(ক) দাঊদ (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক শক্ত ও ঘন পদার্থ লোহাকে নরম ও সুউচ্চ পর্বতমালাকে অনুগত করে দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সুলায়মান (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ শক্ত তামাকে গলানো এবং বায়ু, জিন ইত্যাদি এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্ত্তকে অনুগত করে দিয়েছিলেন, যা চোখেও দেখা যায় না। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর শক্তি বড়-ছোট সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত।
(খ) এখানে আরেকটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর তাক্বওয়াশীল অনুগত বান্দারা আল্লাহর হুকুমে বিশ্বচরাচরের সকল সৃষ্টির উপরে আধিপত্য করতে পারে এবং সবকিছুকে বশীভূত করে তা থেকে খিদমত নিতে পারে।
৩. জিনকে তাঁর অধীন করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمِنَ الْجِنِّ مَن يَّعْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِإِذْنِ رَبِّهِ...(سبا ১২)- ‘আর জিনের মধ্যে কিছুসংখ্যক তার (সুলায়মানের) সম্মুখে কাজ করত তার পালনকর্তার (আল্লাহর) আদেশে...’ (সাবা ৩৪/১২)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَمِنَ الشَّيَاطِيْنِ مَنْ يَّغُوْصُوْنَ لَهُ وَيَعْمَلُوْنَ عَمَلاً دُوْنَ ذَلِكَ وَكُنَّا لَهُمْ حَافِظِيْنَ-(الأنبياء ৮২)-
‘এবং আমরা তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরও কাজ করত। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম’ (আম্বিয়া ২১/৮২)।
অন্যত্র বলা হয়েছে,
وَالشَّيَاطِيْنَ كُلَّ بَنَّاءٍ وَّغَوَّاصٍ- وَآخَرِيْنَ مُقَرَّنِيْنَ فِي الْأَصْفَادِ- (ص ৩৭-৩৮)-
‘আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৭-৩৮)।
বস্ততঃ জিনেরা সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত এবং সুলায়মানের হুকুমে নির্মাণ কাজ সহ যেকোন কাজ করার জন্য সদা প্রস্তত থাকত। ঈমানদার জিনেরা তো ছওয়াবের নিয়তে স্বেচ্ছায় আনুগত্য করত। কিন্তু দুষ্ট জিনগুলো বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। এই অদৃশ্য শৃংখল কেমন ছিল, তা কল্পনা করার দরকার নেই। আদেশ পালনে সদাপ্রস্ত্তত থাকাটাও এক প্রকার শৃংখলবদ্ধ থাকা বৈ কি!
‘শয়তান’ হচ্ছে আগুন দ্বারা সৃষ্ট বুদ্ধি ও চেতনা সম্পন্ন এক প্রকার সূক্ষ্ম দেহধারী জীব। জিনের মধ্যকার অবাধ্য ও কাফির জিনগুলিকেই মূলতঃ ‘শয়তান’ নামে অভিহিত করা হয়। আয়াতে ‘শৃংখলবদ্ধ’ কথাটি এদের জন্যেই বলা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এরা সুলায়মানের কোন ক্ষতি করতে পারত না। বরং সর্বদা তাঁর হুকুম পালনের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। তাদের বিভিন্ন কাজের মধ্যে আল্লাহ নিজেই কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন,
يَعْمَلُوْنَ لَهُ مَا يَشَآءُ مِنْ مَّحَارِيْبَ وَتَمَاثِيْلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُوْرٍ رَّاسِيَاتٍ... (سبا ১৩)-
‘তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাষ্কর্য, হাউয সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লীর উপরে স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত...’ (সাবা ৩৪/১৩)। উল্লেখ্য যে, تماثيل তথা ভাষ্কর্য কিংবা চিত্র ও প্রতিকৃতি অংকন বা স্থাপন যদি গাছ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের হয়, তাহ’লে ইসলামে তা জায়েয রয়েছে। কিন্তু যদি তা প্রাণীদেহের হয়, তবে তা নিষিদ্ধ।
৪. পক্ষীকুলকে সুলায়মানের অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَوَرِثَ سُلَيْمَانُ دَاوُودَ وَقَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ عُلِّمْنَا مَنطِقَ الطَّيْرِ وَأُوتِينَا مِن كُلِّ شَيْءٍ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْفَضْلُ الْمُبِيْنُ ু (نمل ১৬)-
‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল এবং বলেছিল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’ (নমল ২৭/১৬)।
