আর এতে থাকবে আলোচ্য বিষয়ের উপর আলোকপাতকারী বক্তব্য। প্রিয় পাঠকমন্ডলী! সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা চক্রে গুরুত্বপূর্ণ বহু প্রতিবেদন আমাদের দৃষ্টিতে গত হয়েছে। যে মানুষ নিজের পরিত্রাণ ও মুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী, তার জন্য আবশ্যক, প্রাচীন বিষয় উম্মতের সলফে সালেহর তরীকা মজবুত সহকারে ধারণ করে থাকার যে নির্দেশসমূহ জানা হল, তা পালন করা। মহান আল্লাহ বলেছেন,

فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

“সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে।” (কাহফঃ ১১০)

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا

“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (আহযাব : ২১)।

ইতিপূর্বে ইমামগণ থেকে সলফে সালেহর তরীকা অবলম্বনের প্রতি উৎসাহদান, উদ্বুদ্ধকরণ ও আদেশ দানের বিভিন্ন উদ্ধৃতি উল্লিখিত হয়েছে, এ স্থলে আমি অতিরিক্ত আরো কিছু আলোময় ও উজ্জ্বলকারী বাণী উল্লেখ করব। যা দিয়ে উপদেশ দেব। আর উপদেশ মু'মিনদেরকে উপকত করে। তা হল নিম্নরূপঃ

১। উমার বিন আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ)র একজন গভর্নর তাকে খেয়ালখুশি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তার উত্তরে লিখেছিলেন, 'অতঃপর বলি যে, আমি তোমাকে অসিয়ত করছি, তুমি আল্লাহ-ভীতি রাখবে, তার ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে, তাঁর। রীতি ও তাঁর রসূল (সা.)-এর সুন্নাহর অনুসরণ করবে এবং তাঁর পরবর্তীকালে যেখানে তার সুন্নত প্রচলিত রয়েছে এবং তা সকলের জন্য যথেষ্ট, সেখানে নব উদ্ভাবনকারীরা যা উদ্ভাবন করেছে, তা বর্জন করবে।

সুতরাং তুমি সুন্নাহ অবলম্বন কর। কারণ আল্লাহর হুকুমে তা তোমার জন্য বাঁচার অসীলা।

জেনে রেখো, লোকে তখনই বিদআত রচনা করে, যখন তার পূর্বে কোন এমন বিষয় অতীত হয়ে যায়, যা তার দলীল ও উপদেশ হয়। পরন্তু সুন্নাহ তিনি বিধিবদ্ধ করেছেন, যিনি জেনেছেন তার বিপরীত যে ত্রুটি, পদস্থলন, বোকামি ও অতিরিক্ত গভীর ভাবনার বিষয় থাকে। সুতরাং তুমি তোমার নিজের জন্য তাই নিয়ে তুষ্ট হও, যা নিয়ে (পূর্ববর্তী) সম্প্রদায় নিজেদের জন্য তুষ্ট ছিলেন। যেহেতু তারাই অগ্রণী এবং তারা সজ্ঞানে (থামার জায়গায়) থেমেছেন, সফল বা সমীক্ষক দৃষ্টির সাথে বিরত হয়েছেন। নিশ্চিতরূপে তাঁরাই রহস্য উদ্ঘাটনে বেশি সক্ষম ছিলেন। আর তাতে কোন মাহাত্ম থাকলে তারাই তার বেশি হকদার ছিলেন। অতএব যদি তাই হিদায়াত হয়, যার উপর তোমরা প্রতিষ্ঠিত আছ, তাহলে সে ব্যাপারে তোমরা তাদের।

