আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘‘এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক তাহলে তাদেরকে ভয় করোনা; বরং আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৭৫)
ব্যাখ্যাঃ আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ শয়তানের চক্রান্তের মধ্যে এটিও একটি চক্রান্ত যে, সে মুমিনদেরকে তার সেনাবাহিনী এবং বন্ধুদের মাধ্যমে ভয় দেখায়। যাতে মুমিনগণ শয়তানদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করেন, সৎ কাজের আদেশ না দেন এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে বারণ না করেন। আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, এটিই শয়তানের চক্রান্ত এবং তার ভয় দেখানো। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শয়তানকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ সকল মুফাসসিরের নিকট আয়াতের অর্থ হচ্ছে, শয়তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে মুমিনদেরকে ভয় দেখায়।[1]
কাতাদাহ বলেনঃ শয়তান মানুষের অন্তরে তার বন্ধুদেরকে বড় করে দেখায়। যখনই বান্দার ঈমান মজবুত হয়, তখনই তার অন্তর থেকে শয়তানের বন্ধুদের ভয় দূর হয়ে যায়। আর যখনই ঈমান দুর্বল হয়, তখনই বান্দার অন্তরে শয়তানের বন্ধুদের ভয় প্রকট আকার ধারণ করে। অতএব আয়াতটি প্রমাণ করে যে, একমাত্র আল্লাহকে ভয় করা পরিপূর্ণ ঈমানের শর্তসমূহের অন্যতম। তাফসীর ও সীরাতের কিতাবসমূহ এই আয়াতের শানে নুযুল বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ
‘‘আল্লাহর মসজিদগুলোকে একমাত্র তারাই আবাদ করতে পারে, যারা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেনা। অতএব, আশা করা যায়, তারা হেদায়াত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’। (সূরা তাওবাঃ ১৮)
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কেবল ঐ সমস্ত লোকই মসজিদসমূহ আবাদ করে, যারা ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি। অর্থাৎ যারা অন্তর দিয়ে ঈমান আনয়ন করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে সৎকর্ম সম্পাদন করে। সেই সাথে শুধু আল্লাহকেই ভয় করে। সুতরাং জানা গেল যে, মসজিদ শুধু ঐ ঈমানের দ্বারাই আবাদ হবে, যার অধিকাংশ বিষয়ই হচ্ছে তাওহীদ। সেই সঙ্গে শির্ক-বিদআতের দোষমুক্ত খাঁটি সৎ আমলও করতে হবে। এ সমস্ত বিষয়ই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট ঈমানের অন্তর্ভূক্ত।
وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ‘‘আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেনা’’ঃ ইমাম ইবনে আতীয়া বলেনঃ এখানে ভয় বলতে আল্লাহর প্রতি সম্মান, আল্লাহর এবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর ভয় উদ্দেশ্য। কোনো সন্দেহ নেই যে, মানুষ পার্থিব জীবনের ক্ষতি ও বিপদাপদকে ভয় করে। তবে এ সকল ক্ষেত্রে বান্দার উচিত, সে কাযা ও কদর তথা তাকদীরের প্রতি ঈমান রেখেই পার্থিব জীবনের ক্ষতিকে ভয় করবে।
কিতাবুত তাওহীদের রচয়িতা শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের নাতী শাইখ হাসান বিন আব্দুর রাহমান (রঃ) বলেনঃ কল্যাণ ও অকল্যাণ আল্লাহর ইচ্ছা অনুপাতেই হয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহ যা চান, তাই হয়। তিনি যা চান না, তা হয়না।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ অন্তরের ভয় আল্লাহর এবাদতের অন্যতম প্রকার। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য তা পোষণ করা ঠিক নয়। আল্লাহর সামনে নত হওয়া, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, আল্লাহর কাছেই আশা করা এবং এ প্রকারের অন্যসব বিষয় এবাদতে কালবীয়া অর্থাৎ অন্তরের এবাদতের অন্তর্ভূক্ত।
فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ ‘‘অতএব আশা করা যায় যে, তারা হেদায়াত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’ঃ ইবনে আবী তালহা আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস হতে বর্ণনা করেন যে, প্রকৃত পক্ষে এই লোকেরাই হেদায়াতপ্রাপ্ত। কুরআনে যত عَسَى (আশা করা যায়) অর্থের শব্দ আছে, তা আবশ্যক অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ অবশ্যই তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেছেনঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آَمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ
‘‘মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। এরপর যখন আল্লাহর পথে তারা দুঃখ কষ্ট পায় তখন মানুষের চাপানো দুঃখ কষ্টের পরীক্ষাকে আল্লাহর আযাবের সমতূল্য মনে করে’’। (সূরা আনকাবূতঃ ১০)
ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ যে সমস্ত মানুষের কাছে নবী-রাসূল পাঠানো হয়েছে, তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে। একভাগ বলেছে আমরা ঈমান আনয়ন করেছি, আরেকভাগ তা বলেনি। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা কুফরী ও গুনাহ-এর পথেই চলেছে। যারা বলেছেঃ আমরা ঈমান আনয়ন করলাম, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুসীবত ও বিপদাপদে ফেলে পরীক্ষা করেছেন। الفتنة এর অন্যতম অর্থ হচ্ছে মসীবতে ফেলে ঈমান পরীক্ষা করা। আর যারা ঈমান আনয়ন করেনি, তারা যেন মনে না করে, সে আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে কিংবা আল্লাহর পাকড়াও থেকে পলায়ন করতে পারবে অথবা তাঁকে পরাজিত করতে পারবে।
সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তিকেই কষ্ট করতে হবে। যে ঈমান এনেছে, সেও কষ্ট করবে, আর যে ঈমান গ্রহণ করেনি, তাকেও কষ্ট করতে হবে। তবে কথা হচ্ছে মুমিন ব্যক্তি প্রথমে কষ্ট করবে দুনিয়াতে। অতঃপর দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর পরিণাম ভালো হবে।
কিন্তু ঈমান থেকে বিমুখ ব্যক্তি প্রথমে দুনিয়াতে সুখ-শান্তি ভোগ করবে। অতঃপর সে চিরস্থায়ী কষ্টের মধ্যে নিপতিত হবে।
দ্বীনের দাঈর জন্য সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে বসবাস করা জরুরী। সমাজের মানুষের রয়েছে বিভিন্ন স্বপ্ন, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্খা ও ভোগ-বিলাসের নানা চাহিদা। সমাজের মানুষেরা চায় দ্বীনের দাঈরাও তাদের চিন্তা-চেতনা ও রীতিনীতির অনুসরণ করেই চলুক। এ ক্ষেত্রে সে যদি সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরোধীতা করে, তাহলে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির অনুসারী লোকেরা তাকে কষ্ট ও শাস্তি দিবে।
আর যদি দ্বীনের দাঈ সমাজের লোকদের চিরাচরিত ও প্রচলিত রীতিনীতি ও আচার-অভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, তাহলেও সে কষ্ট পাবে। এই কষ্ট কখনো পাবে তার সমাজের লোকদের পক্ষ হতেই। আবার কখনো পাবে অন্যদের পক্ষ হতে।
সুতরাং পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার ঐ কথার উপর আমল করা আবশ্যক, যা তিনি মুআবীয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ
«مَنْ أَرْضَى اللَّهَ بِسَخَطِ النَّاس كَفَاهُ مَؤُنَةَ النَّاسَ ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا»
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আললাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনো উপকারে আসবেনা’’।
