মুসলিম উম্মাহর কিছু লোক মূর্তি পূজা করবে - ১

আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ

‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে কিতাবের কিছু অংশ দেয়া হয়েছে? তারা জিবত এবং তাগুতকে বিশ্বাস করে’’। (সূরা নিসাঃ ৫১)

ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ ব্যতীত যারই এবাদত করা হয় বা যার জন্য কোনো প্রকার এবাদত পেশ করা হয়, তাই মূর্তি। সেটি হতে পারে কবর, হতে পারে গম্বুজ, মাযার, মৃত অলী-আওলীয়া, গাছ, পাথর বা অন্য যে কোনো সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

‘‘তোমরা তো আললাহ্র পরিবর্তে কেবল মূর্তিরই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যাদের এবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহ্‌র কাছে রিযিক তালাশ কর, তাঁর এবাদত করো এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তোমরা তারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে’’। (সূরা আনকাবুতঃ ১৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

قَالُوا نَعْبُدُ أَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِينَ (71) قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُونَ (72) أَوْ يَنْفَعُونَكُمْ أَوْ يَضُرُّونَ (73) قَالُوا بَلْ وَجَدْنَا آَبَاءَنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُونَ

‘‘তারা বলল, আমরা মূর্তিসমূহের পূজা করি এবং এদেরকেই আঁকড়ে থাকি। ইবরাহীম বললেনঃ তোমরা যখন আহবান করো, তখন তারা কি শুনে? অথবা তারা কি তোমাদের উপকার কিংবা ক্ষতি করতে পারে? তারা বললঃ না, তবে আমরা আমাদের বাপদাদাদেরকে অনুরূপ করতে দেখেছি’’। (সূরা শুআরাঃ ৭১-৭৪)

আল্লাহ তাআলার বাণীঃ ‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে কিতাবের কিছু অংশ দেয়া হয়েছে? তারা জিবতএবং তাগুতকে বিশ্বাস করে’’। ইবনে আবী হাতিম ইকরিমা হতে বর্ণনা করেন যে, হুয়াই ইবনে আখতাব এবং কাব বিন আশরাফ মক্কাবাসীদের নিকট আগমণ করলে মক্কার লোকেরা তাদেরকে বললঃ তোমরা তো আহলে কিতাব। তোমাদের নিকট কিতাবের জ্ঞান রয়েছে। সুতরাং তোমরা আমাদের ব্যাপারে এবং মুহাম্মাদের ব্যাপারে কিছু বল তো। তখন কাব ও হুহাই বললঃ আমাদেরকে প্রথমে তোমাদের সম্পর্কে এবং মুহাম্মাদ সম্পর্কে অবহিত করো। তখন মক্কাবাসীরা বললঃ আমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করি, উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট উট যবেহ করি, দুধের সাথে পানি মিশ্রিত করে মানুষকে উহা পান করাই, কয়েদীদেরকে মুক্ত করি এবং হাজীদেরকে পানি পান করাই। অপর পক্ষে মুহাম্মাদ তো লেজ কাটা, নির্বংশ। সে আমাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে এবং গিফার গোত্রের ঐ সমস্ত চোরেরাই তার অনুসরণ করেছে, যারা হাজীদের মালামাল চুরি করে। এখন তোমরাই বলো, আমরা ভাল না মুহাম্মাদ? তারা বললঃ তোমরাই অধিক উত্তম এবং সঠিক পথের অনুসারী। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلَاءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا سَبِيلًا

‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা প্রতিমা ও শয়তানকে বিশ্বাস করে এবং কাফেরদের সম্পর্কে বলে মুসলিমদের তুলনায় এরাই অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে’’। (সূরা নিসাঃ ৫১)[1]

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ هَلْ أُنَبِّئُكُمْ بِشَرٍّ مِنْ ذَلِكَ مَثُوبَةً عِنْدَ اللَّهِ مَنْ لَعَنَهُ اللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْهِ وَجَعَلَ مِنْهُمُ الْقِرَدَةَ وَالْخَنَازِيرَ وَعَبَدَ الطَّاغُوتَ أُولَئِكَ شَرٌّ مَكَانًا وَأَضَلُّ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ

‘‘বলোঃ আমি কি সেসব লোকদের কথা জানিয়ে দেব? যাদের পরিণতি আল্লাহর কাছে এর চেয়ে খারাপ। তারা এমন লোক যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন এবং যাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়েছে। যাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে তিনি বানর ও শুকর বানিয়ে দিয়েছেন। তারা তাগুতের পূজা করেছে। তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকেও অনেক দূরে। (সূরা মায়েদাঃ ৬০)

