নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
গারানীক্ব কাহিনী قصة الغرانيق) রামাযান ৫ম নববী বর্ষ)

এটি একটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কাহিনী। যদিও প্রাচ্যবিদ ফুইক, মূর, ওয়াট প্রমুখদের কাছে এটি একটি লোভনীয় কাহিনী। ঘটনা এই যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা চত্বরে সরবে সূরা নাজম পাঠ করেন। সূরার শেষে তিনি সিজদা করেন। তখন উপস্থিত মুসলিম-মুশরিক সবাই সিজদায় পড়ে যায়। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল প্রথম সূরা যাতে সিজদা করা হয় (অর্থাৎ সিজদায়ে তেলাওয়াত)। আমি দেখলাম যে, একজন ব্যক্তি এক মুষ্টি মাটি নিয়ে তাতে সিজদা করল এবং বলল, আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আমি তাকে পরে কাফের অবস্থায় (বদর যুদ্ধে) নিহত হ’তে দেখেছি। ঐ ব্যক্তি হ’ল উমাইয়া বিন খালাফ।[1] কাফিরদের সিজদা করার উক্ত ঘটনা সত্য এবং এটি ছিল নিঃসন্দেহে সূরা নাজমের অশ্রুতপূর্ব আসমানী খবর ও অনন্য সাধারণ ভাষালংকারের অপূর্ব দ্যোতনার বাস্তব ফলশ্রুতি। ভাষাগর্বী নেতারা যার সামনে অবচেতনভাবে মুহ্যমান হয়ে পড়ে ও নবীর সাথে সাথে নিজেরাও সিজদায় পড়ে যায়। কারণ উক্ত সূরার শেষ আয়াতটি ছিল, فَاسْجُدُوْا لِلَّهِ وَاعْبُدُوْا ‘অতএব তোমরা আল্লাহর জন্য সিজদা কর ও তাঁর ইবাদত কর’ (নাজম ৫৩/৬২)।

উক্ত ঘটনায় কাফের নেতারা নিজেদের মুখরক্ষার জন্য গারানীক্ব কাহিনী ছড়িয়ে দেয়। আর তা হ’ল এই যে, সূরার ১৯ ও ২০ আয়াতে বর্ণিত, أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ وَالْعُزَّى- وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ ‘লাত’ ও ‘উযযা’ সম্বন্ধে’? ‘এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?’ উক্ত আয়াতদ্বয়ের পরে তারা জুড়ে দেয়, تِلْكَ الْغَرَانِيقُ الْعُلَى + وَإِنَّ شَفَاعَتَهُنَّ لَتُرْتَجَى ‘ঐগুলি হ’ল মহান শ্বেত-শুভ্র উপাস্য। আর তাদের সুফারিশ অবশ্যই কাম্য’। এই বাক্যটি প্রচার করে তারা বলে, ইতিপূর্বে মুহাম্মাদ কখনো আমাদের উপাস্যদের ভাল বলেনি, আজ বলেছে। সেকারণ তারা খুশী হয়ে তাঁর সাথে সিজদায় পড়ে যায়’।[2]

الْغَرَانِيقُ একবচনে غُرْنوق، غِرْنيق، غُرَانِق অর্থ ‘বক জাতীয় এক ধরনের পানিতে চরা সাদা পাখি’। ফর্সা সুন্দর যুবককে شَابٌّ غُرَانِقٌ বলা হয়। কাফেরদের ধারণা ছিল যে, সাদা পোষাকধারী মানুষের বেশ ধরে কোন জিন বা ফেরেশতা এসে মুহাম্মাদকে কুরআনের আয়াত নাযিল করত (কুরতুবী) এবং তাঁকে তাঁর পিতৃধর্ম থেকে বিচ্যুত করত। ফেরেশতাদেরকে তারা আল্লাহর কন্যা বলত ও তাদের উপাস্য মানত (ইসরা ১৭/৪০)।

কথাটি হাবশায় হিজরতকারীদের কানে পৌঁছে যায়। ফলে তাদের ধারণা হয় যে, মুশরিকদের সাথে আপোষ হয়ে গেছে। এখন থেকে মুসলমানরা মক্কায় নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ওছমান বিন মাযঊন (রাঃ) সহ অনেকে মক্কায় ফিরে আসেন।

অথচ মূল কারণ ছিল ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব-এর ইসলাম কবুলের ঘটনা এবং তার ফলে মুসলমানদের প্রকাশ্যে কা‘বায় ছালাত আদায়ের খবর। এতেই হাবশার মুহাজির মুসলমানেরা ধারণা করেছিল যে, মক্কা এখন নিরাপদ হয়ে গেছে’।[3]

