১। তওহীদের সহিত শির্কের সংঘর্ষ প্রাচীন। এ সংঘর্ষ প্রথম শুরু হয় সেই রসূল (সা.) নুহ 21-এর যুগে যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করার এবং মূর্তিপূজা বর্জন করার প্রতি আহবান করেন। তাদের মাঝে সাড়ে নয়শত বছর অবস্থান করে তওহীদের দাওয়াত দিতে থাকলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবিধান ছিল -যেমন কুরআন উল্লেখ করে,

وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا * وَقَدْ أَضَلُّوا كَثِيرًا

অর্থাৎ, ওরা বলল, তোমরা তোমাদের দেব-দেবীকে পরিত্যাগ করো না; অদ, সুয়া, য়্যাগুস, য়্যাউক ও নাকে । ওরা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। (সূরা নূহ ২৩-২৪ আয়াত)

ইমাম বুখারী ইবনে আব্বাস এই আয়াতের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন যে, এগুলি নুহ সম্প্রদায়ের (৫টি) নেক লোকের নাম ছিল। যখন তারা পরলোক গমন করলেন, তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে কুমন্ত্রণা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করল যে, ওঁরা যে মজলিসে উপবেশন করতেন সে মজলিসে ওঁদের মুর্তি নির্মাণ করে সংস্থাপন কর এবং ওঁদের নাম অনুসারে প্রত্যেকের নাম রেখে দাও।” লোকেরা তাই করল। তখন তাদের পূজা করা হত না। কিন্তু যখন ঐ লোকেরা মারা গেল এবং ঐশী-জ্ঞান বিস্মৃত হল তখন ঐ মূর্তিসমূহের পূজা শুরু হয়ে গেল।

২। অতঃপর নূহ (আঃ)-এর পর আরো বহু রসূল এলেন। তারা স্ব-স্ব সম্প্রদায়কে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে এবং বাতিল মাবুদসমূহের ইবাদত বর্জন করতে আহবান করলেন যারা ইবাদতের যোগ্য ছিল না। শুনুন কুরআন কি বলছে। সে আপনাকে খবর দেবে--

وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ

অর্থাৎ, এবং আদ জাতির নিকট ওদের ভ্রাতা হূদকে প্রেরণ করেছিলাম। সে। বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন মাবুদ নেই। তোমরা কি সাবধান হবে না ?” (সূরা আ’রাফ ৬৫ আয়াত)

وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ

অর্থাৎ, এবং সামূদ জাতির প্রতি তাদের ভ্রাতা সালেহকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর; তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন উপাস্য নেই।” (সূরা হূদ ৬১ আয়াত)

وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ

অর্থাৎ, এবং মাদয়্যানবাসীদের নিকট তাদের ভ্রাতা শুআইবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন মাবুদ নেই।” (সূরা ৮৪ আয়াত)

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِّمَّا تَعْبُدُونَ * إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ

অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইব্রাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলেছিল, 'তোমরা যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই; সম্পর্ক আছে শুধু তারই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন। করবেন।' (সূরা যুখরুফ ২৬-২৭ আয়াত)

কিন্তু যুগে যুগে মুশরিকরা দ্বন্দ্ব, প্রতিবাদ এবং সর্বপ্রকার শক্তি ও সামর্থ ব্যয় করে সংঘর্ষ দ্বারা সকল আম্বিয়াগণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে।

৩। আমাদের প্রিয় রসূল (সা.) যিনি নবুয়তের পূর্বে আরবের নিকট সত্যবাদী বিশ্বস্ত বলে সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত ও তওহীদ বরণ এবং পিতৃপুরুষদের পূজ্যমান উপাস্যসমূহ বর্জন করতে আহবান করলেন, তখন সকলে তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততাকে ভুলে বসল। বরং উল্টো তাকে ‘যাদুকর মিথুক’ বলে অভিহিত করল। কুরআন তাদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে বলে,

وَعَجِبُوا أَن جَاءَهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ ۖ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ * أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, এরা আশ্চর্যান্বিত যে, এদেরই মধ্য হতে এদের নিকট একজন সতর্ককারী এল! এবং কাফেররা বলল, এ তো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী। এ কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে একটি মাত্র উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এ তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার!’ (সূরা স্বাদ ৪-৫ আয়াত)।

كَذَٰلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ * أَتَوَاصَوْا بِهِ ۚ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ

অর্থাৎ, এরূপে এদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রসূল (সা.) এসেছে, তখনই ওরা তাকে বলেছে, (তুমি তো) এক যাদুকর অথবা পাগল। ওরা কি একে অপরকে এ মন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুতঃ ওরা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। (সূরা যারিয়াত ৫২-৫৩ আয়াত)

এই তো তওহীদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে সকল রসূলের ভূমিকা এবং অপর পক্ষে তাদের মিথ্যায়নকারী ও অপবাদ আরোপকারী সম্প্রদায়দের এই ভূমিকা!