আল্লাহ যাকে হেদায়াত করেন, সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং যাকে নফ্সের অনিষ্ট হতে বাঁচান, সে হারাম কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে এবং দুষ্ট লোকদের শত্রুতার উপর ধৈর্য ধারণ করে। এতে করে সে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হয়। যেমন হয়েছিলেন নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারীগণ।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির অবস্থা বর্ণনা করেছেন, যে ঈমান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না করেই ঈমান আনয়ন করেছে। এ রকম মানুষকে যখন আল্লাহর রাস্তায় কষ্ট দেয়া হয়, তখন মানুষের ফিতনাকে আল্লাহর সেই আযাবের মতই মনে করে, যা থেকে বাঁচার জন্যই মুমিনগণ ঈমাণ গ্রহণ করেছেন। ফলে যে কারণে তাকে কষ্ট দেয়া হয়, তা বর্জন করে। অর্থাৎ আল্লাহর পথ ছেড়ে দেয়। অথচ এটি এমন কষ্ট, যা নবী-রাসূলগণ এবং তাদের অনুসারীগণ বিরোধীদের পক্ষ হতে সবসময়ই বরদাশত করেছেন।
প্রকৃত মুমিনগণ তাদের পূর্ণ দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার ফলে আল্লাহর আযাবের কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় নেন এবং ঈমানের পথে ক্ষণস্থায়ী দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেন। আর যেই মুমিন দূরদর্শিতা সম্পন্ন নন, তিনি নবী-রাসূলদের শত্রুদের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শত্রুদের অনুসরণ করেন। এরা মানুষের আযাব থেকে আত্মরক্ষা করে আল্লাহর আযাবে নিপতিত হচ্ছে। এই শ্রেণীর লোকেরা মানুষের আযাব থেকে পালিয়ে আল্লাহর আযাবের দিকে যাওয়ার মাধ্যমে উভয় আযাবকে সমান মনে করছে। এরা প্রকৃত পক্ষেই মহা ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কেননা তারা বালির উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য আগুনে আশ্রয় নিয়েছে এবং ক্ষণস্থায়ী কষ্ট থেকে বেঁচে চিরস্থায়ী কষ্টকেই বেছে নিয়েছে। তার অবস্থা হচ্ছে, আল্লাহ যখন তাঁর সৈনিক ও বন্ধুদেরকে সাহায্য করেন, তখন সে বলে আমি তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। অথচ আল্লাহ তাআলা তার অন্তরের মুনাফেকী সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছেন।
আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু হাদীছে বর্ণিত আছে,
«إِن من ضَعْفِ اليقين أن ترضى الناس بسخط الله وأن تحمدهم على رزق الله وأن تذمهم على ما لم يؤتك الله إن رزق الله لا يجره حرص حريص ولا يرده كراهية كاره»
‘‘ইয়াকীনের দুর্বলতার পরিচয় হচ্ছে আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা, আল্লাহর দেয়া রিযিক ভোগ করে মানুষের প্রশংসা করা এবং তোমাকে আল্লাহ যা দেন নি তার ব্যাপারে মানুষের বদনাম করা। জেনে রাখা দরকার যে, কোনো লোভীর লোভ আল্লাহর রিযিক টেনে আনতে পারেনা এবং কোনো ঘৃণাকারীর ঘৃণা আল্লাহর রিযিক বন্ধ করতে পারেনা’’।
ব্যাখ্যাঃ আবু নুআইম হিলয়াতুল আওলীয়ায় এবং ইমাম বায়হাকী (রঃ) শুআবুল ঈমানে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদে মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস সুদ্দী থাকার কারণে তিনি হাদীছকে যঈফ বলেছেন। হাদীছের বাকী অংশ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় হিকমতেই তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং ঈমানকেই শান্তি ও আনন্দের উৎসস্থল বানিয়েছেন এবং আল্লাহর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা ও তাকদীরের প্রতি অসন্তুষ্টিকেই সকল প্রকার পেরেশানী ও বিষন্নতার কারণ বানিয়েছেন।
