লোকেরা প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকেই ওয়াহাবী’ বলে অভিহিত করে থাকে, যে ব্যক্তি তাদের প্রথা ও অভ্যাস, বিশ্বাস ও বিদআতের বিরোধিতা করে যদিও তাদের ঐ সকল বিশ্বাস অমূলক ও ভ্রষ্ট; যা কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস সমুহের পরিপন্থী। বিশেষ করে তওহীদের কথা বললে এবং অন্যান্যকে ছেড়ে কেবল একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে নির্দেশ দিলে তারা ঐ খেতাব দিয়ে থাকে।

একদা এক আলেমের নিকট ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’ গ্রন্থ হতে ইবনে আব্বাসের এই হাদীস পড়েছিলাম; নবী (সা.) বলেন, “যখন চাইবে, তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, এবং তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।) নবীর ব্যাখ্যা আমার বড় পছন্দ হল; তিনি বলেন, '--- অতঃপর যে প্রয়োজন মানুষ ভিক্ষা করে তা পূরণ করার ক্ষমতা যদি সৃষ্টির হাতে না থাকে, যেমন সুপথ (হেদায়াত) ও ইলম (জ্ঞান) প্রার্থনা, আরোগ্য ও নিরাপত্তা ভিক্ষা ইত্যাদি, তাহলে তা প্রতিপালকের নিকটই চাইবে। পক্ষান্তরে সৃষ্টির নিকট চাওয়া এবং তাদের উপর ভরসা করা নিন্দনীয়।

অতঃপর আমি ঐ মওলানাকে বললাম, 'এই হাদীস এবং এর ব্যাখ্যা গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা অবৈধ হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। তিনি আমাকে বললেন, 'বরং (গায়রুল্লাহর নিকটেও সাহায্য ভিক্ষা করা) বৈধ। আমি বললাম, আপনার দলীল কি? এতে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে উচ্চ কণ্ঠে। বললেন, 'আমার ফুফু বলেন, “হে (বাবা) শায়খ সা’দ সাহেব!’ (অথচ তিনি তার মসজিদে সমাধিস্ত, ফুফু তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।) আমি তাকে বলি, ফুফুজান! (বাবা) শায়খ সা’দ সাহেব কি আপনার উপকার করতে পারবেন? ফুফু বলেন, 'আমি উনার নিকট প্রার্থনা করি। উনি এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি মধ্যস্থতা করেন, যাতে তিনি আমাকে রোগমুক্ত করে দেন!! আমি শায়েখকে বললাম, আপনি একজন আলেম মানুষ! বই পঠন-পাঠনে বয়স অতিবাহিত করে ফেলেছেন, তা সত্ত্বেও এসব কিছুর পরে আপনি আপনার অজ্ঞ ফুফুর নিকট আকীদাহ গ্রহণ করেছেন?!’ তখন তিনি আমাকে বললেন, 'তোমার নিকট ওয়াহাবী চিন্তাধারা আছে। তুমি ওমরা করতে যাও, আর ওয়াহাবী বই পুস্তক বয়ে নিয়ে আস!

আমি অবশ্য ওয়াহাবী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে হুজুরদের মুখে বহুবার বলতে শুনেছি। হুজুররা তাদের সম্পর্কে বলেন, ওয়াহাবীরা সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে, ওরা আওলিয়া এবং তাদের কারামতকে বিশ্বাস করে না,

রসূলের প্রতি ওদের মহব্বত নেই’ ইত্যাদি মিথ্যা অপবাদ! তখন আমি মনে মনে বলতাম, ওয়াহাবীরা যদি একমাত্র আল্লাহর নিকটেই সাহায্য ভিক্ষা করাতে এবং আরোগ্যদাতা একমাত্র আল্লাহ -এই কথাতে বিশ্বাসী হন, তাহলে তাঁদের সম্পর্কে পরিচয় লাভ করা আমার একান্ত জরুরী। সে জামাআত কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সকলে বলল, ওদের এক নির্দিষ্ট স্থান আছে, যেখানে ওরা প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জমায়েত হয়ে তফসীর, হাদীস ও ফিকহ অধ্যয়ন করে।

