ব্যাখ্যাঃ বেশী বেশী কসম খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে যে সমস্ত দলীল-প্রমাণ রয়েছে এবং এ বিষয়ে যেসব ধমকি রয়েছে, লেখক এখানে তা বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
‘‘তোমরা যে সমস্ত অর্থহীন কসম খেয়ে ফেলো, সে সবের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না। কিন্তু তোমরা জেনেবুঝে যেসব কসম খাও সেগুলোর উপর তিনি অবশ্যই তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এ ধরণের কসম ভেঙ্গে ফেলার কাফ্ফারা এই যে, দশজন মিসকীনকে এমন মধ্যম মানের খাদ্য প্রদান করবে; যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে খেতে দিয়ে থাকো অথবা তাদেরকে কাপড় পরাও অথবা একজন ক্রীতদাস মুক্ত করে দিবে। আর যে ব্যক্তি এর সামর্থ রাখে না, সে তিন দিন রোযা রাখবে। এ হচ্ছে তোমাদের কসমের কাফ্ফারা যখন শপথ করে তা ভেঙ্গে ফেলো। তোমরা স্বীয় শপথসমূহ সংরক্ষণ করো। এমনিভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনাবলী বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও’’। (সূরা মায়েদাঃ ৮৯)
ব্যাখ্যাঃ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ তোমরা স্বীয় শপথসমূহ সংরক্ষণ করোঃ আয়াতের এই অংশের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ তোমরা কাফফারা আদায় না করে শপথকে ফেলে রেখোনা। ইবনে জারীর ব্যতীত অন্যরাও আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই তাফসীর বর্ণনা করেছেন। ইবনে আববাসের বর্ণনার অর্থ হচ্ছে, তোমরা কসম খেয়োনা।
অন্যরা বলেনঃ তোমরা কসম খাওয়ার পর তা ভঙ্গ করা থেকে বেঁচে থাকো। অর্থাৎ কসম ভঙ্গ করোনা। এই অর্থ এবং উপরে বর্ণিত অর্থ উভয়টিই উদ্দেশ্য হতে কোনো বাধা নেই।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা বলতে শুনেছি,
«الْحَلِفُ مُنَفِّقَةٌ لِلسِّلْعَةِ مُمْحِقَةٌ لِلْبَرَكَةِ»
‘‘মিথ্যা শপথ ব্যবসায়িক পণ্য দ্রুত বিক্রি হতে সাহায্য করে ঠিকই; কিন্তু তা বরকত ধ্বংশকারী’’। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[1]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম আবু দাউদ ও নাসায়ীও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে উপরোক্ত হাদীছের শব্দগুলো বুখারী ও মুসলিমের। আবু দাউদের বর্ণনায় بركة স্থলে كسب শব্দটি রয়েছে।
উপরোক্ত হাদীছের অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা কখনো দ্রব্যের দাম ক্রয়মূল্যের চেয়ে বাড়িয়ে বলে। ক্রেতারা তার কথায় বিশ্বাস করে দ্রব্যটি বাড়তি দামে ক্রয়ও করে। এতে বিক্রেতা বাহ্যিক দৃষ্টিতে উপকৃত হলেও আল্লাহ তাআলা এ থেকে বরকত উঠিয়ে নেন। যেমন বলা হয়েছে অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছে। মানুষের বর্তমান অবস্থা এই কথাকে সত্যায়ন করে। মানব সমাজে এর অসংখ্য নযীর রয়েছে। কেননা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, আল্লাহর আনুগত্য করা ব্যতীত তা অর্জন করা যায়না। অপরাধী এবং অবাধ্যের কাছে দুনিয়ার সামগ্রী প্রচুর পরিমাণ থাকলেও পরিণামে দুনিয়ার সবকিছুই তার কাছ থেকে বিলুপ্ত হবে এবং নিজেও ধ্বংস হবে।
সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ أُشَيْمِطٌ زَانٍ، وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ، وَرَجُلٌ جَعَلَ اللَّهَ بِضَاعَتَهُ و لا يَشْتَرِي إِلا بِيَمِينِهِ وَلا يَبِيعُ إِلا بِيَمِينِهِ»