পক্ষীকুল তাঁর হুকুমে বিভিন্ন কাজ করত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্র তিনি হুদহুদ পাখির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী বিলক্বীসের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এ ঘটনা পরে বিবৃত হবে।
৫. পিপীলিকার ভাষাও তিনি বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
حَتَّى إِذَا أَتَوْا عَلَى وَادِي النَّمْلِ قَالَتْ نَمْلَةٌ يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوْا مَسَاكِنَكُمْ لاَ يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ- فَتَبَسَّمَ ضَاحِكاً مِّن قَوْلِهَا...- (نمل ১৮-১৯)-
‘অবশেষে সুলায়মান তার সৈন্যদল নিয়ে পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল। তখন পিপীলিকা (নেতা) বলল, হে পিপীলিকা দল! তোমরা স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে’। ‘তার এই কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল... (নমল ২৭/১৮-১৯)।
৬. তাঁকে এমন সাম্রাজ্য দান করা হয়েছিল, যা পৃথিবীতে আর কাউকে দান করা হয়নি। এজন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَهَبْ لِيْ مُلْكاً لاَّ يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِّنْ بَعْدِيْ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ- (ص ৩৫)-
‘সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)।
উল্লেখ্য যে, পয়গম্বরগণের কোন দো‘আ আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে হয় না। সে হিসাবে হযরত সুলায়মান (আঃ) এ দো‘আটিও আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমেই করেছিলেন। কেবল ক্ষমতা লাভ এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর পিছনে আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করা এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কেননা আল্লাহ জানতেন যে, রাজত্ব লাভের পর সুলায়মান তাওহীদ ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করবেন এবং তিনি কখনোই অহংকারের বশীভূত হবেন না। তাই তাঁকে এরূপ দো‘আর অনুমতি দেওয়া হয় এবং সে দো‘আ সর্বাংশে কবুল হয়।
ইসলামে নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা চেয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ। আল্লামা জুবাঈ বলেন, আল্লাহর অনুমতিক্রমেই তিনি এটা চেয়েছিলেন। কেননা নবীগণ আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কোন সুফারিশ করতে পারেন না। তাছাড়া এটা বলাও সঙ্গত হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বর্তমানে (জাদু দ্বারা বিপর্যস্ত এই দেশে) তুমি ব্যতীত দ্বীনের জন্য কল্যাণকর এবং যথার্থ শাসনের যোগ্যতা অন্য কারু মধ্যে নেই। অতএব তুমি প্রার্থনা করলে আমি তোমাকে তা দান করব।’ সেমতে তিনি দো‘আ করেন ও আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন।[4]
৭. প্রাপ্ত অনুগ্রহরাজির হিসাব রাখা বা না রাখার অনুমতি প্রদান। আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব লাভের দো‘আ কবুল করার পরে তার প্রতি বায়ু, জিন, পক্ষীকুল ও জীব-জন্তু সমূহকে অনুগত করে দেন। অতঃপর বলেন,
هَذَا عَطَاؤُنَا فَامْنُنْ أَوْ أَمْسِكْ بِغَيْرِ حِسَابٍ، وَإِنَّ لَهُ عِنْدَنَا لَزُلْفَى وَحُسْنَ مَآبٍ- (ص ৩৯-৪০)-
‘এসবই আমার অনুগ্রহ। অতএব এগুলো তুমি কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও, তার কোন হিসাব দিতে হবে না’। ‘নিশ্চয়ই তার (সুলায়মানের) জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্য ও শুভ পরিণতি’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৯-৪০)।
বস্ততঃ এটি ছিল সুলায়মানের আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার প্রতি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রদত্ত একপ্রকার সনদপত্র। পৃথিবীর কোন ব্যক্তির জন্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন সত্যায়নপত্র নাযিল হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ এই মহান নবী সম্পর্কে ইহুদী-নাছারা বিদ্বানরা বাজে কথা রটনা করে থাকে।