নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
ওমরের ইসলাম পরবর্তী ঘটনা (قصة عمر بعد قبول إسلامه)

ইসলাম কবুলের পরপরই তিনি ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করেন এবং তার মুখের উপরে বলে দেন, جِئْتُ لِأُخْبِرَكَ أَنِّي قَدْ آمَنْتُ بِاللهِ وَبِرَسُولِهِ مُحَمَّدٍ، وَصَدَّقْتُ بِمَا جَاءَ بِهِ ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের উপরে ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী‘আত এনেছেন, আমি তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনেই আবু জাহল সরোষে তাকে গালি দিয়ে বলে ওঠেন, قَبَّحَكَ اللهُ، وَقَبَّحَ مَا جِئْتَ بِهِ ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ, তার মন্দ করুন’। অতঃপর তার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে যান।[1]

পুত্র আব্দুল্লাহ বিন ওমর বালক অবস্থায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বলেন, এরপর ওমর গেলেন সে সময়ের সেরা মাউথ মিডিয়া জামীল বিন মা‘মার আল-জুমাহীর (جميل بن معمر الجمحي) কাছে এবং তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি’। সে ছিল কুরায়েশ বংশের সেরা ঘোষক এবং অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ তার মাধ্যমেই সর্বত্র প্রচার করা হ’ত। ওমর (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর শোনামাত্র সে বেরিয়ে পড়ল। আর চিৎকার দিয়ে সবাইকে শুনাতে থাকল, أَلاَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ قَدْ صَبَأَ ‘শুনে রাখো, খাত্ত্বাবের পুত্র ওমর ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে’। ওমর (রাঃ) তার পিছনেই ছিলেন। তিনি বললেন, كَذَبَ، وَلَكِنِّي قَدْ أَسْلَمْتُ ‘সে মিথ্যা বলেছে। বরং আমি মুসলমান হয়েছি’। একথা শোনা মাত্র চারিদিক থেকে লোক জমা হয়ে গেল এবং সকলে ওমরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট দুপুর পর্যন্ত চলল। এ সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে ওমর (রাঃ) আল্লাহর কসম দিয়ে বলেন, لَوْ قَدْ كُنَّا ثَلاَثَ ماِئَةِ رَجُلٍ لَقَدْ تَرَكْنَاهَا لَكُمْ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا لَنَا ‘যদি আমরা আজ সংখ্যায় তিনশ’ পুরুষ হ’তাম, তবে দেখতাম মক্কায় তোমরা থাকতে, না আমরা থাকতাম’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৯)।

এই ঘটনার পর নেতারা ওমরকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। ওমর (রাঃ) ঘরের মধ্যেই ছিলেন। এমন সময় তাদের গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ বনু সাহম গোত্রের জনৈক নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল সাহ্মী সেখানে এসে উপস্থিত হ’লেন। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি মুসলমান হয়েছি বিধায় আপনার সম্প্রদায় আমাকে হত্যা করতে চায়’। তিনি বলে উঠলেন, لاَ سَبِيلَ إِلَيْكَ ‘কখনোই তা হবার নয়’। বলেই তিনি সোজা চলে গেলেন জনতার সামনে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে জটলা করছ কেন? তারা বলল, هَذَا ابْنَ الْخَطَّابِ الَّذِى صَبَأَ ‘ইবনুল খাত্ত্বাব ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে’। তিনি বললেন, لاَ سَبِيلَ إِلَيْهِ ‘যাও! সেখানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই’। তার কাছে একথা শুনে লোকেরা ফিরে গেল।[2]