ব্যাখ্যাঃ ইমাম বগবী তাঁর তাফসীরে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ! তুমি বলোঃ আমি কি তোমাদেরকে ঐ কথার চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট বিষয়ের কথা জানিয়ে দিব? অর্থাৎ তারা যে বলেছিল হে মুসলিমগণ! দুনিয়া ও আখেরাতে তোমাদের চেয়ে অধিক কম ভাগ্যবান দ্বীনদার আর কাউকে দেখিনি এবং তোমাদের দ্বীনের চেয়ে অধিক নিকৃষ্ট আর কোন দ্বীনও দেখিনি। যেমন আল্লাহ তাআলা সূরা হজ্জের ৭২ নং আয়াতে বলেনঃ

قُلْ أَفَأُنَبِّئُكُمْ بِشَرٍّ مِنْ ذَلِكُمُ النَّارُ وَعَدَهَا اللَّهُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

‘‘বলো, আমি কি তোমাদেরকে তদপেক্ষা মন্দ কিছুর সংবাদ দেব? তা তো জাহান্নামের আগুন; আল্লাহ্ কাফেরদেরকে এর ওয়াদা দিয়েছেন। এটা কতই না নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল’’।

مثوبة শব্দটির অর্থ হচ্ছে ছাওয়াব ও প্রতিদান। তামীয হিসাবে এটি মানসুব বা যবর বিশিষ্ট হয়েছে।

যাদেরকে আল্লাহ তাআলা বানরে পরিণত করেছেন, তারা ছিল বনী ইসরাঈলের ঐসব লোক, যারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শনিবারে মাছ শিকার করেছিল। যারা ঈসা (আঃ)এর জন্য আসমান থেকে অবতারিত খাবারের সাথে কুফরী করেছিল আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শুকরে পরিণত করেছিলেন।

আলী বিন আবু তালহা[2] আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, বনী ইসরাঈলের মধ্য হতে যাদেরকে বানর ও শুকরে পরিণত করা হয়েছিল তারা ছিল শনিবারের বিধান লংঘনকারী। তাদের যুবকদেরকে বানরে পরিণত করা হয়েছিল এবং বৃদ্ধদেরকে শুকরে পরিণত করা হয়েছিল। আর আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে হতে কতক লোককে তাগুতের এবাদতকারী বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ তারা শয়তানের প্ররোচনার অনুসরণ করেছিল।

أُولَئِكَ شَرٌّ مَكَانًا وَأَضَلُّ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ ‘‘তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকে অনেক দূরে’: শয়তানের এবাদতকারীদের ঠিকানা নিকৃষ্টতর। অর্থাৎ তোমরা আমাদের ব্যাপারে যেই ধারণা পোষণ করে থাক, তার চেয়ে অধিকতর নিকৃষ্ট হবে তাদের ঠিকানা এবং তারা সঠিক পথেরও অনেক দূরে।

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ যদিও اسم التفضيل এর সীগাহ شر (অধিক নিকৃষ্ট) এবং أضل (অধিক গোমরাহ) অর্থে ব্যবহৃত, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে অপর পক্ষে মুমিনরাও গোমরাহিতে শামিল। অর্থাৎ এখানে এ কথা অকল্পনীয় যে, মুমিনরা নিকৃষ্ট এবং তাদের মধ্যেও গোমরাহী রয়েছে, আর তাদের তুলনায় কাফেররা অধিক নিকৃষ্ট এবং কাফেররা মুমিনদের তুলনায় সরল পথ হতে অনেক দূরে।[3] যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

أَصْحَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَئِذٍ خَيْرٌ مُسْتَقَرًّا وَأَحْسَنُ مَقِيلًا

‘‘সেদিন জান্নাতীদের বাসস্থান হবে অধিক উত্তম এবং বিশ্রামস্থল হবে সুন্দরতম’’। (সূরা ফুরকানঃ ২৪)

আল্লাহ তাআলা আসহাবে কাহাফের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেনঃ

قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا

‘‘যারা তাদের ব্যাপারে বিজয়ী হলো তারা বলল, আমরা অবশ্যই তাদের কবরের উপর মসজিদ তৈরী করবো’’ (সূরা কাহাফঃ ২১)