‘‘তিন শ্রেণীর লোকদের সাথে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদেরকে গুনাহ হতে পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তারা হচ্ছে, বৃদ্ধ ব্যভিচারী, অহংকারী গরীব, আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ব্যবসার পণ্য বানিয়েছে। আল্লাহর নামে কসম করা ব্যতীত সে পণ্য ক্রয় করেনা, কসম করা ব্যতীত পণ্য বিক্রিও করেনা’’। ইমাম তাবরানী সহীহ সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[2]
ব্যাখ্যাঃ সালমান বলতে এখানে সাহাবী সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু উদ্দেশ্য। তার উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আগমণের পরপরই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি খন্দকের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। তাঁর পরামর্শেই খন্দকের যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দক খনন করেছিলেন। আবু উছমান নাহদী, শুরাহবীল বিন সামাত (রঃ) এবং অন্যরা তাঁর নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ফযীলতে বলেছেনঃ
«سَلْمَانُ مِنَّا أَهْلَ الْبَيْتِ»
‘‘সালমান আমাদের আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত’’। তিরমিযীর অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আমার সাহাবীদের মধ্য হতে চারজন সাহাবীকে ভালবাসেন। আলী বিন আবু তালিব, আবু যার্ গিফারী, সালমান ফারেসী এবং মিকদাদ বিন আসওয়াদ রাযিয়াল্লাহু আনহুম।[3] উছমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে সালমান মৃত্যু বরণ করেন।
উপরোক্ত হাদীছের রাবী সালমান ফারেসী না হয়ে সালমান বিন আমের বিন আওস যাববীও হতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন
لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন নাঃ এটি হবে তাদের জন্য একটি কঠিন শাস্তি। কেননা সহীহ ও মুতাওয়াতির সূত্রে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যে, ঈমানদারদের সাথে হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাআলা কথা বলবেন এবং লোকেরাও কিয়ামতের প্রাঙ্গনে আল্লাহর সাথে কথা বলবে। কুরআন ও হাদীছে এর পক্ষে দলীলগুলো অত্যান্ত সুস্পষ্ট। এই হাদীছে আল্লাহর কালামকে অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কথা বলা সিফাতকে অস্বীকারকারী জাহমীয়া ও আশায়েরাদের প্রতিবাদ করা হয়েছে।
وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ তাদেরকে পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তিঃ এটি হবে তাদের উপর আল্লাহর সর্বোচ্চ শাস্তি। উক্ত অন্যায় কাজগুলো থেকে বাঁচার জন্য এই কঠিন শাস্তির ঘোষণাই প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট।
أُشَيْمِطٌ زَانٍ বৃদ্ধ ব্যভিচারীঃ এখানে বৃদ্ধ ব্যভিচারীকে নিন্দা করার জন্য তাকে ‘উশাইমীত’[4] তথা তাসগীরের (ক্ষুদ্রতা বাচক শব্দের) দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা গুনাহ্ করার শক্তি তার মধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরও গুনাহটি করেছে। শরীরের শক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ব্যভিচারের জন্য প্রস্ত্তত হওয়াই প্রমাণ করে যে, পাপ ও অশ্লীল কাজের প্রতি তার অন্তরে প্রচুর আগ্রহ রয়েছে এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভয় বলতে কিছু নেই।
এমনি দরিদ্র অহংকারী। অহংকার করার মত তার কিছুই নেই। তারপরও সে যদি অহংকার করে, তাহলে প্রমাণিত হয় যে, অহংকার করা তার মজ্জাগত স্বভাব। এই জন্যই তার শাস্তিও বড় হবে বলে হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা তার মধ্যে অহংকার করার মত কোনো উপকরণ না থাকার পরও অহংকার করে, যা কবীরাহ গুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি বিরাট কবীরা গুনাহ্।