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, مَا كُنَّا نَقْدِرُ عَلَى أَنْ نُصَلِّيَ عِنْدَ الْكَعْبَةِ، حَتَّى أَسْلَمَ عُمَرُ، فَلَمَّا أَسْلَمَ قَاتَلَ قُرَيْشًا حَتَّى صَلَّى عِنْدَ الْكَعْبَةِ، وَصَلَّيْنَا مَعَهُ- ‘ওমর ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত আমরা কা‘বাগৃহে ছালাত আদায়ে সক্ষম হইনি। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর কুরায়েশদের সাথে লড়াই করেন ও কা‘বাগৃহে ছালাত আদায় করেন এবং আমরা তাঁর সাথে ছালাত আদায় করি’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪২)। তিনি আরও বলেন, مَا زِلْنَا أَعِزَّةً مُنْذُ أَسْلَمَ عُمَرُ ‘ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সর্বদা শক্তিশালী ছিলাম’ (বুখারী হা/৩৬৮৪)। ওমর (রাঃ) যখন আততায়ীর দ্বারা আহত হন, তখন ইবনু আববাস (রাঃ) তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যখন আপনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন আপনার ইসলাম ছিল শক্তিশালী। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে ইসলামকে, আল্লাহর রাসূলকে ও তাঁর সাথীদেরকে বিজয়ী করেন’।[3]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৫০। ওমরের পরিবারের কোন এক ব্যক্তির সূত্রে ইবনু ইসহাক এটি বর্ণনা করেছেন, তার নাম উল্লেখ না করায় বর্ণনাটি যঈফ।

[2]. বুখারী হা/৩৮৬৪ ‘ওমরের ইসলাম গ্রহণ’ অনুচ্ছেদ।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, মুজাহিদ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, অতঃপর ওমর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বললেন,يَا رَسُولَ اللهِ أَلَسْنَا عَلَى الْحَقِّ إِنْ مِتْنَا وَإِنْ حَيِينَا؟ قَالَ: بَلَى وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّكُمْ لَعَلَى الْحَقِّ إِنْ مُتُّمْ وَإِنْ حَيِيتُمْ قَالَ: فَقُلْتُ: فَفِيمَ الِإِخْتِفَاءُ؟ وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَنُخْرُجَنَّ- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি হক-এর উপরে নই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যার হাতে আমার জীবন, তার কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই তোমরা সত্যের উপরে আছ। চাই তোমরা মৃত্যুবরণ কর অথবা জীবিত থাক’। তখন ওমর বললেন, তাহ’লে লুকিয়ে থাকার কি প্রয়োজন? যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তার কসম করে বলছি, অবশ্যই আমরা প্রকাশ্যে বের হব’।

অতঃপর দুই সারির মাথায় ওমর ও হামযার নেতৃত্বে মুসলমানগণ প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে মাসজিদুল হারামে উপস্থিত হ’লেন। ওমর (রাঃ) বলেন, এই দিন আমাকে ও হামযাকে মুসলমানদের মিছিলের পুরোভাগে দেখে কুরায়েশ নেতারা যত বেশী আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল, এমন আঘাত তারা কখনোই পায়নি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এদিনই আমাকে الْفَارُوقُ (হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী) উপাধি দান করেন’ (আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/৪০ পৃঃ; সনদ যঈফ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩০৬২; আর-রাহীক্ব ১০৫ পৃঃ)।

তবে তাঁর লকব যে ‘ফারূক্ব’ ছিল, তা তাঁর সম্পর্কে আবুবকর (রাঃ)-এর মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত (আলবানী, যিলালুল জান্নাহ হা/১১৫৩, সনদ ছহীহ)। ইবনু হাজার বলেন, ওমর (রাঃ)-এর লকব ছিল ‘ফারূক্ব’, এ বিষয়ে সকল বিদ্বান একমত। কিন্তু উক্ত লকব প্রথমে কে দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল (ছাঃ) প্রথম এই লকব দিয়েছিলেন। কেউ বলেছেন, আহলে কিতাবগণ। কেউ বলেছেন, জিব্রীল এটা দিয়েছিলেন’ (ফাৎহুল বারী ‘ওমরের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ হা/৩৬৭৯-এর পূর্বের আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

[3]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৫৭৯, হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৪৬৩, সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ ১৭৯ পৃঃ।