‘অহি’ (الْوَحْىُ) অর্থ প্রত্যাদেশ এবং ‘ইলহাম’ (الْإِلْهَامُ) অর্থ প্রক্ষেপণ। ‘অহি’ আল্লাহর পক্ষ হ’তে নবীগণের নিকটে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ‘ইলহাম’ আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোন ব্যক্তির প্রতি হ’তে পারে। আল্লাহ মানুষের অন্তরে ভাল-মন্দ দু’টিই ‘ইলহাম’ করে থাকেন (আশ-শামস ৯১/৮)। আভিধানিক অর্থে ‘অহি’ অনেক সময় ‘ইলহাম’ অর্থে আসে। যেমন মূসার মা, খিযির, ঈসার মা ও নানী প্রমুখ নির্বাচিত বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অহি করেছেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।[1] কিন্তু তা নবুঅতের অহি ছিলনা। অনুরূপভাবে জিন বা মানুষরূপী শয়তান যখন পরস্পরকে চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি দিয়ে পথভ্রষ্ট করে, ওটাকেও কুরআনে ‘অহি’ বলা হয়েছে (আন‘আম ৬/১১২) আভিধানিক অর্থে। তবে পারিভাষিক অর্থে ‘অহি’ বলতে কেবল তাকেই বলা হয়, যা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তাঁর মনোনীত নবীগণের নিকট ফেরেশতা জিব্রীলের মাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।
উল্লেখ্য যে, ইলহাম ও অহি এক নয়। প্রথমটি যেকোন ব্যক্তির মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু অহি কেবল নবী-রাসূলদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। নবী হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিকতা শর্ত নয়। বরং আল্লাহর মনোনয়ন শর্ত। যদিও নবীগণ আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ নমুনা হয়ে থাকেন। অন্যদের আধ্যাত্মিকতায় শয়তানী খোশ-খেয়াল সম্পৃক্ত হ’তে পারে। যেমন বহু কাফের-মুশরিক যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে দেখা যায়।
এখানে এসে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের পদস্খলন ঘটে গেছে। তাঁরা ইলহাম ও অহীকে একত্রে গুলিয়ে ফেলেছেন। যেমন মাওলানা আব্দুর রহীম (১৯১৮-১৯৮৭ খৃ.) বলেন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনেকাংশেই এক ধরনের ‘ইলহাম’-এর সাহায্যে হয়ে থাকে। এ ইলহাম বা অহীরই বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই সেইসব লোকের জীবনেও, যাঁদের আমরা বলি নবী ও রাসূল।... বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রতি বিশ্বলোক ও বিশ্ব মানবতার সমস্যার সঠিক সমাধান অনুরূপ পদ্ধতিতে ও আকস্মিকভাবে মক্কার এক পর্বত গুহায় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। তাঁকে নির্দেশ করা হয় : ‘পড় তোমার সেই রবের নামে...। এই দু’টি ক্ষেত্রের জন্যই সেই একই মহাসত্যের নিকট থেকে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ আসার এ ঘটনাবলী অত্যন্ত বিষ্ময়কর হ’লেও এতে পারস্পরিক বৈপরিত্য বলতে কিছুই নেই’।[2]
আমরা বলব, এ যুগের আইনস্টাইন বলে খ্যাত স্টিফেন হকিং (জন্ম : ১৯৪২)[3] যিনি বলেন, ঈশ্বর ও পরকাল বলে কিছু নেই, তিনিও কি তাহ’লে আল্লাহর অহী পেয়ে এগুলো বলছেন, নাকি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এগুলি বলছেন? নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানী ও নবী কখনোই এক নন। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও চিন্তাবিদ মানুষ চিরকাল থাকবেন। কিন্তু তারা কখনোই নবী হবেন না। আর নবুঅতের সিলসিলা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত এসে সমাপ্ত হয়ে গেছে।
[2]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী ৫ম প্রকাশ ১৯৯৮) লেখকের ‘ভূমিকা’ জুলাই ১৯৭৫।
[3]. Stephen William Hawking একজন বৃটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। যিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে Centre for Theoretical Cosmology-এর প্রধান গবেষণা পরিচালক। ২১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি মাথা ব্যতীত সর্বাঙ্গ প্যারালাইজড অবস্থায় শয্যাশায়ী আছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৩ বছর।