আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
‘‘তোমার রব এ ফয়সালা দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো এবাদত করোনা। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩)
......................................................
ব্যাখ্যাঃ এখানে قضى (ফয়সালা প্রদান করেছেন) শব্দটি আদেশ দিয়েছেন অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর বাণীঃ أن لاتعبدوا -এর মধ্যে রয়েছে لاإله -এর অর্থ। আর إلاإياه -এর মধ্যে রয়েছে إلا الله এর অর্থ। কালেমায়ে ইখলাস (لاإله إلاالله )-এর অর্থ এটিই। সুবহানাল্লাহ্! সুতরাং এই বিষয়টির (তাওহীদের) বিশদ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আসার পরও উম্মতের পরবর্তী যুগের লোকদের কাছে কিভাবে তা অস্পষ্ট থাকতে পারে?[7]
সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا
‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো। আর তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করো না’’।
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতে ঐ এবাদতের কথাই বর্ণনা করা হয়েছে, যার জন্য জিন ও মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে বান্দাদের উপর ফরযকৃত এবাদতের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে এবাদতের মধ্যে শির্ক করা থেকে নিষেধ করেছেন। যেই শির্ককে তিনি হারাম করেছেন, তা হচ্ছে ঐ শির্ক, যা এবাদতের মধ্যে হয়ে থাকে। সুতরাং আয়াতটি প্রমাণ করে যে, শির্ক থেকে দূরে থাকাই বান্দার এবাদত সঠিক হওয়ার প্রধান ও মূল শর্ত। শির্ক থেকে দূরে না থাকলে এবাদত সঠিক হবে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘তারা যদি শির্ক করত, তাহলে তাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যেত’’। (সূরা আনআমঃ ৮৮) আল্লাহ্ তাআলা আরে বলেনঃ
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ، بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِينَ
‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্বের নবীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যদি আল্লাহ্র শরীক স্থির করো, তাহলে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং আল্লাহ্রই এবাদত করো এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকো’’। (সূরা যুমারঃ ৬৫-৬৬) এ আয়াতদ্বয়ে مفعول মাফউলকে فاعبد শব্দের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী ব্যাকরণের একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে প্রথম فعل (ক্রিয়া) অতঃপর فاعل (কর্তা), তারপর مفعول তথা ক্রিয়া পতিত হওয়ার স্থলকে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমে প্রথমেই যদি মাফউল উল্লেখ করা হয়, তখন ফেল বা ক্রিয়াকে মাফউলের উপর সীমিত করা হয়। অর্থাৎ কেবল আল্লাহরই এবাদত কর, অন্যের নয়। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
‘‘আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’’। (সূরা ফাতিহাঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা এই তাওহীদকেই সূরা যুমারের ১১ নং আয়াতে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ
‘‘বলোঃ আমি একমাত্র আল্লাহ্র এবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি, দ্বীনকে তাঁর জন্য নিবেদিত করে’’। মূলতঃ দ্বীন ও এবাদত একই বিষয়। যে সমস্ত কাজ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয় হতে নিষেধ করা হয়েছে, তা বর্জন করার নামই হচ্ছে এবাদত। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ
والأمر والنهي الذي هو دينه + وجزاؤه يوم المعاد الثاني
আদেশ ও নিষেধই হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। আর এগুলো পালন করার পুরস্কার পাওয়া যাবে কিয়ামতের দিন। ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, দ্বীনের মূল বুনিয়াদ হচ্ছে তাওহীদুল ইবাদাহ তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। সুতরাং এ কথাটি সবসময় মনে রাখা জরুরী।
সূরা আনআমের ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
‘‘তুমি বলোঃ এসো! আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করোনা, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে্যর কারণে হত্যা করোনা আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যেয়োনা, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করোনা; তবে ন্যায়ভাবে হত্যা করার কথা ভিন্ন। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ’’। (সূরা আনআমঃ ১৫১)
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের উপর শির্ক হারাম করেছেন এবং আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবেনা এর মাধ্যমে তিনি শির্ক থেকে নিষেধও করেছেন।
সুতরাং জানা যাচ্ছে যে, বান্দা ছোট-বড় যত গুনাহ্-এর মাধ্যমে আল্লাহর নাফরমানী করে থাকে, তার মধ্যে শির্কই হচ্ছে সর্বাধিক বড় ও ভয়াবহ।
এই উম্মতের পরবর্তী যামানার অধিকাংশ লোক জাহেলিয়াতের লোকদের মতই এই সর্বাধিক ভয়াবহ হারাম কাজটিতে তথা শির্কে লিপ্ত হয়েছে। এরা কবর, গম্বুজ, বৃক্ষ, পাথর, শয়তান, জিন এবং মানুষের এবাদত করছে। যেমন জাহেলিয়াতের লোকেরা লাত, মানাত, উজ্জা, হুবল এবং অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করত। এই শির্ককেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তাদেরকে যখন তাওহীদের দিকে আহবান করা হল, তখন তারা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের কল্পিত মাবুদগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে মুসলিমদের প্রতি ক্রোধান্বিত হল। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থা বর্ণনা করেছেনঃ