৪। আমাদের বর্তমান যুগে মুসলমান যদি মানুষকে সদাচরণ, সত্যবাদিতা ও আমানতদারী প্রভৃতির প্রতি দাওয়াত দেয়, তাহলে তার কোন বিরোধী দৃষ্ট হয়। কিন্তু যখন সে সেই তওহীদের প্রতি আহবান করে; যে তওহীদের প্রতি রসূলগণ আহবান করে গেছেন -আর তা হল একমাত্র আল্লাহকে ডাকা এবং তিনি ছাড়া আম্বিয়া, আওলিয়া যারা আল্লাহরই দাস তাদেরকে না ডাকা -তখন লোকে তার বিরোধিতা শুরু করে দেয়, তার নামে মিথ্যা অপবাদ রটায় এবং বলে, ও তো ওয়াহাবী!! আর এই বলে তার দাওয়াত থেকে মানুষকে বাধা। দান করে। এমন কি ওদের নিকট কোন এমন আয়াত পাঠ করা হয় যাতে তওহীদের উল্লেখ আছে, তবে তা শুনে ওদের কেউ কেউ বলে, 'এটা ওয়াহাবী আয়াত!!

অনুরূপ ওদের নিকট “যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহরই নিকট কর” এই হাদীস উপস্থাপন করা হয় তখন কিছু লোক বলে, 'এটা ওয়াহাবী হাদীস!’ নামাযী যদি নামাযে তার হাত দুটিকে বুকের উপর রাখে অথবা তাশাহহুদে তর্জনী হিলায় -যেমন রসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন -তাহলে লোকে তাকে দেখে (নাক সিটকে) বলবে, এতে ওয়াহাবী!’ সুতরাং ওয়াহাবী’ সেই তওহীদবাদী মুসলিমের এক প্রতীকরূপে পরিচিত হয়ে পড়েছে, যে কেবলমাত্র তার প্রভু ও প্রতিপালককেই ডাকে এবং তার নবী (সা.)র সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ করে। পরন্তু ওয়াহাবী’ ‘আল-ওয়াহহাব’ (মহাদাতা)-এর প্রতি সম্বদ্ধ; যা আল্লাহর পবিত্র নামাবলীর অন্যতম নাম। যিনি তওহীদবাদীকে তওহীদ দান করেছেন, যা আল্লাহর তরফ হতে তওহীদবাদীদের জন্য বৃহত্তম অনুগ্রহ ও দান।

৫। তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের জন্য জরুরী, ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর রসূলের কথা স্মরণ করে মনকে প্রবোধ দান করা, যাকে আল্লাহ বলেছিলেন,

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

অর্থাৎ, ওরা যা বলে, তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে ওদেরকে উপেক্ষা করে চল। (সূরা মুযযাম্মিল ১০ আয়াত)

فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا

অর্থাৎ, তোমার প্রতিপালকের ফায়সালার জন্য ধৈর্য ধারণ কর এবং ওদের মধ্যে পাপাচারী ও কাফেরদের আনুগত্য করো না। (সূরা দাহর ২৪ আয়াত)।

৬। সকল মুসলিমের উপর ওয়াজেব, তারা যেন তওহীদের দাওয়াতকে সাদরে গ্রহণ করে এবং তওহীদের প্রতি আহবানকারীকে ভালোবাসে। যেহেতু তওহীদ সাধারণভাবে সমস্ত রসূল (সা.)গণের এবং (বিশেষভাবে) আমাদের রসূল (সা.) মুহাম্মাদ এক-এর দাওয়াত। সুতরাং যে ব্যক্তি রসূল (সা.)-কে ভালোবাসে, সে । তওহীদের দাওয়াতকে ভালোবাসে এবং যে তওহীদকে ঘৃণা বাসে, সে আসলে রসূল (সা.)-কেও ঘৃণা বাসে।।