সাহাবী আবু সাঈদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حذو القذة بالقذة حَتَّى لَوْ دخلوا جُحْرَ ضَبٍّ لَدخلتتُمُوهُ قالوا: يَا رسول الله الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى. قَالَ: فَمَنْ؟»

‘‘তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী উম্মতদের অভ্যাস ও রীতি-নীতির ঠিক ঐ রকম অনুসরণ করবে, যেমন এক তীরের ফলা অন্য এক তীরের ফলার সমান হয়। অর্থাৎ তোমরা পদে পদে তাদের অনুসরণ করে চলবে। এমনকি তারা যদি দববএর[4] গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে। সাহাবীগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী উম্মত দ্বারা আপনি কি ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেনঃ তবে আর কারা?[5]

ব্যাখ্যাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হাদীছে বর্ণনা করেছেন যে, আহলে কিতাবদের থেকে যে সমস্ত আমল ও কর্মকান্ড প্রকাশিত হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা এই আয়াত গুলোতে এবং অন্যান্য আয়াতে তাদেরকে দোষারোপ করেছেন, তার সবগুলোই এই উম্মতের মধ্যে অবশ্যই প্রকাশিত হবে। এই কথা থেকেই গ্রন্থকারের শিরোনামের প্রমাণ মিলে।

سَنَن শব্দের ‘সীন’ বর্ণে যবর দিয়ে পড়তে হবে। এর অর্থ হচ্ছে পূর্ববর্তী লোকদের তরীকা।

حذو القذة এখানে حذوশব্দটি নসবের অবস্থায় আছে বলে واو বর্ণে যবর দিয়ে পড়তে হবে। আর القذة এর কাফ অক্ষরে পেশ দিয়ে পড়তে হবে। القذة শব্দটির বহু বচন القذذ। তীরের ফলা তথা ধারালো সম্মুখ ভাগকে কুয্যা বলা হয়। অর্থাৎ তোমরা পূর্ববর্তী লোকদের সকল কাজেই তাদের অনুসরণ করবে এবং তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে। যেমন একটি তীরের ফলা অন্য তীরের ফলার সদৃশ হয়ে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে খবর দিয়েছেন হুবহু তাই হয়েছে।

ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আমাদের আলেম সমাজের যে আলেম নষ্ট হবে, সে ইহুদীদের ন্যায়। আর আমাদের আবেদদের মধ্য হতে যারা নষ্ট হবে, তারা খৃষ্টানদের ন্যায়। ইমাম সুফিয়ানের বক্তব্য এখানেই শেষ।

মুসলিম শরীফে সাহাবী ছাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِىَ الأَرْضَ فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا وَإِنَّ أُمَّتِى سَيَبْلُغُ مُلْكُهَا مَا زُوِىَ لِى مِنْهَا وَأُعْطِيتُ الْكَنْزَيْنِ الأَحْمَرَ وَالأَبْيَضَ وَإِنِّى سَأَلْتُ رَبِّى لأُمَّتِى أَنْ لاَ يُهْلِكَهَا بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ وَأَنْ لاَ يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ وَإِنَّ رَبِّى قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنِّى إِذَا قَضَيْتُ قَضَاءً فَإِنَّهُ لاَ يُرَدُّ وَإِنِّى أَعْطَيْتُكَ لأُمَّتِكَ أَنْ لاَ أُهْلِكَهُمْ بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ وَأَنْ لاَ أُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ يَسْتَبِيحُ بَيْضَتَهُمْ وَلَوِ اجْتَمَعَ عَلَيْهِمْ مَنْ بِأَقْطَارِهَا حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا وَيَسْبِى بَعْضُهُمْ بَعْضًا»