وَرَجُلٌ جَعَلَ اللَّهَ بِضَاعَتَهُ আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ব্যবসার পণ্য বানিয়েছেঃ এখানে আল্লাহ তাআলার সম্মানিত নাম ‘আল্লাহ্’-এর উপর যবর দিয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর নামকে শপথের মধ্যে বেশী বেশী উল্লেখ করে ব্যবসায়িক পণ্যের প্রসার ঘটানো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
সহীহ বুখারীতে[5] ইমরান বিন হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ قَالَ عِمْرَانُ فَلاَ أَدْرِى أَذَكَرَ بَعْدَ قَرْنِهِ قَرْنَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا ثُمَّ إِنَّ بَعْدَكُمْ قَوْمًا يَشْهَدُونَ وَلاَ يُسْتَشْهَدُونَ وَيَخُونُونَ وَلاَ يُؤْتَمَنُونَ وَيَنْذُرُونَ وَلاَ يَفُونَ وَيَظْهَرُ فِيهِمُ السِّمَنُ»
‘‘আমার উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার সাহাবীগণ। অতঃপর উত্তম হচ্ছে তাদের পরবর্তীতে আগমণকারীগণ। অতঃপর উত্তম হচ্ছে যারা তাদের পরবর্তীতে আসবে। ইমরান বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরে দুই যুগের কথা বলেছেন নাকি তিন যুগের কথা বলেছেন তা আমি বলতে পারছিনা। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ অতঃপর তোমাদের পরে এমন সব লোক আসবে, যাদেরকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকা না হলেও সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এগিয়ে আসবে, তারা খেয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবে না। তারা মানত করবে, কিন্তু তা পূরণ করবে না। আর তাদের মধ্যে মোটা মানুষ দেখা দিবে’’।[6]
ব্যাখ্যাঃ خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى আমার উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার সাহাবীগণঃ তারা সর্বোত্তম মানুষ হওয়ার কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রচুর কল্যাণ ছিল এবং খারাপ কাজ একদম নগণ্য ছিল। কেননা সেই সময় যারা হকের বিরোধীতা করতো এবং বিদআত তৈরী করত সাহাবীগণ কঠোরভাবে তাদের প্রতিবাদ করতেন। যেমন তারা খারেজী, কাদরীয়া, জাহমীয়া এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ অতঃপর উত্তম হচ্ছে তাদের পরবর্তীতে আগমণকারীগণঃ এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের পরে সাহাবীদের যুগ উদ্দেশ্য। তারা তাদের পরে আগমণকারীদের চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণ হচ্ছে, তাদের যুগে ইসলামের প্রচুর বিজয় হয়েছে, ইলমের প্রসার ঘটেছে এবং তাদের মধ্যে অনেক আলেম-উলামা বিদ্যমান ছিলেন।
তবে তৃতীয় যুগ অর্থাৎ তাবেয়ীদের যুগ সম্পর্কে কথা হচ্ছে তাদের যুগে বিদআতের উৎপত্তি হয়েছে। তবে আলেমগণ এর প্রতিবাদ করেছেন এবং প্রতিবাদের জন্য অনেক আলেম সর্বদা লেগেই থাকতেন। যারা বিদআতী কথা বলত, তারা তাদেরও প্রতিবাদ করতেন। এই শ্রেণীর প্রতিবাদী আলেমের সংখ্যা ছিল তখন প্রচুর।
ইমরান বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরে দু’যুগের কথা বলেছেন নাকি তিন যুগের কথা বলেছেন তা আমি বলতে পারছিনাঃ এই সন্দেহ হাদীছের রাবী ইমরান বিন হুসাইনের পক্ষ হতে।