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
‘‘যখন এককভাবে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন পরকালে অবিশ্বাসীদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়, আর যখন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠে’’। (সূরা যুমারঃ ৪৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِذَا ذَكَرْتَ رَبَّكَ فِي الْقُرْآنِ وَحْدَهُ وَلَّوْاْ عَلَى أَدْبَارِهِمْ نُفُوراً
‘‘আর যখন তুমি কুরআনে একমাত্র তোমার পালনকর্তার কথা উল্লেখ করো, তখন অনীহা বশতঃ ওরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪৬) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ
‘‘তাদের যখন বলা হতো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা দাম্ভিকতা প্রদর্শন করতো এবং বলতোঃ আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব? (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬)
মক্কার মুশরিকরা ভাল করেই জানত যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলার অর্থই হচ্ছে, তাদের ঐ শির্ককে প্রত্যাখ্যান করা, যাতে তারা লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা ঐ তাওহীদকেই গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল, যার প্রতি কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ প্রমাণ বহন করে।
সুতরাং ঐ যামানার মুশরিকরাই এই উম্মতের বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মুসলিমের চেয়ে কালেমায়ে তায়্যেবার অর্থ সম্পর্কে অধিক অবগত ছিল। বিশেষ করে মক্কার মুশরিকরা এই উম্মতের ঐ সমস্ত আলেমদের চেয়ে কালেমা তায়্যেবার অর্থ অধিক অবগত ছিল, যাদের কাছে শরীয়তের কতক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে এবং তর্ক শাস্ত্রেও রয়েছে তাদের যথেষ্ট পান্ডিত্য। কিন্তু ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’-এর বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে তারা শির্কে লিপ্ত হয়েছে, যা তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর ‘তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত’ সম্পর্কেও তাদের কোন জ্ঞান না থাকার কারণে তারা তা অস্বীকার করেছিল। শুধু তাই নয়; বরং নিজেদের মতের সমর্থনে এবং তা প্রচারে তারা কিতাবও রচনা করেছে। তাদের ধারণা ছিল, তাদের মতই সঠিক। অথচ তাদের সে ধারণা প্রসূত মতটিই সম্পূর্ণ বাতিল। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে সঠিক ইসলাম লোকদের কাছে এমনই অপরিচিত হয়ে গেছে যে, ভাল বিষয় মন্দে পরিণত হয়েছে আর মন্দ বিষয় ভাল রূপ ধারণ করেছে। এ অবস্থাতেই পরবর্তী প্রজন্মের ছোটরা বড় হয়েছে এবং যুবকরা বৃদ্ধ হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاء»
‘‘অপরিচিত অবস্থায় তথা অল্প সংখ্যক লোকের মাধ্যমে সঠিক ইসলামের সূচনা হয়েছে। অচিরেই তা সূচনার অবস্থায় ফেরত যাবে। সুতরাং এই গরীব তথা অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য সুখবর।[8] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ
«افْتَرَقَتِ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى أَوْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَتَفَرَّقَتِ النَّصَارَى عَلَى إِحْدَى أَوْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلُّهَا فِى النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى»
‘‘ইহুদীরা বিভক্ত হয়েছিল ৭১ দলে। খৃষ্টানরা বিভক্ত হয়েছিল ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। মাত্র একটি দল ব্যতীত বাকীদের সকলেই জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেটি কোন্ দল? তিনি বললেন, আমি এবং আমার সাহাবীগণ যেই পথে আছি, সেই পথে যারা থাকবে, তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত দল’’।[9]
এই উম্মতের সম্মানিত তিন যুগ চলে যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবে পরিণত হয়েছে। দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তাওহীদের মূল শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো এবাদত করা যাবেনা। সেই সঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা ও তাঁর রাসূল যে সমস্ত এবাদত ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন এবং যে পদ্ধতিতে করার আদেশ দিয়েছেন তা ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধদিতে আল্লাহর এবাদত করা যাবেনা। এ বিষয়টি বর্তমানে অবহেলিত। অধিকাংশ মুসলিমের এবাদতে শির্ক-বিদআতের মিশ্রণ ঘটেছে। তারপরও আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে পৃথিবী এমন লোক থেকে খালী হয়নি, যারা দলীল-প্রমাণসহ তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে তাওহীদের দিকে আহবান করছে। আল্লাহ্ তাআলা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে হেদায়াতের এমন দলীল নাযিল করেছেন, যাতে তাওহীদের মূলমর্ম পরিত্যাগ না হয়। এ বিরাট অনুগ্রহের জন্য আল্লাহ্ তাআলার যথাযোগ্য প্রশংসা করা ও শুকরিয়া আদায় করা জরুরী।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ
«من أراد ان ينظر إلى وصية محمد صلى الله عليه وسلم التى عليها خاتمه فليقرأ قوله تعالى قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا..... وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيْمًا»
