নবীদের কাহিনী ২৪. হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

حَوارِىّ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। অর্থ দেওয়ালে চুনকাম করার জন্য ধবধবে সাদা চুন। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হ’ত। কেউ বলেছেন যে, নাবাত্বী ভাষায় হাওয়ারী অর্থ ধোপা (القصار)। ঈসার খাঁটি অনুসারীগণ ধোপা ছিলেন, যারা কাপড় ধৌত করতেন। পরে তারা ঐ নামেই পরিচিত হন। অথবা এজন্য তাদের উপাধি ‘হাওয়ারী’ ছিল যে, তারা সর্বদা সাদা পোষাক পরিধান করতেন। কোন কোন তাফসীরবিদ তাঁদের সংখ্যা ১২ জন বলেছেন। ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে যেমন ‘হাওয়ারী’ বলা হয়; শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে তেমনি ‘ছাহাবী’ বলা হয়। আভিধানিক অর্থে ছাহাবী অর্থ সাথী বা সহচর হ’লেও পারিভাষিক অর্থে রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্যদের সাথীগণকে ‘ছাহাবী’ বলা হয় না। কেননা এই পরিভাষাটি কেবল ঐসকল পবিত্রাত্মা ব্যক্তিগণের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন কোন সময় শুধু ‘সাহায্যকারী’ বা আন্তরিক বন্ধু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বলেন, ‘প্রত্যেক নবীর একজন ‘হাওয়ারী’ অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে। তেমনি আমার ‘হাওয়ারী’ হ’ল যুবায়ের’।[8]

ঈসা (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলের স্বার্থবাদী নেতাদের বিরোধিতা ও চক্রান্ত বুঝতে পারলেন, তখন নিজের একনিষ্ঠ সাথীদের বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন এবং সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের ভক্ত ও অনুসারী কারা? একথাটিই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্তভাবে-

فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللهِ آمَنَّا بِاللهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ- رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِيْنَ- (آل عمران ৫২-৫৩)-

‘যখন ঈসা বনু ইস্রাঈলের কুফরী অনুধাবণ করলেন, তখন বললেন, কারা আছ আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীগণ বলল, আমরাই আল্লাহর পথে আপনার সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষ্য থাকুন যে আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সেই সব বিষয়ের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যা তুমি নাযিল করেছ এবং আমরা রাসূলের অনুসারী হয়েছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নাও’ (আলে ইমরান ৩/৫২-৫৩)

অন্যত্র এসেছে এভাবে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُوْنُوْا أَنصَارَ اللهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللهِ فَآَمَنَت طَّائِفَةٌ مِّنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَت طَّائِفَةٌ، فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَى عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا ظَاهِرِينَ- (الصف ১৪)-

‘হে বিশ্বাসী গণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। যেমন মারিয়াম-তনয় ঈসা হাওয়ারীদের বলেছিল, কে আছ আল্লাহর জন্য আমাকে সাহায্যকারী? হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের একটি দল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং অন্যদল প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর আমরা বিশ্বাসীদের সাহায্য করলাম তাদের শত্রুদের উপরে। ফলে তারা বিজয়ী হ’ল’ (ছফ ৬১/১৪)

অবশ্য হাওয়ারীদের এই আনুগত্য প্রকাশের ক্ষমতা আল্লাহ দান করেছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যেমন তিনি বলেন,

وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّيْنَ أَنْ آمِنُوْا بِيْ وَبِرَسُوْلِيْ قَالُوْا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُوْنَ- (المائدة ১১১)-

‘আর যখন আমি হাওয়ারীদের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’ (মায়েদাহ ৫/১১১)। এখানে হাওয়ারীদের নিকট ‘অহি’ করা অর্থ তাদের হৃদয়ে বিষয়টি সঞ্চার করা বা জাগ্রত করা। এটা নবুঅতের ‘অহি’ নয়।

বস্ত্ততঃ শত্রুদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারীগণের প্রতি উপরোক্ত আহবান জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বার জন ভক্ত অনুসারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। অতঃপর তারাই ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পরে ঈসায়ী ধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে বহু ভেজাল ঢুকে পড়ে এবং তারা বহু দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আজও বিশ্ব খৃষ্টান সমাজ রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট নামে প্রধান দু’দলে বিভক্ত। যাদের রয়েছে অসংখ্য উপদল। আর এরা সব দলই ভ্রান্ত।

ইমাম বাগাভী (রহঃ) সূরা ছফ ১৪ আয়াতের তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পর খৃষ্টান জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল তাকে ‘আল্লাহ’ বলে। একদল তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে এবং একদল তাকে ‘আল্লাহর দাস ও রাসূল’ বলে। প্রত্যেক দলের অনুসারী দল ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি মুমিনদের দলকে সমর্থন দেন। ফলে তারাই দলীলের ভিত্তিতে জয়লাভ করে। বলা বাহুল্য মুমিন ঈসায়ীগণ সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ‘বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ সাহায্য করলেন ও তারা বিজয়ী হ’ল’ বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে। যারা ঈসা ও মুহাম্মাদ উভয় নবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয়ী হয়েছেন।

[8]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬১০১ ‘মানক্বিব’ অধ্যায় ৯ অনুচ্ছেদ।