নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

(১) বায়‘আতে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ের প্রতিটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি শুধু সেযুগেই নয়, বরং সর্বযুগেই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণিত বিষয়গুলি সমাজে ব্যাপ্তি লাভ করলে সমাজে শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট হয়। জাহেলী আরবে এগুলি বিনষ্ট হয়েছিল বলেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ বিষয়গুলি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। আজকালকের কথিত সভ্য দুনিয়ায় এগুলি প্রকট আকারে বিদ্যমান। আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যা ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব দুনিয়াপূজারী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আখেরাতমুখী করার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতাগণ আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে কাংখিত শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

(২) বায়‘আত (الْبَيْعَةُ) অর্থ অঙ্গীকার। ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,

سُمِّيَتِ الْمُعَاهَدَةُ عَلَى الإسلامِ بِالْمُبَايَعَةِ تَشْبيهاً لِّنَيْلِ الثَّوَابِ فِيْ مُقَابَلَةِ الطَّاعَةِ بِعَقْدِ الْبَيْعِ الَّذِي هُوَ مُقَابَلَةُ مَالٍ، كَأَنَّهُ بَاعَ مَا عِنْدَهُ مِنْ صَاحِبِهِ وَأَعْطَاهُ خَالِصَةَ نَفْسِهِ وَطَاعَتِهِ كَمَا فِيْ قَوْلِهِ تَعَالَى: (إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ) الآية

‘ইসলামের উপরে কৃত অঙ্গীকারকে বায়‘আত এজন্য বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়িক চুক্তির বিপরীতে যেমন সম্পদ লাভ হয়, আমীরের নিকটে বায়‘আতের মাধ্যমে আনুগত্যের বিপরীতে তেমনি পুণ্য লাভ হয়। সে যেন আমীরের নিকটে তার খালেছ হৃদয় ও আনুগত্য বিক্রয় করে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল খরীদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে...’ (তাওবাহ ৯/১১১)।[1]

দুনিয়াবী সমাজ ব্যবস্থায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য শপথ ও অঙ্গীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলিম-অমুসলিম সব সমাজেই এটি রয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা এবং কার্যের ধরণ অনুযায়ী অঙ্গীকারের ধরণ ও ভাষা পরিবর্তিত হয়। ইসলামী জীবন ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নেতা ও কর্মীর মধ্যে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করতে হয়। ইসলামী পরিভাষায় যাকে বায়‘আত বলা হয়। এর একমাত্র লক্ষ্য থাকে ইসলামী বিধান মেনে নিজের জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং আখেরাতে জান্নাত লাভ করা। যার মধ্যে কোন দুনিয়াবী স্বার্থ থাকে না। যিনি যত বেশী আল্লাহর বিধান মেনে চলবেন, তিনি তত বেশী নেকী উপার্জন করবেন। সেকারণ ইসলামী ইমারত ও বায়‘আত এবং অন্যান্য নেতৃত্ব ও শপথ গ্রহণের মধ্যে আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য রয়েছে। তাই ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইমারত ও বায়‘আতের গুরুত্ব সর্বাধিক।

নবীগণ এ তরীকাতেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মাক্কী ও মাদানী জীবনে একই তরীকা অবলম্বন করেছেন। সর্বদা উক্ত নীতি অব্যাহত থাকবে, যদি না তাওহীদী সমাজ গঠনের মহান লক্ষ্যে যোগ্য ও বিশ্বস্ত কোন আমীর ও মামূর পরস্পরে আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। যদিও সেখানে দৃঢ় বিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী, শিথিল বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদী এমনকি বায়‘আত ভঙ্গকারীরাও থাকবে। যেভাবে নবীযুগে বায়‘আতকারীদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু তাই বলে নীতির পরিবর্তন হবে না।

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে এটি যরূরী। রাসূল (ছাঃ) মাক্কী জীবনে সামাজিক এবং মাদানী জীবনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষেত্রে আমীর ছিলেন। রাষ্ট্রীয় আমীর ইসলামের দন্ডবিধি সমূহ জারী করবেন। কিন্তু সামাজিক বা সাংগঠনিক আমীর সেটা করবেন না। তবে উপদেশ ও অনুশাসন জারি রাখবেন। যার মাধ্যমে ইসলামের বিধিনিষেধ সমূহ সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সর্বোপরি জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের ইসলামী নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করা সম্ভব হবে। অতএব অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম উভয় সরকারের শাসনামলে মুমিনের কর্তব্য হ’ল, (১) শাসকের প্রতি অনুগত থাকা এবং ইসলামী আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধভাবে দেশে ইসলামী বিধান ও নিজেদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (২) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৩) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা এবং পরিশেষে যালেম সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা।

মোটকথা দেশে ইসলামী খেলাফত থাক বা না থাক, সমাজ পরিচালনায় ইসলামী আমীর থাকতেই হবে। নইলে ফাসেক নেতৃত্বে সমাজ বিপর্যস্ত হবে। যা আল্লাহর কাম্য নয়। এ কারণেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তার গর্দানে আমীরের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী (পথভ্রষ্ট) হালতে মৃত্যুবরণ করল। ক্বিয়ামতের দিন তার (মুক্তির জন্য) কোন দলীল (ওযর) থাকবে না’ (মুসলিম হা/১৮৫১)

[1]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ), মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (বেনারস, ভারত : ৪র্থ সংস্করণ ১৪১৯/১৯৯৮ খৃঃ) হা/১৮-এর ব্যাখ্যা ১/৭৫ পৃঃ ‘ঈমান’ অধ্যায়।