‘‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোহরাঙ্কিত অসিয়ত দেখতে চায়, সে যেন আল্লাহ তাআলার এ বাণী পড়ে নেয়, হে মুহাম্মদ বলঃ এসো! তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হলো, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না . . . . আর এটাই হচ্ছে আমার সরল-সোজা পথ’’।[10] (সূরা আনআমঃ ৫২-৫৩)
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উপদেশকে সেই অসীয়তের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা লিখে মোহর লাগানো হয়েছে। তা আর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়নি। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত পাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত উম্মতকে একটি বিষয়েরই (তাওহীদের) দাওয়াত দিয়েছেন। এতে তিনি কোন পরিবর্তন সাধন করেন নি। তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর পক্ষ হতে অফুরন্ত দুরূদ ও সালাম। বনী শায়বান গোত্রের নেতা মাফরুক যখন দেখল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদ, মেলা ও হজ্জের মৌসুমে আরব গোত্রসমূহকে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছেন, তখন সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ হে কুরাইশী লোক! তুমি আর কিসের দাওয়াত দিচ্ছ? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (১৫১) وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (১৫২) وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘‘তুমি বলোঃ এসো, আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করোনা, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে্যর কারণে হত্যা করোনা আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যেয়োনা, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করোনা; কিন্তু ন্যায়ভাবে হলে ভিন্ন কথা। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ। এতিমদের ধন-সম্পদের কাছেও যেয়োনা; কিন্তু উত্তম পন্থায়- যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়। ওজন ও মাপ পূর্ণ কর ন্যায় সহকারে। আমি কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেইনা। যখন তোমরা কথা বল, তখন সুবিচার কর। যদিও তা নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধে হয়। আল্লাহ্র অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলোনা। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও’’। (সূরা আনআমঃ ১৫১-১৫৩) এই মুহকাম আয়াতগুলোতে একটি আদেশ এবং একটি নিষেধ রয়েছে। এ রকমই আল্লাহ্ তাআলা ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর ব্যাপারে সূরা বাকারার ১৩১-১৩২ নং আয়াতে বলেনঃ
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (১৩১) وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
‘‘স্মরণ করো, যখন তাকে তার প্রতিপালক বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম। এরই অসিয়ত করেছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে। ইয়াকুবও একই অসীয়ত করেছে তার সন্তানদেরকে। সে বলেছিলঃ হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না’’।
সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিছনে একটি গাধার পিঠে বসে ছিলাম। তিনি তখন আমাকে ডাক দিয়ে বললেনঃ
«يَا مُعَاذُ هَلْ تَدْرِى حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلاَ يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ قَالَ لاَ تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا»
‘‘হে মুআয! তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে? আর আল্লাহর উপর বান্দার কি হক আছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো যারা তার সাথে কাউকে শরিক করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি কি এ সুসংবাদ লোকদেরকে জানিয়ে দেব না? তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এ সুসংবাদ দিওনা। তাহলে তারা এবাদত ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে’’।[11]
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ পূর্বের আয়াতগুলোর অর্থ বহন করার কারণেই শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) আয়াতগুলোর পর পরই এ হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জবানের বাণীঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আল্লামা ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা আল্লাহর শরীয়ত মোতাবেক তাঁর এবাদত করবে, নিজের মন যেভাবে চায় সেভাবে নয়। কারণ নিজের মন মত এবাদত করলে তা শয়তানের এবাদতে পরিণত হয়। আর আল্লাহর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। এই দু’টি অর্থাৎ আল্লাহর এবাদত করা এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত শরীয়ত অনুযায়ী এবাদত করাই নাজাতের একমাত্র মাধ্যম। কতই না সুন্দর এ দু’টি মাধ্যম। আল্লাহর ক্রোধ ও তাঁর জাহান্নাম থেকে কেবল সেই রক্ষা পাবে, যে এই দু’টি বিষয়ের উপর আমল করবে। কিন্তু পরবর্তী যুগের কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে। আবার কেউ বিদআতের পথ বেছে নিয়েছে আবার কেউ উভয়টিতেই লিপ্ত হয়েছে।
সুতরাং যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর হক তথা এবাদতের কোন অংশ যেমন দুআ করা, সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে প্রদান করল, যে সেই এবাদতের হকদার নয় সে তাগুতের প্রতি ঈমান আনয়ন করল, আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করল এবং কুফরী করল।
حَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে যারা তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন নাঃ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, বিবেক দ্বারা আল্লাহর উপর কোন অত্যাবশ্যকীয় ওয়াজিব বা হক নির্ধারণ করা যাবেনা। যেমন ধারণা করে থাকে মুতাযেলা সম্প্রদায়। তাদের ধারণা সৎ লোককে জান্নাতে স্থান দেয়া এবং পাপীকে জাহান্নামে পাঠানো আল্লাহর উপর ওয়াজিব। মূলতঃ আল্লাহ্ তাআলার উপর কোন ওয়াজিব নেই। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলার একনিষ্ঠ ও তাওহীদপন্থী বান্দারা যেহেতু তাদের ইচ্ছায়, এবাদতে, আশা-আকাঙ্খায় ও ভয়-ভীতির সময় আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দারস্থ হয়না এবং তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে তথা সকল প্রকার এবাদতের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও নৈকট্য ও সন্তুষ্টি কামনা করেনা, তাই তাদেরকে শাস্তি না দেয়ার বিষয়টি আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তাঁর নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) জিন ও মানব জাতি সৃষ্টির রহস্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা গেল। আর তা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা এবং তাঁর এবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করা।
২) এককভাবে আল্লাহর এবাদতই হচ্ছে তাওহীদ। কারণ এটা নিয়েই বিবাদ।
৩) যার তাওহীদ ঠিক নেই, তার এবাদতও ঠিক নেই। আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ وَلا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ এর অর্থও তাই।
৪) রাসূল পাঠানোর হিকমত ও রহস্য জানা গেল।
৫) সকল উম্মতই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের আওতাধীন।
৬) সকল নবী-রাসূলের দ্বীন ছিল এক ও অভিন্ন। আর তা হচ্ছে ইসলাম।[12]
৭) সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তাগুতকে অস্বীকার করা ব্যতীত আল্লাহ্ তাআলার এবাদতের কল্পনাও করা যায়না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্ সবই শুনেন ও জানেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)[13]
৮) আল্লাহর এবাদত ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, সেগুলোই তাগুত হিসেবে গণ্য।
৯) সালাফে-সালেহীনের কাছে সূরা আনআমের উল্লেখিত তিনটি মুহকাম আয়াতের বিরাট মর্যাদার কথা জানা যায়। এতে দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এর প্রথমটিই হচ্ছে; শির্কের প্রতিবাদ ও তা নিষিদ্ধতার ব্যাপারে।
১০) সূরা ইস্রায় কতগুলো মুহকাম আয়াত রয়েছে এবং তাতে আঠারোটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বিষয়গুলোর সূচনা করেছেন তাঁর এই বাণী দ্বারাঃ
لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولَا
‘‘স্থির করোনা আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন উপাস্য। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে’’। (সূরা ইসরাঃ ২২) আর এই প্রসঙ্গের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন তাঁর উক্ত বাণী দ্বারাঃ
وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَدْحُورًا
‘‘আর আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করোনা। তাহলে নিন্দিত ও আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’’। (সূরা ইসরাঃ ৩৯) আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাঁর এই বাণীঃ ﴾ذَلِكَ مِمَّا أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ﴿ ‘‘এটা ঐ হিকমতের অন্তর্ভুক্ত, যা তোমার প্রতিপালক তোমাকে অহী মারফত দান করেছেন’’ দ্বারা এ বিষয়গুলোর সুমহান মর্যাদাকে উপলব্ধি করার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।
১১( এ অধ্যায়ে সূরা নিসার ঐ আয়াতটি জানা গেল, যাতে দশটি হক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যার সূচনা হয়েছে আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারাঃ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো; তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনা আর পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো’’।
১২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তিম অসিয়তের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। আর তা হচ্ছে উম্মতকে শির্ক থেকে সতর্ক করা এবং তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে নিষেধ করার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৩) আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা জরুরী।
১৪) বান্দা যখন আল্লাহর হক আদায় করবে তখন আল্লাহ তাআলার উপর বান্দার হক কী? তা জানা গেল।
১৫) অধিকাংশ সাহাবীই এ বিষয়টি জানতেন না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মানুষের কাছে মাসআলাটি গোপন রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ তা মানুষকে বলে দিলে তারা আল্লাহর সীমাহীন দয়া ও অনুগ্রহের উপর ভরসা করে আমল ছেড়ে দিতে পারে। তাই মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুর সময়ই কেবল ইল্ম গোপন করার অপরাধে অপরাধী হওয়ার ভয়ে তা বলে দিয়েছেন। সুতরাং মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু জীবিত থাকা অবস্থায় এ বিষয়টি সম্পর্কে অধিকাংশ সাহাবীরই জ্ঞান ছিল না।
১৬) কোন বিশেষ স্বার্থে ইল্ম গোপন রাখার বৈধতা রয়েছে।