إِن من ضَعْفِ اليقين ইয়াকীনের দুর্বলতা হচ্ছে......: ضعف শব্দের ‘যোয়াদ’ বর্ণে পেশ এবং ‘আইন’ বর্ণে সাকীন দিয়ে পড়তে হবে। ‘যোয়াদ’ বর্ণে পেশ এবং ‘আইন’ বর্ণে সাকীন দিয়েও পড়া যায়। আবার যোয়াদকে যবর দিয়ে আইনেও হরকত দিয়েও পড়া যায়। ضعف শব্দটি قوة -এর বিপরীত। অর্থাৎ ضعف অর্থ দুর্বলতা। এর বিপরীতে قوة অর্থ শক্তি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বলেনঃ উপরে বর্ণিত ইয়াকীন দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ণ ঈমান। আর সবর (ধৈর্য) হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক।
আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করাঃ অর্থাৎ মানুষের সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর প্রাধান্য দেয়া। এটি ঐ ব্যক্তিই করতে পারে, যার অন্তরে আল্লাহর প্রতি সম্মান ও তাঁর ভয়ের এমন কোন অংশ নেই, যা তাকে তার প্রভু ও মালিক আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির উপর মানুষের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া হতে বাধা দিতে পারে। আর আল্লাহ্ তাআলাই মানুষের অন্তরের মালিক ও তা পরিবর্তনকারী। এই দিক থেকে বলা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালবাসা ও সন্তুষ্টির উপর মানুষের ভালোবাসা ও সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়, সে এক প্রকার শির্কেও লিপ্ত হয়। কেননা সে আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর সৃষ্টির সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং এমন বিষয় দিয়ে মাখলুকের নৈকট্য কামনা করেছে, যাতে আল্লাহ নারাজ হন। আল্লাহ যাকে হেফাজত করেন, সে ব্যতীত অন্য কেউ এ থেকে পরিত্রাণ পায়না।
আল্লাহর দেয়া রিযিক ভোগ করে মানুষের প্রশংসা করাঃ অর্থাৎ বনী আদমের কারো না কারো মাধ্যমে যেহেতু রিযিক আসে, তাই তারা রিযিককে মানুষের দিকে সম্বন্ধ করে এবং তাদের মাধ্যমে রিযিক আসার কারণে তাদেরই প্রশংসা করে। অথচ আল্লাহ তাআলাই তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন এবং তা অর্জন করা সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন বা কাউকে রিযিক বা অন্য কিছু দেয়ার ইচ্ছা করেন, তখন তার জন্য কোনো না কোনো মাধ্যম নির্ধারণ করেন।
এ কথা ঐ হাদীছের বিরোধী নয়, যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে মানুষের শুকরিয়া করেনা সে আল্লাহরও শুকরিয়া করেনা। হাদীছের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা যেহেতু তাদের হাতের মাধ্যমে তোমার কাছে রিযিক পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, তাই তুমি তাদের জন্য দুআ করবে অথবা বদলা দেয়ার চেষ্টা করবে। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে, তোমাদের সাথে কেউ ভালো আচরণ করলে, তোমরা তার বদলা দাও। বদলা দেয়ার মত কিছু না পেলে তার জন্য দুআ কর। যাতে তোমরা মনে করতে পার যে, তার বদলা দেয়া হয়েছে।
তোমাকে আল্লাহ যা দান করেননি তার ব্যাপারে মানুষের বদনাম করাঃ কেননা তুমি তাদের কাছে যে বস্ত্ত কামনা করছ, আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য তা নির্ধারণ করেন নি। আল্লাহ তাআলা যদি তোমার জন্য তা নির্ধারণ করতেন, তাহলে তোমার তাকদীরই উহাকে তোমার কাছে টেনে নিয়ে আসত। সুতরাং কিছু না পেয়ে মানুষকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে আল্লাহ তাআলাই নিজ ইচ্ছায় কাউকে দান করেন আবার কাউকে মাহরুম করেন, তিনিই বান্দাকে পরিশ্রমের বিনিময়ে কিংবা পরিশ্রম ছাড়াই রিযিক দান করেন এবং তিনি এমন স্থান হতে রিযিক দান