‘‘আল্লাহ তাআলা গোটা যমীনকে একত্রিত করে আমার সামনে পেশ করলেন। তখন আমি যমীনের পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্ত দেখতে পেলাম। পৃথিবীর যতটুকু স্থান আমাকে দেখানো হয়েছে আমার উম্মতের শাসন বা রাজত্ব সেখান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করবে। লাল ও সাদা দু’টি ধনভান্ডার আমাকে দেয়া হল। আমি আমার রবের কাছে আমার উম্মতের জন্য এ আরজ করলাম, তিনি যেন আমার উম্মতকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ধ্বংস না করেন এবং তাদের নিজেদেরকে ব্যতীত বাহিরের কোন শত্রুকে তাদের উপর বিজয়ী বা ক্ষমতাসীন করে না দেন। যার ফলে সেই শত্রু তাদের সব কিছুকে নিজেদের জন্য হালাল মনে করবে। আমার রব আমাকে বললেন, হে মুহাম্মদ! আমি যখন কোন বিষয়ে ফয়সালা করি, তখন তার কোনো ব্যতিক্রম হয়না। আমি তোমাকে তোমার উম্মতের জন্য এ অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আমি তাদেরকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ধ্বংস করবোনা এবং তাদের নিজেদেরকে ছাড়া যদি সারা বিশ্বও তাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় তবুও এমন কোনো শত্রুকে তাদের উপর ক্ষমতাবান করবোনা যে তাদের জান, মাল, ও রাজত্ব এমনকি সবকিছুই বৈধ মনে করে লুটে নিবে। তবে তোমার উম্মতের লোকেরাই পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে একে অপরকে হত্যা করবে এবং একে অপরকে বন্দী করবে’’।[6]

ব্যাখ্যাঃ ছাওবান ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আযাদকৃত দাস। তিনি সবসময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথেই থাকতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তিনি সিরিয়ায় চলে যান এবং সিরিয়ার হিমস নগরীতে ৫৪ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন।

زَوَى لِىَ الأَرْضَ ‘‘যমীনকে একত্রিত করে আমার সামনে পেশ করলেন’’ঃ ইমাম তুরবুশতী (রঃ) বলেনঃ زويت الشيئ جمعته وقبضته অর্থাৎ এখানে زوي অর্থ একত্র করলেন এবং মুষ্ঠির মধ্যে নিলেন। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর দূরের স্থানকে নিকটবর্তী করা। এতে করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূরের বস্ত্তসমূহকে কাছের বস্ত্তসমূহ দেখার মতই দেখতে পেলেন।

মোটকথা আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জন্য যমীনকে ভাজ করলেন এবং তিনি একে এমনভাবে একত্রিত করলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়নায় দেখার মতই সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পেলেন।

ইমাম তীবি (রঃ)এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমার জন্য যমীনকে একত্রিত করলেন। এতে আমি পূর্ব ও পশ্চিমের ঐ সমস্ত যমীন দেখতে পেলাম, যা অচীরেই আমার উম্মতের লোকেরা দখল করে নিবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ পৃথিবীর যতটুকু স্থান আমাকে দেখানো হয়েছে আমার উম্মতের শাসন বা রাজত্ব ঠিক সেই স্থান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করবেঃ ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে খবরটি দিয়েছেন, সেভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নবুওয়াতের অন্যতম প্রমাণ। তাঁর উম্মতের রাজত্ব এত বিস্তার লাভ করেছিল যে, তা পশ্চিম দিকে মরক্কোর তানজা শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এবং পূর্ব দিকে খোরাসান, সুদূর মধ্য এশিয়া এবং সীহুন ও জীহুন নদীর অপর প্রান্তের রাজ্যগুলো পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি ভারত এবং চীনের বহু অঞ্চলও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। তবে দক্ষিণ ও উত্তর দিকে ইসলামী সাম্রাজ্য ততটা প্রসারিত হয়নি। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু বলেন নি যে, তাকে উত্তর বা দক্ষিণের অঞ্চল দেখানো হয়েছে এবং সে সম্পর্কে তাকে কোন খবর দেয়া হয়েছে কিংবা তিনি এমন কিছু বলেন নি যে, তাঁর উম্মতের বাদশাহী ঐ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

وَأُعْطِيتُ الْكَنْزَيْنِ الأَحْمَرَ وَالأَبْيَضَ ‘‘লাল ও সাদা দু’টি ধনভান্ডার আমাকে দেয়া হয়েছে’’- ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ এখানে পারস্যের বাদশা কিসরা এবং রোমের বাদশা কায়সার উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে তাদের রাজপ্রাসাদ এবং রাজ্যসমূহ উদ্দেশ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহর শপথ! রোম ও পারস্যের ধনভান্ডারসমূহ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা হবে। লাল ধনভান্ডার বলতে কায়সারের ধনভান্ডার উদ্দেশ্য। কেননা তাদের অধিকাংশ সম্পদ ছিল স্বর্ণ। আর সাদা বলতে কিসরার ধনভান্ডার উদ্দেশ্য। কারণ তাদের অধিকাংশ সম্পদ ছিল মুক্তা ও রৌপ্য। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে এই সুসংবাদ বাস্তবায়িত হয়েছে।