১৭) আনন্দ দায়ক বিষয়ে কোন মুসলিমকে সুখবর দেয়া মুস্তাহাব।
১৮) আল্লাহর অপরিসীম রহমতের উপর ভরসা করে আমল বাদ দেয়ার ভয়।
১৯) অজানা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির এই কথা বলা উচিৎ যে, الله ورسوله أعلم অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন।[14]
২০) কাউকে বাদ রেখে অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে জ্ঞান দান করার বৈধতা সম্পর্কে জানা গেল।
২১) গাধার পিঠে আরোহন করার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়-নম্রতার প্রমাণ মিলে। সেই সঙ্গে তাঁর পিছনে মুআযকে বসার সুযোগ দেয়ার মধ্যে তাঁর বিনয়ী হওয়ার বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট।
২২) একই পশুর পিঠে একজনের পিছনে অন্য ব্যক্তি আরোহনের বৈধতা জানা গেল।
২৩) মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা প্রমাণিত হল।
২৪) তাওহীদের মর্যাদা ও গুরুত্ব জানা গেল।
১) সেকালের মুশরিকরা শুধু সুখ-শান্তি ও আমোদ-প্রমোদে থাকার সময়ই আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করত। আর তাদের উপর বিপদাপদ ও মসীবত আপতিত হলে তারা তাদের বাতিল মাবুদগুলোকে ভুলে যেত এবং খালেসভাবে আল্লাহকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ কুরআনেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে, তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কেই ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে’’। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫)
কিন্তু আপনি যদি বর্তমান কালের এক শ্রেণীর কবর ও মাজার পূজারী মুসলিমদের দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, তারা সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শরীক করে থাকে। বিপদে পড়েও তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কল্পিত অলী-আওলীয়াকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করে। অথচ মক্কার মুশরিকরা কখনই এ ধরণের কাজ করত না। এমন কি তারা বিশ্বাসও করত না যে, বিপদ হতে উদ্ধারের ক্ষমতা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো আছে। শুধু তাই নয়, তারা একমাত্র আল্লাহকেই সৃষ্টি করা, রিযিক দেয়া বৃষ্টি বর্ষণ করা এবং জীবন-মরণের মালিক মনে করত। সুতরাং যেই মুশরিক শুধু সুখের সময় আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করে আর যেই নামধারী মুসলিম সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থায় আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাদের উভয়ের মধ্যে নামধারী মুসলিমের শির্কটিই অধিক ভয়াবহ। সুতরাং বিষয়টি ভালভাবে বুঝা উচিৎ।
২) মক্কার কুরাইশরা শুধু আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্যপ্রাপ্ত লোকদেরকেই আল্লাহর সাথে শরীক করত। যেমন লাত, মানাত, উজ্জা এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়াকে আল্লাহর সাথে শরীক করত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেনঃ
وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا
‘‘তারা বলছে: তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে’’। (সূরা নূহঃ ২৩) বুখারী ও মুসলিম শরীফে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেনঃ এগুলো হচ্ছে নূহ (আঃ)এর জাতির সৎ লোকদের নাম। তারা যখন মারা গেল তখন শয়তান নূহ (আঃ)-এর কাওমের জীবিত লোকদের নিকট আগমণ করে বললঃ তোমরা তাদের মজলিসে তথা বসার স্থানে তাদের ছবি স্থাপন কর। তাদের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কারণ তাদের ছবি দেখলে তোমরা আল্লাহর এবাদতের আগ্রহ পাবে। তারা শয়তানের প্রস্তাবকে সুন্দর মনে করে তাই করল। কিন্তু তখনই তারা এগুলোর এবাদত শুরু করেনি। ঐ যুগের লোকেরা যখন মারা গেল এবং তাদের স্থলে নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটল, তখন শয়তান এই নতুন যুগের নতুন প্রজন্মের নিকট আগমণ করল। উল্লেখ্য যে, এই নতুন লোকেরা ঐ সমস্ত অলী-আওলীয়ার আসল ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল এবং তাওহীদের শিক্ষা হতে বিচ্যুত হয়েছিল। তাই শয়তান দ্বিতীয়বার আগমণ করে যখন তাদেরকে এগুলোর এবাদতের বা এগুলোর উসীলা দিয়ে আল্লাহর এবাদতের আহবান জানাল, তখন ইলম না থাকার কারণে তারা শয়তানের সেই আহবানে সাড়া দিল এবং এদের এবাদত শুরু হয়ে গেল। এখান থেকেই শির্কের সূচনা হয় এবং বনী আদমের মধ্যে শির্ক প্রবেশ করে।
মোট কথা পূর্ব যামানার লোকেরা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত সৎ লোক, নিষ্পাপ ফেরেশতা, আল্লাহর অনুগত গাছপালা, পাথর ইত্যাদি মাসুম (নিষ্পাপ) বস্ত্তকে আল্লাহর সাথে শরীক করত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমান কালের নামধারী অসংখ্য মুসলিম আল্লাহর সাথে আল্লাহর এমন মাখলুককে শরীক করে, যারা সর্বাধিক নিকৃষ্ট ও পাপিষ্ঠ। তাদের পাপাচার ও অশ্লীলতা জনগণের কাছে সুপ্রকাশিত। তা সত্ত্বেও লোকেরা তাদেরকে আহবান করছে, তাদের কাছে দুআ করছে, সিজদাহ করছে এবং তাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে। সুতরাং যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্থ করে আর যারা আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দাকে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তারা উভয়েই কি সমান। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় দলের শির্ক প্রথম দলের শির্কের চেয়ে অধিক ভয়াবহ। সুতরাং বিষয়টি ভাল করে ভেবে দেখা উচিৎ।