করেন, যার কল্পনাও সে করতে পারেনা, যার বিশ্বাস ঠিক এ রকমই সে কখনো স্বীয় প্রয়োজন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে পেশ করতে পারেনা। সে আরও বিশ্বাস করে যে, তাকে যা দেয়া হয়নি, তা না পাওয়ার মধ্যেও তার জন্য কল্যাণ রয়েছে। সে আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করে। কেবল তাঁর কাছেই কামনা করে এবং তাঁকেই ভয় করে। পূর্বোক্ত হাদীছে এ কথাটিই ব্যক্ত করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘কোনো লোভীর লোভ আল্লাহর রিযিক টেনে আনতে পারে না। আবার কোনো ঘৃণাকারীর ঘৃণা আল্লাহর রিযিক বন্ধ করতে পারেনা’’।
শাইখুল ইসলাম বলেনঃ আল্লাহর উপর ইয়াকীন রাখার দাবী হচ্ছে, বান্দা আল্লাহ তাআলার হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করবে এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে যা দেয়ার ওয়াদা করেছেন, তার প্রতিও পূর্ণ আস্থা রাখবে। আল্লাহর উপর ইয়াকীন রাখার অন্যতম দাবী হচ্ছে বান্দা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ্ তাআলাই সব কিছু নির্ধারণ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই সবকিছু পরিচালনা করেন।
সুতরাং তুমি যদি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষকে খুশী করতে যাও, তাহলে আল্লাহর ওয়াদা এবং আল্লাহ তাআলাই যে একমাত্র রিযিক দাতা- এ কথার উপর তুমি অবিশ্বাসী বলে গণ্য হবে। এমনটি হওয়ার কারণ হল লোকদের হাতে যে সমস্ত সম্পদ রয়েছে, তার প্রতি বান্দা ঝুকে পড়ে এবং তা পাওয়ার লোভেই আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা ছেড়ে দেয় অথবা আল্লাহ তাআলা আনুগত্যকারী বান্দাদের জন্য যে সাহায্য ও সমর্থন দেয়ার অঙ্গিকার করেছেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার জন্য যে ছাওয়াব রয়েছে, তার প্রতি বিশ্বাস দুর্বল হওয়ার কারণেই সে আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে দেয়।
তুমি যখন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে, তখন আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন, তোমার রিযিকের ব্যবস্থা করবেন এবং তোমার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে বান্দাদেরকে সন্তুষ্ট করা বান্দাদেরকে ভয় করা কিংবা তাদের নিকট থেকে কিছু আশা করার কারণেই হয়ে থাকে। আর এটি দুর্বল ঈমানের পরিচয়।
হে মুমিন! আল্লাহর বান্দাদের কাছ থেকে যা পাওয়ার ধারণা করে থাক, তা যদি না পাও, তাহলে বুঝবে যে, এর কারণ আল্লাহ তাআলাই, তারা নয়। কেননা আল্লাহ যা চান, তাই হয়, তিনি যা চান না, তা কখনো হয়না। সুতরাং আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারণ না করার কারণে যা পাওনি, তার জন্য মানুষকে দোষারোপ করা তোমার ঈমানের দুর্বলতার পরিচয়।
সুতরাং হে মুমিন! তুমি মানুষকে ভয় করোনা এবং তাদের কাছে কিছুই চেয়োনা। আর তোমার ঈমান পরিপূর্ণ না হওয়ার কারণে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে মানুষকে দোষারোপও করোনা। লোকদের মধ্যে প্রশংসিত ঐ ব্যক্তি, যার প্রশংসা করেছেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং নিন্দিত ঐ ব্যক্তি, যার নিন্দা করেছেন আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল।
মোটকথা উপরের হাদীছ প্রমাণ করে যে, ঈমান বাড়ে ও কমে এবং বান্দার আমলও ঈমানের অন্তর্ভূক্ত।
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَأَرْضَى عَنْهُ النَّاسَ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَسْخَطَ عَلَيْهِ النَّاسَ»