অগ্রগামী হয়েছ। (অথচ তা অসম্ভব। আর যদি বল যে, যা নব উদ্ভাবিত হয়েছে, তা তাদের পর, তাহলে আসলে তা উদ্ভাবন করেছে। কেবল সেই লোক, যে তাদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করেছে। এবং তাদের অপেক্ষা নিজেকে প্রিয় মনে করেছে। পরন্তু তারা সে। বিষয়ে যে কথা বলেছেন, তা যথেষ্ট। তার যে বিবরণ তারা দিয়েছেন, তা সন্তোষজনক। তাদের নিমের ব্যক্তি শিথিলপন্থী এবং তাদের উর্ধের ব্যক্তি সংকীর্ণতা সৃষ্টিকারী। বহু সম্প্রদায় তাদের নিমে থেকে শিথিল হয়ে গেছে এবং অন্য বহু লোক তাদের উপরে উঠতে চেয়ে অতিরঞ্জন করেছে। আর তারা এরই মাঝামাঝিতে সরল হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত।[১]

২। ইমাম মুহাম্মাদ বিন মুসলিম যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদের উলামাগণের মধ্যে যারা বিগত হয়েছেন, তারা বলতেন,

সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরলে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আর ইলমকে শীঘ্রই তুলে নেওয়া হবে। বলা বাহুল্য, ইলম অবশিষ্ট থাকলে দ্বীন ও দুনিয়া কায়েম থাকবে। আর ইলম চলে গেলে সব কিছুই চলে যাবে।[২]

৩। ইমাম ইবনে হিব্বান (রাহিমাহুল্লাহ) সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, তার সুন্নাহর অবলম্বনে রয়েছে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা এবং ব্যাপক মর্যাদা। তার দীপমালা নির্বাপিত হয় না। তার দলীল ও হুজ্জত খন্ডন ও ব্যর্থ করা যায় না। যে তা অবলম্বন করে, সে রক্ষা পায় এবং যে তার বিরুদ্ধাচরণ করে, সে অনুতপ্ত হয়। যেহেতু তা হল সুরক্ষিত দুর্গ এবং মজবুত স্তম্ভ। যার মর্যাদা স্পষ্ট এবং রশি সুদৃঢ়। যে তা মজবুত সহকারে ধারণ করে, সে নেতৃত্ব লাভ করে এবং যে তার বিরুদ্ধাচরণ কামনা করে, সে ধ্বংস হয়ে যায়। তার প্রতি সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ বিলম্বে সৌভাগ্যবান হয় এবং সৃষ্টির মাঝে অবিলম্বে ঈর্ষিত হয়।[৩]

৪। ইমাম ইবনে কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) আম্মুল মুওয়াসবিসীন (গ্রন্থের ৪১পৃষ্ঠা)য় বলেছেন, সুন্নাহর অনুসরণে রয়েছে শরীয়ত সমর্থনের বর্কত, মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি, মর্যাদার উন্নতি, হৃদয়ের প্রশান্তি, দেহের স্থিরতা, শয়তানের লাঞ্ছনা এবং সরল পথের অনুসরণ।

৫। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আল্লাহর (নৈকট্য লাভের) সবচেয়ে নিকটবর্তী অসীলা হল সুন্নাহ অবলম্বন করা, প্রকাশ্যে ও গোপনে তার সাথে অবস্থান করা, আল্লাহর প্রতি সর্বদা মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা এবং কথায় ও কাজে একমাত্র তারই সন্তুষ্টি কামনা করা। এই তিন অসীলা ছাড়া কেউই আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়নি। আর এই তিনটি অসীলা থেকে অথবা তার একটি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া কেউ তার নৈকট্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি।”[৪]

৬। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, কুরআনের তফসীরে, হাদীসের অর্থে এবং হালাল-হারামের মন্তব্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ইলম হল তাই, যা সাহাবা, তাবেঈন, তাবা-তাবেঈন এবং ইসলামের অনুসরণীয় প্রসিদ্ধ। সর্বশেষ ইমামগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে। যাদের নাম আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি।