অতঃপর তিন যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর দ্বীনের মধ্যে যেসব বিভ্রান্তি ও বিদআত অনুপ্রবেশ করেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সমস্ত বিভ্রান্তির কথা আগেই বলে গেছেন। তিনি বলে গেছেনঃ অতঃপর তোমাদের পরে এমন লোকেরা আগমণ করবে, যাদেরকে সাক্ষ্য দিতে বলা না হলেও সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এগিয়ে আসবে। কেননা তারা সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টিকে খুব হালকা ও সহজ মনে করবে এবং সত্যের অনুসন্ধানে তারা কোনো চেষ্টা করবেনা। দ্বীন পালনে তাদের প্রচেষ্টার স্বল্পতা এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে চলায় তাদের দুর্বলতার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
وَيَخُونُونَ وَلاَ يُؤْتَمَنُونَ তারা খেয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবেনাঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর এই কথা প্রমাণ করে যে, সে সময় তাদের অনেক অথবা অধিকাংশ লোকই আমানতের খেয়ানত করবে।
وَيَنْذُرُونَ وَلاَ يَفُونَ তারা মানত করবে ঠিকই; কিন্তু তা পূরণ করবেনাঃ এটি প্রমাণ করে যে, তাদের উপর আল্লাহর যে সমস্ত হক ও ওয়াজিব রয়েছে, তারা তা পালন করবেনা। এই অন্যায় ও নিন্দনীয় কাজগুলো প্রকাশ হওয়া তাদের ইসলামের দুর্বলতা এবং ঈমান না থাকার প্রমাণ করে।
وَيَظْهَرُ فِيهِمُ السِّمَنُ আর তাদের মধ্যে মোটা মানুষ দেখা দিবেঃ দুনিয়ার প্রতি তাদের আগ্রহ ও লোভের কারণে এবং দুনিয়ার ভোগবিলাসের প্রতি তাদের প্রচুর আসক্তির কারণে এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান দুর্বল হওয়ার কারণেই এমন হবে। অর্থাৎ দুনিয়ার নেয়ামত বেশী বেশী উপভোগ করার কারণে তারা নাদুসনুদুস ও মোটাতাজা হয়ে যাবে এবং আখেরাতের নেয়ামতের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যাবে।
আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখনই মানুষের কাছে একটি যামানা অতিক্রম করবে, তখন তার পরে আগমণকারী যামানাটি পূর্বের যামানার তুলনায় অধিক নিকৃষ্ট হবে। তোমাদের প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থাই চলতে থাকবে। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি এ কথা তোমাদের নবীর কাছ থেকেই শুনেছি।[7]
সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ يَجِىءُ قَومٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِينَهُ وَيَمِينُهُ شَهَادَتَهُ»
‘‘সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছে আমার যুগের মানুষ। এরপর উত্তম হলো তাদের পরবর্তীতে আগমনকারীগণ। তারপর উত্তম হলো যারা তাদের পরবর্তীতে আসবে । অতঃপর এমন এক জাতির আগমন ঘটবে, যাদের কারো সাক্ষ্য কসমের আগেই হয়ে যাবে, আবার কখনো কসম সাক্ষ্যের আগেই হয়ে যাবে’’।[8] অর্থাৎ কসম ও সাক্ষের মধ্যে কোন মিল থাকবে না। কসম ও সাক্ষ্য উভয়টাই মিথ্যা হবে।
ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে প্রমাণ মিলে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর মৃত্যুর পর তিন যুগ হচ্ছে সর্বোত্তম যুগ।
ثُمَّ يَجِىءُ قَومٌ অতঃপর এমন এক জাতির আগমন ঘটবে, যাদের কারো সাক্ষ্য কসমের আগেই হয়ে যাবেঃ ঈমানের দুর্বলতা, দুনিয়ার প্রতি অত্যাধিক আসক্তি, দুনিয়ার ভালবাসায় অন্তর পরিপূর্ণ হওয়া এবং সীমা লংঘন ও পাপের কাজ বেশী হওয়ার কারণেই এমন হবে।
ইবরাহীম নখয়ী বলেনঃ আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন সাক্ষ্য, শপথ এবং ওয়াদা-অঙ্গিকারের হেফাজত করার জন্য অভিভাবকগণ আমাদেরকে প্রহার করতেন।