وَإِنِّى سَأَلْتُ رَبِّى لأُمَّتِى أَنْ لاَ يُهْلِكَهَا بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ ‘‘আমি আমার রবের কাছে উম্মতের জন্য এ আরজ করলাম, তিনি যেন আমার উম্মতকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে ধ্বংস না করেন’’- লেখকের মূল কপিতে بعامة শব্দে ‘ب’সহ এসেছে। এটি সহীহ মুসলিম শরীফের বর্ণনা। কোনো কোনো বর্ণনায় ‘ب’ ছাড়াই উল্লেখ আছে। ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ সম্ভবতঃ ‘বা’ অক্ষরটি অতিরিক্ত। কেননা عامة শব্দটি سَنة শব্দের সিফাত। সানাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে এমন দুর্ভিক্ষ, যাতে ব্যাপক প্রাণ হানি ঘটে।

তাদের নিজেদেরকে ব্যতীত বাহিরের শত্রুকে তাদের উপর বিজয়ী করবেন নাঃ অর্থাৎ মুসলমানদের উপর কাফেরদেরকে শক্তিশালী করবেন না। তবে উম্মতে মুহাম্মাদীর কতক লোকই তাদের কতককে হত্যা করবে এবং তাদের কতক লোক কতক লোককে বন্দী করবে। ইতিহাসের কিতাবসমূহে এ বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

فيستبيح بيضتهم তাদের সব কিছুকে নিজেদের জন্য হালাল মনে করবেঃ ইমাম জাওহারী (রঃ) বলেনঃ প্রত্যেক জিনিষের পূর্ণ অংশকে بيضة বলা হয়। কোন গোত্রের বাইযা বলতে সে জাতির সমগ্র অঞ্চল, আঙ্গিনা ও ময়দান উদ্দেশ্য। এর উপর ভিত্তি করে হাদীছের ব্যাখ্যায় বলা যায়, আল্লাহ তাআলা উম্মতে ইসলামীয়ার শত্রুদেরকে সমগ্র মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিবেন না। যাতে করে তারা মুসলমানদের সমস্ত অঞ্চল ও সমগ্র ভূমি দখল করে নিতে সক্ষম হয়। যদিও তাদের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ার সমস্ত লোক একত্রিত হয়। কেউ কেউ বলেছেনঃ بيضة দ্বারা মুসলিমদের অধিকাংশ লোক ও জামাআত উদ্দেশ্য। যদিও সংখ্যায় তারা কম হয়।

حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا وَيَسْبِى بَعْضُهُمْ بَعْضًا ‘‘তবে তোমার উম্মতের লোকেরাই পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে একে অপরকে হত্যা করবে এবং একে অপরকে বন্দী করবে’’ঃ বাহ্যিক অর্থে এখানে حتَّى শেষ সীমা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তোমার উম্মতের অবস্থা এ পর্যন্ত গিয়ে গড়াবে যে, তাদের মধ্য হতে কতক লোক অপর কতক লোককে ধ্বংস করবে।

[1] - এই হাদীছের সনদ দুর্বল। কারণ ইকরিমা তাবেয়ীদের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে তাঁর পক্ষে ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা অকল্পনীয়।

[2] - আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে আলী বিন আবু তালহার বর্ণনায় দুর্বলতা রয়েছে। কেননা তিনি ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে হাদীছ শুনেন নি। আল্লাহই ভাল জানেন।

[3] - আল্লাহ তাআলার বাণীঃ ‘‘তারাই অর্থাৎ কাফেররাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকেও অধিক দূরে’’। এখান থেকে এমন বুঝার সুযোগ নেই যে, মুমিনরাও নিকৃষ্ট এবং তারাও গোমরাহীর মধ্যে রয়েছে, তবে কাফেররা মুমিনদের তুলনায় অধিক নিকৃষ্ট এবং তারা মুমিনদের থেকে অধিক গোমরাহ। তবে এ কথা সত্য যে, কাফেররা অধিকতর নিকৃষ্ট এবং তারা অধিক গোমরাহ। কিন্তু ঈমানদারগণ তাদের ঈমান ও তাওহীদের বদৌলতে সুস্পষ্ট হেদায়াত ও কল্যাণের মধ্যে রয়েছেন। গ্রন্থকার এখানে জান্নাতবাসীদের শানে আল্লাহ তাআলার এই বাণী উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

أَصْحَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَئِذٍ خَيْرٌ مُسْتَقَرًّا وَأَحْسَنُ مَقِيلًا