বলা বাহুল্য, এ মর্মে তাদের নিকট থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তা বোঝা, অনুধাবন করা এবং ফিকহী জ্ঞান লাভ করার সাথে তার সংরক্ষণ করা হল সকল ইলমের সেরা ইলম। আর তাদের পরবর্তীকালে (ইলমের মধ্যে) যে প্রশস্ততা প্রকাশ পেয়েছে, তার অধিকাংশে কোন মঙ্গল নেই। অবশ্য যদি তা তাদের বক্তব্য সম্পর্কিত কোন ব্যাখ্যা হয়, তাহলে তার কথা ভিন্ন। নচেৎ যা তাদের বক্তব্যের পরিপন্থী, তার অধিকাংশ বাতিল অথবা তাতে কোন উপকার নেই। তাদের পরবর্তীদের বক্তব্যে এমন কোন হকই পাওয়া যায় না, যা তাদের বক্তব্যে সংক্ষিপ্ত শব্দে ও বাক্যে পাওয়া যায় না।

আর তাদের পরবর্তীদের বক্তব্যে এমন কোন বাতিলও পাওয়া যায় না, যা তাদের বক্তব্যে তার বাতিল হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায় না। যে বোঝে ও চিন্তা-গবেষণা করে (সে তা অবশ্যই পেয়ে যায়)। পরন্তু তাঁদের বক্তব্যে পাওয়া যায় চমৎকার অর্থ ও সূক্ষ আপত্তি, যার প্রতি তাদের পরবর্তীরা পৌঁছতে পারে না এবং সে বিষয়ে তাদের অবগতিও নেই। তাই যে ব্যক্তি তাঁদের বক্তব্য থেকে ইলম গ্রহণ করে না, তার উক্ত সকল কল্যাণ হাতছাড়া হয়। এর সাথে সে তাদের পরবর্তীদের অনুসরণ করে অনেক বাতিলে এসে আপতিত হয়।

অবশ্য যে ব্যক্তি তাদের বক্তব্যসমূহ একত্রিত করার ইচ্ছা করবে, তার প্রয়োজন হবে সে সব বক্তব্যের শুদ্ধ-অশুদ্ধা জানার। আর তা সম্ভব হবে ‘আল-জারহু ওয়াত-তা’দীল’ এবং ‘আল-ইলাল ইলম অর্জনের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তির উক্ত ইলম সম্বন্ধে জ্ঞান রাখে না, সে যা উদ্ধত করছে তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না এবং তার নিকট হক-বাতিলের মাঝে তালগোল পেকে যাবে। বর্তমান যুগে অনুসরণীয় সলফদের বক্তব্য লেখা ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ, ইসহাক ও আবু উবাইদ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাদের। পরবর্তীকালে যা ঘটেছে, তার ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যেহেতু তাদের পরে বহু (বিদআত ও ফিতনার) ঘটনা ঘটেছে।[৫]

সুতরাং আল্লাহর কাছেই তার সুন্দর নামাবলী ও সুউচ্চ গুণাবলীর অসীলায় প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সকলকে সেই কাজের তওফীক দেন, যা তিনি ভালোবাসেন ও যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন। আমরা যেখানেই থাকি, সেখানেই যেন আমাদেরকে বৰ্কতপ্রাপ্ত রাখেন। আমাদেরকে ইসলাম ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। ফিতনা থেকে মুক্ত অবস্থায় আমাদের মৃত্যুদান করেন এবং তার নেক বান্দাগণের সাথে আমাদেরকে মিলিত করেন। নিশ্চয় তিনি অতি বড় দানশীল মহানুভব, সর্বশ্রোতা ও আহবানে সাড়াদানকারী।

وصلى الله وسلم وبارك على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، والحمد لله رب العالمين

[১]. আজুরীর আশ-শারীআহ ৪৮পৃঃ, ইবনে ওয়াযাহর আল-বিদাউ ওয়াননাহয়্যু আনহা ৭৪নং, সনদ সহীহ। অনুরূপ আছে আবু নুআইমের হিয়া (৫/৩৩৮)তে। আরো দ্রঃ শাহেবীর আল-ই'তিস্যাম ১/৫০

[২]. সুনান দারেমী ১/৪৪, সনদ সহীহ

[৩]. আল-ইহসান ১/ ১০২

[৪]. আল-ফাওয়াইদ ১০৮ পৃঃ

[৫]. ফাযুল ইলমিস সালাফি আলা ইলমিল খালাফ ৪০-৪২পৃঃ