উল্লেখ্য যে, উচ্চ অলংকার সমৃদ্ধ কোন বক্তব্য বা কবিতা শুনে তার প্রতি সম্মানের সিজদা করা জাহেলী যুগে ও ইসলামী যুগে আরবদের রীতি ছিল। যেমন বিখ্যাত উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব (৩৮-১১০ হি.) জাহেলী কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ্র (মৃ. ৪১ হি.) দীর্ঘ কবিতা মু‘আল্লাক্বার ৮ম লাইনটি পড়ে সিজদায় পড়ে গিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, أَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ سَجْدَةَ الْقُرْآنِ وَأَنَا أَعْلَمُ سَجْدَةَ الشِّعْرِ ‘তোমরা কুরআনের সিজদা জানো। আর আমি কবিতার সিজদা ভাল করে জানি’। লাইনটি ছিল, وَجَلاَ السُّيُوْلُ عَنِ الطُّلُوْلِ كَأَنَّهَا + زُبُرٌ تُجِدُّ مُتُوْنَهَا اَقْلاَمُهَا অর্থ ‘বন্যাস্রোত প্রেয়সীর পরিত্যক্ত ভিটার চিহ্নসমূহ প্রকাশ করে দিয়েছে। যেন সেগুলি বইয়ের পৃষ্ঠা। কলমসমূহ যার হরফগুলিকে নতুন করে দিয়েছে’।[4]

[1]. আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ; বুখারী হা/৪৮৬৩; মুসলিম হা/৫৭৬; মিশকাত হা/১০৩৭। বুখারী হা/১০৭১ (মিশকাত হা/১০২৩)-এ ‘জিন ও ইনসান সবাই সিজদা করে’ বলা হয়েছে। যার রাবী হলেন ইবনু আববাস (জন্ম : ১১ নববী বর্ষ এবং মৃ. ৬৮ হি.)। কিন্তু ইবনু মাসঊদ (মৃ. ৩২ হি.) বর্ণিত বুখারী (হা/৪৮৬৩) এবং মুসলিম (হা/৫৭৬) বর্ণিত হাদীছে কেবল ‘সেখানে উপস্থিত মুস©র্লম ও মুশরিকদের’ কথা এসেছে। দু’টি হাদীছের মধ্যে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা তিনি ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

[2]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হজ্জ ৫২ আয়াত।

[3]. বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হাজ্জ ৫২ আয়াত দীর্ঘ টীকা ও ব্যাখ্যাসহ; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৭১; মা শা-‘আ পৃঃ ৬১-৬২।

[4]. আবুল ফারজ ইস্ফাহানী, আল-আগানী (বৈরূত : ২য় সংস্করণ, সাল বিহীন) ১৫/৩৬০ পৃঃ।

কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ আল-‘আমেরী বীরত্বে ও দানশীলতায় আরবের প্রসিদ্ধ হাওয়াযেন গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরবী কাব্যে নক্ষত্র তুল্য বিবেচিত হ’তেন। ১১৬ বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং ৪১ হিজরীতে আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে ১৪৫ অথবা ১৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট তার শ্রেষ্ঠ কবিতা ছিল أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مَا خَلاَ اللهَ بَاطِلُ। উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব তাঁর কবিতাংশ পাঠে সিজদায় পড়ে যান। কুরআন পাঠের পর তিনি কাব্য রচনা পরিত্যাগ করেন। কথিত আছে যে, কবিদের উপর ইসলামের প্রভাব যাচাই করার জন্য ওমর ফারূক (রাঃ) তাদের নিকট থেকে নতুন কবিতা আহবান করেন। তখন লাবীদ সূরা বাক্বারাহ্র কয়েকটি আয়াত লিখে পাঠান এবং তার নীচে তিনি লেখেন, هذه الشمس قد اطفأت قناديل الشاعرية مطلقا ‘এই সূর্য কাব্য রচনার বাতিসমূহ একেবারেই নিভিয়ে দিয়েছে’। তবে অনেকে ধারণা করেন যে, ইসলাম কবুলের পর তিনি মাত্র এক লাইন কবিতা বলেছিলেন।- الحمد لله الذى إذلم يأتنى أجلى + حتى لبست من الإسلام سربلا- ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যে, মৃত্যু আমার নিকটে আসেনি। যতক্ষণ না আমি ইসলামের পোষাক পরিধান করেছি’। এজন্যেই তাঁকে জাহেলী কবি বলা হয়। যদিও তিনি ইসলাম কবুলের পর বহুদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, আরবদের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তিনি বলেন, ‘পথভ্রষ্ট রাজা’ (الملك الضليل) ইমরাউল ক্বায়েস। তারপর কে? তিনি বলেন, বনু বকরের নিহত বালক তুরফাহ। অতঃপর কে? তিনি বলেন, এই লাঠিধারী ব্যক্তি। অর্থাৎ তিনি নিজে’। তিনি নিজের দীর্ঘ জীবন সম্পর্কে বলেন, ولقد ستمت من الحياة وطولها + وسؤال هذا الناس كيف لبيد؟ ‘আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি জীবন ও তার দীর্ঘতার ব্যাপারে এবং মানুষের এই প্রশ্ন থেকে যে, লাবীদ কেমন ছিল’? =মাওলানা মুহিউদ্দীন, ঢাকা, সাব‘আ মু‘আল্লাক্বাত আরবী-উর্দূ (ঢাকা, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, তাবি) ১৩৬ পৃঃ; আহমাদ হাসান আয-যাইয়াত, তারীখুল আদাবিল ‘আরাবী (২৪তম সংস্করণ) ৬৮-৬৯ পৃঃ।