ব্যাখ্যাঃ সালফে সালেহীনদের অবস্থা এ রকমই ছিল। যেই দ্বীনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সম্মানিত করেছেন, সর্বদা তারা সেই দ্বীনের হেফাযত করতেন। অপছন্দনীয় কোনো কাজ দেখলেই তার কড়া প্রতিবাদ জানাতেন। এভাবে তারা ছোট শিশুদেরকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে প্রতিপালন করতেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) কসম সংরক্ষণের উপদেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কসম করলে তা পূরণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে।
২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, মিথ্যা কসমের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পণ্য দ্রুত বিক্রি হয় ঠিকই, কিন্তু তা হতে বরকত উঠে যায়।
৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম ছাড়া ক্রয় বিক্রি করেনা তাকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে।
৪) এখানে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে যে, গুনাহ করার জন্য উপযুক্ত শক্তি কম থাকার পরও যদি কেউ গুনাহ করে তাহলে তার ছোট গুনাহও বড় আকার ধারণ করে। অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হওয়ার ফলে মানুষের যৌন আগ্রহে ও শক্তিতে ভাটা পড়ে। তখন ব্যভিচার করার মত পর্যাপ্ত শক্তি ও আগ্রহ না থাকারই কথা। এরপরও যেই বৃদ্ধলোক এই কাজ করবে, তার শাস্তি ভয়াবহ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ জীবনের শেষ মুহূর্তে উপনীত হয়ে সদা আখেরাতের চিন্তা করা উচিত, সৎকর্মে মশগুল থাকা জরুরী এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকা আবশ্যক। যখন কোন বৃদ্ধ তা না করে শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরও পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে, তার জন্য সেই পাপ কাজ নিশ্চয়ই ভয়াবহ লাঞ্ছনা ও গ্লানি ডেকে আনবে।
৫) কসম খেতে বলার আগেই যারা কসম খায়, তাদের নিন্দা করা হয়েছে।
৬) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন যুগের অর্থাৎ সাহাবী, তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীদের প্রশংসা করেছেন। এই তিন যুগের পরে যে সমস্ত বিদআত এবং অন্যান্য অপকর্ম হবে, তিনি তা আগেই বলে দিয়েছেন।
৭) সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকা না হলেও যারা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য প্রস্ত্তত থাকে এখানে তাদেরও নিন্দা করা হয়েছে।
৮) সালাফে সালেহীনগণ শিশুদেরকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে প্রতিপালন করতেন। সাক্ষ্য দেয়া, শপথ করা এবং ওয়াদা-অঙ্গিকারের উপর কায়েম থাকার জন্য তারা শিশুদেরকে প্রহারও করতেন।
[2] - হাদীছের সনদ সহীহ, দেখুনঃ সহীহুত্ তারগীব ও তারহীব, হাদীছ নং- ১৭৮৮।
[3] - এই হাদীছটি উল্লেখিত শব্দে তিরমিযীতে পাওয়া যায়নি। শব্দগুলো রয়েছে মুসনাদে আহমাদে। দেখুনঃ হাদীছ নং- ২৩৬৭০।
[4] - উশাইমীত বলা হয় এমন বৃদ্ধ লোককে, বয়স বেশী হওয়ার কারণে যার মাথার চুল পাকা শুরু হয়েছে।
[5] - বুখারী, হাদীছ নং- ৩৬৫০।
[6] - অর্থাৎ আখেরী যামানায় মানুষের দ্বীনী চেতনা দুর্বল হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। এতে করে তারা ভোগ-বিলাসী হয়ে উঠবে। ফলে তারা অতিভুজী হবে। এতে তাদের দেহ খুব মোটা হয়ে যাবে এবং শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমবে।
হাদীছে অতিভোজের মাধ্যমে শরীর মোটা করাকে নিন্দা করা হয়েছে। কেননা মাত্রাতিরিক্ত মোটা মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম বুদ্ধিসম্পন্ন হয় এবং শরীর ভারী হওয়ার কারণে এবাদত-বন্দেগী ঠিক মত করতে পারেনা।
[7] -সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৭০৬৭।
[8]- সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ২৬৫২।