‘‘সেদিন জান্নাতীদের বাসস্থান হবে অধিক উত্তম এবং বিশ্রামস্থল হবে সুন্দরতম’’। সুতরাং জাহান্নামবাসীদের জন্য অধিক উত্তম তো দূরের কথা কোন সাধারণ বাসস্থানও থাকবেনা এবং তাদের কোন বিশ্রামস্থলও থাকবেনা। তারা থাকবে পেরেশান, দুঃশ্চিন্তা এবং দুর্দশাগ্রস্ত। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার উমার (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নিকট প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন কুরাইশদের কিছু মহিলা তাঁর সাথে কথা বলছিল এবং তারা রাসূলের আওয়াজের উপর আওয়াজ উঁচু করছিল। উমার (রাঃ) যখন অনুমতি চাইলেন তখন মহিলারা দাঁড়িয়ে গেল এবং দ্রুত পর্দা করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমারকে অনুমতি দিলে তিনি প্রবেশ করলেন। রাসূল তখন হাসছিলেন। উমার বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি হাসছেন কেন? তিনি তখন বললেনঃ এই যে মহিলাগুলো আমার কাছে ছিল, তাদের কান্ড দেখে আমি আশ্চর্যবোধ করছি। তারা যখন তোমার আওয়াজ শুনেছে, কেবল তখন দ্রুত পর্দাগ্রহণ করেছে। উমার (রাঃ) তখন বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেই বেশী ভয় করা উচিৎ। অতঃপর উমার মহিলাদেরকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেনঃ ওহে স্বীয় নফসের দুশমনেরা! তোমরা আমাকে ভয় কর। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভয় করোনা? মহিলারা বললঃ

«نعم أَنْتَ أَفَظُّ وَأَغْلَظُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم»

‘‘হ্যাঁ, আপনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক অধিক রূঢ় ও কঠোর’’। (দেখুনঃ সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ উমার (রাঃ)এর ফযীলত। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর চরিত্র ও ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেনঃ

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ

‘‘আল্লাহ্‌র রহমতেই তুমি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছো। পক্ষান্তরে তুমি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত’’। (সূরা আল ইমরানঃ ১৫৯) সুতরাং উপরোক্ত ক্ষেত্রে ইসমে তাফযীলের সীগাহ ব্যবহৃত হলেও ইসমে তাফযীলের সাধারণ অর্থ গ্রহণ করে এটা বলা যাবে না যে, মুমিনগণ ও কাফেররা উভয়ই গোমরাহ। তবে কাফেররা মুমিনদের তুলনায় অধিক গোমরাহ। তেমনি বুখারী শরীফের উপরোক্ত হাদীছের আলোকে এটা বলা যাবেনা যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উমার (রাঃ) উভয়ই কঠোর, তবে উমার ইবনুল খাত্তাব রাসূলের চেয়ে অধিক কঠোর।

মোট কথা এখানেও خير (অধিক ভাল), أحسن (অধিক উত্তম), شر (অধিক নিকৃষ্ট) শব্দগুলো ইসমে তাফযীল হিসাবে ব্যবহৃত হলেও اسم التفضيل এর সাধারণ অর্থ গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও দু’টি বস্ত্ত নির্দিষ্ট কোন গুণে শরীক হলে সেই দু’টি বস্ত্তর একটিকে অন্যটির তুলনায় ঐ গুণে বেশী পরিমাণে গুণান্বিত করার জন্য ইসমে তাফজীলের সীগাহ (শব্দ) ব্যবহৃত হয়। আল্লাহই ভাল জানেন। (অনুবাদক)

[4] - মরুভূমিতে বসবাসকারী গুই সাপের ন্যায় এক ধরণের জন্তু বিশেষ।

[5] - বুখারী, অধ্যায়ঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণীঃ তোমরা অবশ্যই পূর্ববতী লোকদের রীতি-নীতির অনুসরণ করবে। তবে বুখারীর বর্ণনায় حذو القذة بالقذة - এই শব্দসমূহ নেই। তার স্থলে شبرا بشبر وذراعا بذراع শব্দগুলো রয়েছে। অর্থাৎ এক হাতের বিঘত যেমন অন্য হাতের বিঘতের সমান হয় এবং এক হাতের বাহু অন্য হাতের বাহুর সমান হয়।

[6] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ এই উম্মতের কতক লোক কতকের হাতে ধ্বংস হওয়া।