আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
‘‘অবিশ্বাসীরা বলে, শুধু দুনিয়ার জীবনই আমাদের আসল জীবন। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি। যামানা ব্যতীত অন্য কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করতে পারেনা। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে’’। (সূরা জাসিয়াঃ ২৪)
ব্যাখ্যাঃ হাফেয ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এখানে কাফেরদের দাহরীয়াহ সম্প্রদায়[1] এবং পরকালকে অস্বীকারকারী আরব মুশরিকদের কথা বলেছেন। আরবের কাফের-মুশরিকদের মধ্যে যারা দাহরীয়া মতবাদের অনুসারী ছিল, তারা বলতঃ দুনিয়ার জীবনের পর আর কোনো জীবন নেই। আমরা এখানেই জীবিত থাকি এবং এখানেই মৃত্যু বরণ করি। অর্থাৎ এই দুনিয়া ব্যতীত আর কোন ঘর নেই। এখানে একদল মৃত্যু বরণ করে। আরেক দল আসে এবং তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। না আছে কোনো পুনরুত্থান, না আছে কিয়ামত। পরকালকে অস্বীকারকারী আরব মুশরিকদের এটিই ছিল কথা। আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী দার্শনিকদের কথাও তাই। তারা সৃষ্টিজীবের নতুন করে পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে। আল্লাহ তাদের কথা তুলে ধরে বলেছেন যে, তারা বলে মহা কালই আমাদেরকে ধ্বংস করে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে’’। অর্থাৎ তারা শুধু ধারণা ও কল্পনা করে থাকে।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
(يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ بِيَدِي الأَمْرُ أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ»
‘‘বনী আদম আমাকে কষ্ট দেয়। তারা যামানাকে গালি দেয়। অথচ আমিই যামানা। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা। রাত-দিন আমিই পরিবর্তন করি’’।[2] অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা যামানাকে গালি দিয়োনা। কারণ, আল্লাহই হচ্ছেন যামানা।
ব্যাখ্যাঃ ইমাম বগবী (রঃ) শরহুস সুন্নাহয় বলেনঃ হাদীছটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে ইমাম বুখারী ও মুসলিম একমত পোষণ করেছেন। তারা মা’মারের সূত্রে একাধিক সনদে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
হাফেয ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ যুগকে দোষারোপ করা এবং বিপদাপদের সময় যামানাকে গালি দেয়া আরবদের অন্যতম অভ্যাস ছিল। কেননা যে সমস্ত মসীবত ও কষ্ট তাদেরকে আক্রমণ করত, সেগুলোকে তারা যামানার দিকেই সম্বোধিত করত। তারা বলত যে, তাদের কালের মসীবত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং যুগ তাদেরকে বরবাদ করে দিয়েছে। সুতরাং মসীবতের কবলে পতিত হয়ে যখন তারা উহাকে যামানার দিকে সম্বন্ধ করত, তখন তারা মূলতঃ যামানার স্রষ্টাকেই গালি দিত। কেননা প্রকৃত অর্থে সকল বস্ত্তর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। এ জন্যই যামানাকে গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম ইবনে কাছীরের বক্তব্য সংক্ষিপ্তভাবে এখানেই শেষ।
আববাসী যুগের কবিদের কবিতায় যামানাকে গালি দেয়া এবং কাজকর্ম ও ঘটনাপ্রবাহকে মহাকালের দিকে সম্বোধিত করার প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন ইবনুল মু’তায্য এবং মুতানাববী এবং অন্যান্য কবিগণের কথা বলা যেতে পারে। তবে কোনো বছরকে অভাব ও দুর্ভিক্ষের বছর বলা যামানাকে গালি দেয়ার অন্তর্ভূক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউসুফের ৪৮ নং আয়াতে বলেনঃ
ثُمَّ يَأْتِي مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ سَبْعٌ شِدَادٌ يَأْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًا مِمَّا تُحْصِنُونَ
‘‘অতঃপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর; এ সময়ের জন্য তোমরা যে শস্য জমা করবে তার সমস্তই এসময়ে খেয়ে যাবে। কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত, যা তোমরা সংরক্ষণ করে রাখবে’’।
কোন কোন কবি বলেছেনঃ
إن الليالي من الزمان مَهُولة تُطوى وتُنشر بينها الأعمار
যামানার রাত্রিসমূহ খুবই ভয়ংকর। এর মধ্যে মানুষের বয়স কমানো ও বাড়ানো হয়।
فقِصارهنّ مع الهموم طويلة وطِوالهن مع السرور قِصار
দুঃশ্চিন্তা ও বেদনাপূর্ণ রাতগুলো খুব ছোট হলেও তা অনেক দীর্ঘ অনুভব হয়। আর আনন্দময় রাত খুব দীর্ঘ হলেও তা খুবই সংক্ষিপ্ত।
আববাসী যুগের কবি আবু তাম্মাম বলেনঃ
أعوام وصْل كاد ينسي طيبها ذِكرُ النّوى فكأنها أيام
বিপদাপদের স্মরণ সুখের বছরগুলো প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছে। মনে হয় সেগুলো ছিল মাত্র কয়েক দিন
ثم انبرت أيام هجر أعقبت نحوي أسىً فكأنها أعوام
অতঃপর বিরহের দিনগুলো সম্মুখে এসেছে। তার পথ ধরেই আমার সামনে আসল কষ্টের দিনগুলো। মনে হচ্ছিল সে দিনগুলো অনেক বছর
ثم انقضت تلك السنون وأهلها فكأنها وكأنهم أحلام
অতঃপর চলে গেছে সেই কঠিন বছরগুলো এবং তাতে যারা ছিল, তারাও চলে গেছে। সেই বছরগুলো এবং সে সময়ের লোকেরা কেবল রয়ে গেছে স্মৃতির পাতায়।[3] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) যামানাকে গালি দেয়া নিষেধ।
২) যামানাকে গালি দেয়া আল্লাহকে কষ্ট দেয়ার নামান্তর।
৩) فإن الله هو الدهر আল্লাহই হচ্ছেন যামানা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীর মধ্যে গভীর চিন্তার বিষয় নিহিত আছে।
৪) বান্দার অন্তরে আল্লাহকে গালি দেয়ার ইচ্ছা না থাকলেও অসাবধানতা বশতঃ মনের অগোচরে তাঁকে গালি দিয়ে ফেলতে পারে।
[2] - আমিই যুগ বা মহাকাল- এই কথা থেকে বুঝা যায় না যে, الدهر দাহর আল্লাহর একটি নাম। কেননা হাদীছের শেষাংশে এর ব্যাখ্যা বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর হাতেই যুগের পরিবর্তনসহ সকল কিছুর ব্যবস্থাপনা, তিনিই দিন-রাত পরিবর্তন করেন।
[3] - নোটঃ উক্ত কথাগুলো পরিপূর্ণ তাওহীদের পরিপন্থী। কারণ এখানে সুখ-শান্তি ও বিপদাপদকে তার প্রকৃত সষ্টার দিকে সম্বোধিত না করে কালের দিকে সম্বোধিত করা হয়েছে এবং কালের আবর্তন-বিবর্তনকেই দুঃখ-বেদনার কারণ হিসাবে উল্লখ করে কালকেই দোষারোপ করা হয়েছে। কাল যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি ও আজ্ঞাবহ সে কারণে কালকে দোষারোপ করার মাধ্যমে আল্লাহকেই দোষারোপ করা হয়। তাই মুমিনদের উচিত যামানাকে দোষারোপ না করা এবং তাকে গালি না দেয়া।