৩) মক্কার মুশরিকদের শির্ক ছিল শুধু তাওহীদে উলুহীয়ার ক্ষেত্রেই। তাওহীদে রুবুবীয়াকে তারা মেনে চলত। তারা যে আল্লাহকে আসমান-জমিনসহ সকল বস্ত্তর একমাত্র সৃষ্টিকারী, রিযিক দাতা, জীবন-মরণের মালিক এবং পৃথিবীর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক মনে করত, কুরআনই তার সাক্ষ্য দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴾وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ﴿ ‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো- কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ্’’। (সূরা লুকমানঃ ২৫) কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে এমন লোকও মুসলিম হওয়ার দাবী করছে, যারা আল্লাহর রুবুবীয়াতেও অলী-আওলীয়াকে শরীক করছে। নিম্নের উদাহরণগুলো মন দিয়ে পড়লে ও গভীরভাবে উপলদ্ধি করলেই বিষয়টি সহজভাবে অনুধাবন করা যাবে।
১) ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা নামক বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মৃতকে জীবিত করার যে গল্পটা আছে তা নিম্নরুপঃ
শামসুদ্দীন তাব্রীজী নামের এক লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে পীর সাহেব কেবলা বলত। এবার আসি মূল গল্পে। একদা হযরত পীর সাহেব কিবলা রোম শহরের দিকে রওয়ানা হইলেন। পথিমধ্যে ঝুপড়ির ভেতর এক অন্ধ বৃদ্ধকে লাশ সামনে নিয়া কাদঁতে দেখিলেন। হুজুর বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিলে বৃদ্ধ উত্তর করিলেন, ‘‘হুজুর এই পৃথিবীতে আমার খোঁজ-খবর করিবার আর কেউ নাই, একটি পুত্র ছিল সে আমার যথেষ্ট খেদমত করিত, তাহার ইন্তেকালের পর সে একটি নাতি রাখিয়া যায়। সেই ১২ বছরের নাতি একটা গাভী পালিয়া আমাকে দুগ্ধ খাওয়াইত এবং আমার খেদমত করিত, তার লাশ আমার সম্মুখে দেখিতেছেন। এখন উপায় না দেখিয়া কাঁদিতেছি’’। হুজুর বলিলেন এ ঘটনা কি সত্য? বৃদ্ধ উত্তর করিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তখন হুজুর বলিলেনঃ "হে ছেলে আমার হুকুমে দাঁড়াও"। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং দাদুকে জড়াইয়া ধরিল, বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করিল ‘‘তুমি কিরুপে জিন্দা হইলে’’। ছেলে জবাব দিল, ‘‘আল্লাহর অলী আমাকে জিন্দা করেছেন’’। (নাউযুবিল্লাহ) তারপর ঐ অঞ্চলের বাদশাহ হুজুরের এই খবর পেয়ে উনাকে তলব করিলেন। উনাকে পরে জিজ্ঞেস করিলেন "আপনি কি বলিয়া ছেলেটিকে জিন্দা করিয়াছেন"। হুজুর বলিলেন আমি বলেছি ‘‘হে ছেলে আমার আদেশে জিন্দা হইয়া যাও’’। অতঃপর বাদশাহ বলিলেন, ‘‘যদি আপনি বলিতেন আল্লাহর আদেশে’’। হুজুর বলিলেন "মাবুদ! মাবুদের কাছে আবার কি জিজ্ঞেস করিব। তাহার আন্দাজ নাই (নাউ-যুবিল্লাহ)। এই বৃদ্ধের একটি মাত্র পুত্র ছিল তাহাও নিয়াছে, বাকী ছিল এই নাতিটি যে গাভী পালন করিয়া কোনরুপ জিন্দেগী গোজরান করিত, তাহাকেও নিয়া গেল। তাই আমি আল্লাহ পাকের দরবার থেকে জোরপূর্বক রুহ নিয়া আসিয়াছি’’। (নাউ-যুবিল্লাহ)।
এরপর বাদশাহ বলিলেন আপনি শরীয়াত মানেন কিনা? হুজুর বলিলেন ‘‘নিশ্চয়ই! শরীয়াত না মানিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শাফায়াত পাইব না’’। বাদশাহ বলিলেন, ‘‘আপনি শির্ক করিয়াছেন, সেই অপরাধে আপনার শরীরের সমস্ত চামড়া তুলে নেওয়া হইবে’’। এই কথা শুনিয়া আল্লাহর কুতুব নিজের হাতের অঙ্গুলি দ্বারা নিজের পায়ের তলা হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত শরীরের চামড়া ছাড়াইয়া তা বাদশাহর কাছে ফেলিয়া জঙ্গলে চলিয়া গেলেন। পরদিন ভোরবেলা যখন সূর্য উঠিল তার চর্মহীন গায়ে তাপ লাগিল। তাই তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন ‘‘হে সূর্য, আমি শরীয়াত মানিয়াছি, আমাকে কষ্ট দিওনা’’। তখন ওই দেশের জন্য সূর্য অন্ধকার হইয়া গেল। দেশের মধ্যে শোরগোল পড়িয়া গেল। এই অবস্থা দেখিয়া বাদশাহ হুজুরকে খুঁজিতে লাগিলেন। জঙ্গলে গিয়া হুজুরের কাছে বলিলেনঃ শরীয়াত জারি করিতে গিয়া আমরা কি অন্যায় করিলাম, যাহার জন্য আমাদের উপর এমন মুসিবত আনিয়া দিলেন। তখন হুজুর সূর্য কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ আমি তোমাকে বলিয়াছি আমাকে কষ্ট দিওনা, কিন্তু দেশবাসীকে কষ্ট দাও কেন? সূর্যকে বশ করা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা বলা মাত্র সূর্য আলোকিত হইয়া গেল। আল্লাহ্ পাক তাহার ওলীর শরীর ভাল করিয়া দিলেন।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! উপরোক্ত বানোয়াট কাহিনীতে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে এতে একাধিক শির্ক বিদ্যমান। যেমনঃ
ক) কুরআন বলছে, জীবিতকে মৃত্যু দেয়া এবং মৃতকে জীবিত করা একমাত্র আল্লাহর কাজ। কোন নবী বা অলী মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘হে নবী! তুমি জিজ্ঞেস করো, তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও তোমরা ভয় করছনা?’’ (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় মক্কার মুশরিকরাও এ কথা বিশ্বাস করতনা যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত বা জীবিতকে মৃত্যু দান করার ক্ষমতা রাখে। অথচ মুসলিম নামধারী পীর ও মুরীদগণ তা বিশ্বাস করে থাকে।
এমনি আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। এটি একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট। এমন কি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজেযা থাকা সত্ত্বেও মৃতকে জীবিত করার মুজেযা তাঁকে দেয়া হয় নি। এটি ছিল একমাত্র ঈসা (আঃ)এর মুজেযা।