আমি আমার ছেলেদেরকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি শিক্ষিত যুবককে সাথে করে তাদের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। এক বৃহৎ কক্ষে প্রবেশ করে দর্সের অপেক্ষায় বসলাম। ক্ষণেক পরেই এক বয়স্ক শায়খ কক্ষে প্রবেশ করতেই আমাদেরকে সালাম দিলেন এবং তার ডান দিকে হতে শুরু করে সকলের সাথে মুসাফাহা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁর বসার স্থানে বসলেন। তার জন্য কেউই উঠে দণ্ডায়মান হয়নি। আমি মনে মনে বললাম, “ইনি তো বড় বিনয়ী শায়খ, দন্ডায়মান হওয়া (কিয়াম) পছন্দ করেন না বুঝি।” অতঃপরঃ

إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفر

বলে তিনি তার দর্স শুরু করলেন। খুতবাটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন, যে খুতবা রসূল ধ্র পাঠ করে তাঁর ভাষণ ও দর্স আরম্ভ করতেন। অতঃপর আরবী ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। হাদীস উল্লেখ করলে তার শুদ্ধঅশুদ্ধতা এবং বর্ণনাকারীর অবস্থা বর্ণনা করেন। নবী (সা.) এর নাম এলেই তাঁর উপর দরূদ পাঠ করেন। পরিশেষে কাগজে লিখিত কতকগুলি প্রশ্ন তাকে করা হল। তিনি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উদ্ধৃত দলীল সহ উত্তর দিলেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ তার সহিত বাদানুবাদও করলেন। কোন প্রশ্নকারীকে উত্তর না দিয়ে তিনি ফিরিয়ে দিলেন না। অতঃপর দর্সের শেষে বললেন, ‘আল্লাহর শত প্রশংসা যে, আমরা মুসলিম ও সালাফী।* কিছু লোক বলে থাকে আমরা ওয়াহাবী। অথচ এটা হল নামের খেতাব বের করা যা থেকে আল্লাহ আমাদেরকে নিষেধ করেছেন; তিনি বলেন,

(وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ) অর্থাৎ, আর তোমরা এক অপরের মন্দ খেতাব বের করো না। (সূরা হুজুরাত ১১ আয়াত)

পূর্ব যুগে লোকেরা ইমাম শাফেয়ীকে রাফেযী* বলে অপবাদ দিলে তিনি তাদের প্রতিবাদে বলেছিলেন,

‘মুহাম্মদের বংশধরের প্রতি ভালবাসা রাখা

যদি ‘রফয’ (রাফেযী হওয়া) হয়।

তাহলে মানব-দানব সাক্ষী থাকুক যে, আমি রাফেযী।” তদনুরূপ আমাদেরকে যারা ওয়াহাবী বলে অপবাদ দেয় তাদের প্রতিবাদে এক কবির মত বলি যে,

‘আহমদের (সা.) অনুসারী যদি ওয়াহাবী হয়,

তাহলে আমি স্বীকার করছি যে, আমি একজন ওয়াহাবী।” অতঃপর দর্স শেষ হলে কিছু যুবকের সহিত আমরা বের হয়ে এলাম। তার ইলম ও বিনয় দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। এক যুবককে বলতে শুনলাম, ‘উনিই হচ্ছেন প্রকৃত শায়খ!”

তওহীদের দুশমনরা তওহীদবাদীকে ‘ওয়াহাবী’ বলে অভিহিত করে। এতে তারা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এর প্রতি সম্বন্ধ করে। অথচ সত্য ও সঠিক বললে তাঁর নাম মুহাম্মাদ এর প্রতি সম্বন্ধ জুড়ে ‘মুহাম্মদী’ বলত। আল্লাহর ইচ্ছা তাই ওয়াহহাবী” ওয়াহহাব’ এর প্রতি সম্বদ্ধ হয়েছে; যা। আল্লাহর সন্দরতম নামাবলীর অন্যতম নাম।

একজন সূফী যদি এমন এক জামাআতের সহিত সম্বন্ধ রাখে যারা সূফ’ (পশমবস্ত্র) পরিধান করে (ফলে তাকে সুফী বলা হয়, তাহলে একজন ওয়াহহাবী’ ও ‘আল-ওয়াহাহহাব’-এর প্রতি সম্বন্ধ রেখে (গর্ব অনুভব করতে পারে)। যেহেতু আল-ওয়াহাহহাব’ (মহাদাতা) হলেন আল্লাহ। যিনি তাকে তওহীদ দান করেছেন এবং তওহীদের দাওয়াত পেশ করতে তাকে সক্ষম ও সুদৃঢ় করেছেন।

* সালাফীঃ যারা সলফে সালেহ(রসূল ও সাহাবা)র পথ অনুসরণ করেন।

** রাফেযাহঃ শিয়াহ সম্প্রদায়ের একটি ফিরকার নাম। (অনুবাদক)