রের লোকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গেল কে রাসূলকে আগে তার বাড়ীতে নিবে। আবু আইয়ূব আনছারী উষ্ট্রীর পিঠ থেকে পালান উঠিয়ে নিজ বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। ওদিকে আক্বাবাহর প্রথম বায়‘আতকারী আস‘আদ বিন যুরারাহ উটের লাগাম ধরে রইলেন। কেউ দাবী ছাড়তে চান না।[5]
উল্লেখ্য যে, ইবনু ইসহাক এখানে পরপর দু’টি খুৎবা উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ১/৫০০-০১; বায়হাক্বী দালায়েল ২/৫২৪-২৫; যাদুল মা‘আদ ১/৩৬২-৬৩ টীকাসহ)। বর্ণনা দু’টির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৫৩৬, ৫৩৭)। খুৎবা দু’টি বিভিন্ন পাঠ্য পুস্তকে এবং খুৎবার কিতাবসমূহে প্রচলিত আছে। কিন্তু তা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/১০৮২; আবুদাঊদ হা/১০৬৯ সনদ ‘হাসান’। ইবনু হিশাম ১/৪৩৫; যাদুল মা‘আদ ১/৩৬১; মির‘আত ৪/৪২০।
[3]. আহমাদ হা/১২২৫৬, সনদ ছহীহ। প্রসিদ্ধ আছে যে, এই সময় মদীনার ছোট ছোট মেয়েরা রাসূল (ছাঃ)-কে স্বাগত জানিয়ে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করে। বর্ণনাটির সনদ মু‘যাল বা যঈফ (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৯৮)। কবিতাটি ছিল নিম্নরূপ:
طَلَعَ الْبَدْرُ عَلَيْنَا + مِنْ ثَنِيَّاتِ الْوَدَاع
وَجَبَ الشّكْرُ عَلَيْنَا + مَا دَعَا ِللهِ دَاعِ
أَيُّهَا الْمَبْعُوْثُ فِيْنَا + جِئْتَ بِالأَمْرِ الْمُطَاع
‘ছানিয়াতুল বিদা টিলা সমূহ হ’তে আমাদের উপরে পূর্ণচন্দ্র উদিত হয়েছে’। ‘আমাদের উপরে শুকরিয়া ওয়াজিব হয়েছে এজন্য যে, আহবানকারী (রাসূল) আল্লাহর জন্য (আমাদেরকে) আহবান করেছেন’। ‘হে আমাদের মধ্যে (আল্লাহর) প্রেরিত পুরুষ! আপনি এসেছেন অনুসরণীয় বিষয়বস্ত্ত (ইসলাম) নিয়ে’ (আর-রাহীক্ব ১৭২, ৪৩৬ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৫/২৩)।
কবিতাটি প্রথম জীবনীকার মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (৮৫-১৫১ হি.) উল্লেখ করেননি। পরবর্তীতে প্রায় সকল জীবনীকার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটি ছহীহ সনদে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ৮৭-৯০)। এ সময় মেয়েরা ‘দফ’ বাজিয়ে উক্ত গান গেয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল বলে যা বর্ণিত হয়েছে, তা যঈফ (আলবানী, দিফা‘ আনিল হাদীছ ২৪ পৃঃ)।
‘ছানিয়াহ’ (ثَنِيَةٌ) অর্থ টিলা। মদীনার লোকেরা তাদের মেহমানদেরকে নিকটবর্তী এই টিলা পর্যন্ত এসে বিদায় জানাতো। এজন্য এই টিলা ‘ছানিয়াতুল বিদা’ বা বিদায় দানের টিলা নামে পরিচিত হয়। অধিকাংশ জীবনীকার এটিকে হিজরতকালে মদীনায় উপস্থিতির সময়ের ঘটনা বলেছেন। ইবনুল ক্বাইয়িম প্রমুখ বিদ্বানগণ এটিকে তাবূক অভিযান থেকে মদীনায় উপস্থিতির সময়ের ঘটনা বলেছেন। তারা বলেন, কোন কোন বর্ণনাকারী এটাকে হিজরতকালীন ঘটনা বলেছেন। এটি স্পষ্টভাবে ধারণা মাত্র। কেননা ‘ছানিয়াতুল বিদা’ হ’ল মদীনা থেকে শামমুখী রাস্তায়, মক্কা থেকে মদীনায় আগমনকারী ব্যক্তি তা দেখতে পাবে না। এটা কেবল ঐ ব্যক্তি অতিক্রম করবে, যে শাম থেকে মদীনায় আসবে (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৮২)।
বায়হাক্বী বলেন, আমাদের বিদ্বানগণ এটিকে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতকালীন সময়ের কথা বলেছেন, তাবূক থেকে ফেরার সময় নয়’ (আল-বিদায়াহ ৫/২৩)। জীবনীকার আলী আল-হালাবী (৯৭৫-১০৪৪ হি.) বলেন, ولا مانع من تعدد ذلك ‘এটি একাধিক বার হওয়ায় কোন বাধা নেই’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/২০৪)। তাছাড়া ‘ছানিয়াহ’ বা টিলা দু’দিকে হওয়াটা অসম্ভব নয়। বস্ত্ততঃ এ ব্যাপারে প্রমাণিত সেটুকুই যা ছহীহ হাদীছ সমূহে উপরে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে কবিতা পাঠের কথা নেই।
[4]. আর-রাহীক্ব ১৭২ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ২/৩০৯; বুখারী হা/১৮৭১; মুসলিম হা/১৩৮২।
[5]. আর-রাহীক্ব ১৭৩ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৩/২০২; যাদুল মা‘আদ ১/৯৯- টীকা; ইবনু হিশাম ১/৪৯৪। লোকদের সকলের দাবীর মুখে রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেন, তোমরা উষ্ট্রীকে ছেড়ে দাও, সে আদেশপ্রাপ্ত’(خَلُّوا سَبِيلَهَا فَإِنَّهَا مَأْمُورَةٌ)। অতঃপর সে বর্তমান মসজিদে নববীর দরজার সামনে বসে পড়ে (ইবনু হিশাম ১/৪৯৫)। বর্ণনাটি যঈফ। তবে বহু সূত্রে এবং আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের সূত্রে আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের কারণে এটি ‘হাসান লিগায়রিহি’ স্তরে উন্নীত হয়েছে’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/২১৯-টীকা)। অবশ্য তিনি যে সেখানেই অবতরণ করেছিলেন, তা মুসলিম (হা/২০৫৩ (১৭১) ও বুখারী (হা/৩৯১১) দ্বারা প্রমাণিত।