এ ব্যাপারে তাদের দাপট দেখে মনে হয় তাদের কল্পিত অলীরা মৃতকে জীবিত করার ক্ষেত্রে ঈসা (আঃ) এর চেয়েও বেশী ক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন قُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ বলে অর্থাৎ তুমি আল্লাহর আদেশে জীবিত হও। যেমন আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)কে লক্ষ্য করে বলেনঃ (وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي) ‘‘এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে’’। (সূরা মায়িদাঃ ১১০)
আর পীর ও মুরীদদের বিশ্বাস হচেছ, তাদের অলীগণ قُمْ بِإِذْني অর্থাৎ আমার আদেশে উঠে দাঁড়াও এ কথা বলে মৃতকে জীবিত করে থাকেন।
সুতরাং কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, কোন পীর বা অলী মৃতকে জীবিত করতে পারে, তাহলে সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।
খ) চন্দ্র-সূর্য, নদ-নদী, দিবা-রাত্রি ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো হুকুমে চলে না। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘আল্লাহ্, যিনি উধর্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শন সমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনিই ভূমন্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দুই প্রকার (জোড়ায় জোড়ায়) সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি দ্বারা আবৃত করেন। এতে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তা করে।’’ (সূরা রাদঃ ২-৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে, চন্দ্র ও সূর্যকে কর্মে নিয়োজিত করেছে? তবে তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ্’। তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? (সূরা আনকাবুতঃ ৬১)
২) বর্তমান সময়ের সুফীরা বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীতে কতিপয় আবদাল, কুতুব এবং আওলীয়া আছেন, যাদের হাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী পরিচালনার কিছু কিছু দায়িত্ব সোপর্দ করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা তাদের ইচ্ছামত পৃথিবীর কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন।
ফাযায়েলে আমাল বইয়ে এই ধরণের একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, হজরত শাইখুল হাদীছ বলেছেনঃ আমি আমার আববাজানের নিকট প্রায়ই একটা ঘটনা শুনতাম। উহা এই যে, জনৈক ব্যক্তি বিশেষ কোন প্রয়োজনে পানি পথে যাইতেছিল। পথিমধ্যে যমুনা নদী পড়িল, তাহার অবস্থা তখন এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, নৌকা চলাও মুশকিল ছিল, লোকটি পেরেশান হইয়া গেল। লোকজন তাহাকে বলিল অমুক জঙ্গলে একজন কামেল লোক থাকেন, তাহার নিকট গিয়া স্বীয় প্রয়োজন পেশ কর। তিনি নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করিবেন। তবে তিনি প্রথমে রাগ করিবেন। তাহাতে তুমি নিরাশ হইও না। লোকটি তাহাদের কথায় জঙ্গলের মধ্যে গিয়া দেখিলেন সেই দরবেশ তাহার বিবি বাচ্চাসহ একটি ঝুপড়ির মধ্যে বাস করিতেছে। সেই ব্যক্তি স্বীয় প্রয়োজন ও যমুনার অবস্থা বর্ণনা করিল, দরবেশ প্রথমে অভ্যাস মোতাবেক রাগ করিয়া বলিল, আমার হাতে কী আছে? আমি কী করিতে পারি? লোকটি কান্নাকাটি করিয়া আপন সমস্যার কথা বলিল, তখন দরবেশ বলিলঃ যাও, যমুনার কাছে গিয়া বলঃ আমাকে ঐ ব্যক্তি পাঠাইয়াছে, যে জীবনে কখনো কিছু খায় নাই এবং বিবির সহিত সহবাস করে নাই। লোকটি যমুনায় গিয়া দরবেশের কথা জানাইল। যমুনা তাহার কথা মত শান্ত হইয়া গেল। সেই লোকটি পার হইয়া যাওয়ার পর যমুনা আবার ভীষণ আকার ধারণ করিল। (দেখুনঃ ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা)
প্রিয় পাঠক বৃন্দ লক্ষ্য করুন, এটি এমন একটি বিশ্বাস যা মক্কার মুশরিকরাও পোষণ করতো না। তারা যখন সাগর পথে ভ্রমণ করার সময় বিপদে আক্রান্ত হত, তখন তারা সকল দেব-দেবীর কথা ভুলে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আল্লাহ তাআলা মক্কার মুশরিকদের সেই কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫) অথচ বর্তমান সময়ের অসংখ্য মুসলিমকে দেখা যায় তারা চরম বিপদের সময়ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে কল্পিত অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করে থাকে, যা মক্কার মুশরিকদের শির্ককেও হার মানিয়েছে। কেননা মক্কার লোকেরা শুধু সুখের সময়ই আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো, কিন্তু বিপদের সময় তারা সেগুলোকে ভুলে গিয়ে এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শির্ক করছে। এদিক থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বর্তমানের মাজার পূজারী মুসলিমের শির্কের চেয়ে মক্কার আবু জাহেল ও আবু লাহাবদের শির্ক অধিক হালকা ছিল।
এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, غوث অর্থ হচ্ছে ত্রাণকর্তা। এটি আল্লাহর গুণ। কোন মানুষ গাউছ হতে পারে না। ঢাকা শহরের মহাখালীতে মাসজিদে গাউছুল আযম নামে বিশাল একটি মসজিদ রয়েছে। আমরা সকলেই জানি এখানে গাউছুল আযম দ্বারা আব্দুল কাদের জিলানীকে বুঝানো হয়েছে। আল-গাউছুল আল-আযাম অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা। যারা আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলো, তারা কি এ ধরণের কথার মাধ্যমে আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) কে আল্লাহর সমান করে দেন নি? শুধু তাই নয় সুফীদের একটি দল বিশ্বাস করে যে, আব্দুল কাদের জিলানী নিজ হাতে লাওহে মাহফুযে নতুন করে বৃদ্ধি করতে বা তা থেকে কিছু কমানোরও অধিকার রাখেন। (নাউযুবিল্লাহ)