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আললাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন। ইমাম ইবনে হিববান তার সহীহ কিতাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[2]
ব্যাখ্যাঃ হাদীছে বর্ণিত التمس অর্থ হচ্ছে সে চায়, অনুসন্ধান করে, কামনা করে ইত্যাদি। শাইখুল ইসলাম বলেনঃ আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু উপরোক্ত হাদীছকে লিখে মুআবীয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট পাঠিয়েছিলেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন। মারফু বর্ণনার শব্দগুলো ঠিক এ রকমঃ
«مَنْ أَرْضَى اللَّهَ بِسَخَطِ النَّاس كَفَاهُ مَؤُنَةَ النَّاسَ ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا»
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনই উপকারে আসবেনা’’। আর মাউকুফ বর্ণনার শব্দগুলো হচ্ছে এ রকমঃ
«من أرضى الله بسخط الناس رضي الله عنه وأرضى عنه الناس ومن أرضى الناس بسخط الله عاد حامده من الناس له ذاما»
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, মানুষের মধ্য হতে তার প্রশংসাকারীরাই তার নিন্দুকে পরিণত হয়।
এটি দ্বীনের বিরাট একটি শিক্ষা। কেননা যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মানুষকে অসন্তুষ্ট করে, সে তার প্রভুকে ভয় করে এবং আল্লাহর সৎ বান্দা বলে গণ্য হয়। আল্লাহ তাআলা সৎ কর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন এবং আল্লাহই তাঁর বান্দাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
‘‘আর যে আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ্ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক প্রদান করেন’’। (সূরা তালাকঃ ২-৩) কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলাই তাঁর বান্দাদের জন্য যথেষ্ট। যে ব্যক্তি মানুষকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আল্লাহকে নারাজ করবে, বান্দারা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনো উপকারে আসবেনা। সে ঐ যালেমের মতই, যে কিয়ামতের দিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস। আমি যদি রাসূলের দেখানো পথ অবলম্বন করতাম, তাহলে কতই না ভাল হত।
আল্লাহকে নারাজ করে মানুষকে সন্তুষ্টকারীর প্রশংসাকারীগণ বদনামকারীতে পরিণত হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত সমাজে অহরহ পরিলক্ষিত হয়। পরিণাম স্বরূপই এ রকম হয়ে থাকে। শেষ পরিণাম ভাল হয় কেবল মুত্তাকীদের জন্যই। প্রথমেই তাদের পরিণাম শুভ হয়না। যদিও তারা তা কামনা করে থাকে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) সূরা আল-ইমরানের ১৭৫ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।
২) সূরা তাওবার ১৮ নং আয়াতের তাফসীরও জানা গেল।
৩) সূরা আনকাবুতের ১০ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।
৪) ঈমান দুর্বল হয় এবং শক্তিশালী হয়।
৫) ঈমান দুর্বল হওয়ার কিছু আলামতও রয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে দুর্বল ঈমানের তিনটি আলামত বর্ণিত হয়েছে। (১) আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করা, (২) আল্লাহর দেয়া রিযিক ভোগ করে মানুষের গুণগান করা (৩) আল্লাহ যা দান করেন নি, তার ব্যাপারে মানুষকে দোষারোপ করা।
৬) ভয়কে শুধু আল্লাহর জন্যই খালেস করা ঈমানের অন্যতম দাবী।
৭) যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহকেই ভয় করে, তার ছাওয়াবের বর্ণনা রয়েছে।
৮) যে আল্লাহকে ভয় করেনা, তার শাস্তিও বর্ণিত হয়েছে।
[2] - ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ শারহুল আকীদাহ আল ওয়াসেতীয়াহ, হাদীছ নং- ৩০৪।