৩) বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম নামধারী লোক বিশ্বাস করে যে, তাদের মাশায়েখ ও অলীগণ বিপদ হতে উদ্ধার করতে সক্ষম। তাই বিপদে তারা তাদের অলীদেরকে আহবান করে থাকে। তারা বলে থাকে মদদ ইয়া আব্দুল কাদের জিলানী, হে উমুক, হে উমুক ইত্যাদি। এভাবে বিপদাপদে পড়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আহবান করা প্রকাশ্য শির্কের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
তুমি বলে দাও, আমি আমার নিজের কল্যাণ এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতোনা। আমি তো শুধু একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদ দাতা ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আ’রাফঃ ১৮৮)
এমনি আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা প্রমাণ করে বতর্মান কালের মাজারপন্থী ও পীরতন্ত্রের অনুসারী মুসলিমরা তাওহীদে রুবুবীয়াতেও শির্ক করছে। যা থেকে মক্কার মূর্তিপূজক মুশরিকরাও বেঁচে থাকত। সুতরাং এ কথা সহজেই বোধগম্য যে, যেই মুসলিম ইসলামের দাবী করে, কিন্তু তাওহীদে উলুহীয়াতে তথা আল্লাহর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করার সাথে সাথে রুবুবীয়াতেও আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার চেয়ে যে মুশরিক শুধু তাওহীদে উলুহীয়াতে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার শির্ক ঐ নামধারী মুসলিমের শির্কের চেয়ে অধিকতর হালকা। সুতরাং দলীল-প্রমাণসহ উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, বর্তমান কালের মুসলিমদের শির্ক মক্কার মুশরিকদের শির্কের চেয়েও অধিক ভয়াবহ। সত্যিই চিন্তার বিষয়!
এখানে বিশেষভাবে একটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে, বিদআতীরা উপরোক্ত ঘটনাগুলোকে অলীদের কারামত বলে প্রচার করে থাকে। আমরা বলবো যে, কারামতে আওলীয়া সত্য। পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে এবং এই উম্মতের মধ্যে অনেক কারামত প্রকাশিত হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম আকীদাহ হচ্ছে অলীদের কারামতে বিশ্বাস করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে শক্তিশালী করা, তাঁর অলীদেরকে সাহায্য করা এবং তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে স্বীয় কুদরত প্রকাশ করার জন্য অলীদের মাধ্যমে কারামত প্রকাশ করেন। চাই তা কুদরত সম্পর্কিত হোক বা কাশফ সম্পর্কিত হোক। তবে এগুলো বর্ণনা করার সময় এমন বাক্য পরিহার করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, অলীরা নিজের ক্ষমতা বলেই কারামত প্রকাশ করে থাকে এবং যখন ইচ্ছা তখনই তারা তা প্রকাশ করতে পারে। এ জাতিয় বাক্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা আবশ্যক; বরং এগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করার প্রয়োজন হলে এভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে কেবল আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও বড়ত্বের বিষয়টি ফুটে উঠে; অলীদের নয়। সাহাবী ও তাবেয়ীদের মধ্যে এ রকম অনেক কারামত প্রকাশিত হয়েছে। সাহাবী ও তাবেয়ীদের পরে যেহেতু প্রচুর মিথ্যা ঘটনা তৈরী করা হয়েছে, তাই পরবর্তীকালের অলীদের কারামত বর্ণনায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের অন্যতম কিতাব আলামুস্ সুন্নাহ, শরহুল আকীদাহ আলওয়াসেতীয়া এবং শরহুল আকীদাহ আত তাহাবীয়ায় কারামতে আওলীয়ার মূলনীতি এবং উহার বেশ কিছু উদাহরণ বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য কিতাবগুলো পড়ার অনুরোধ রইল।
[8] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ অপরিচিত অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছে-এ কথার বর্ণনা। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ১৪৬, সহীহু সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৩২৩৬, সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭৩।
[9] -ইবনু আবী আসেম কিতাবুস সুন্নাতে বর্ণনা করেছেন, হাদীছ নং- ৬৩, ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন সহীহা, হাদীছ নং- ১৪৯২, সহীহু সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৪০৬৩। ইমাম ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য হাফেযগণ বলেনঃ এই হাদীছটি বিভিন্ন সনদে সহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটি সুনান এবং অন্যান্য গ্রন্থেও রয়েছে। মুহাম্মাদ বিন নযরও কিতাবুল ইতেসামে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন।
[10] - হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুনঃ যঈফু সুনানে তিরমিজী, হাদীছ নং- ৫৯৩।
[11] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঘোড়া ও গাধার নাম রাখা।
[12] - ইসলামই ছিল সকল নবী-রাসূলের দ্বীন। কুরআনে এই কথার অনেক প্রমাণ রয়েছে। নূহ (আঃ) বলেনঃ
فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُم مِّنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ
‘‘তোমরা যদি আমার নসীহত থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তা হলে জেনে রাখো যে, আমি তো তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাইনি৷ আমার প্রতিদান তো আল্লাহর কাছেই৷ আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে আমি যেন মুসলিম হিসেবে থাকি’’। (সূরা ইউনূসঃ ৭২) আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)এর ব্যাপারে বলেনঃ
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
‘‘ইবরাহীম ইহুদী ছিল না, খৃস্টানও ছিল না বরং সে তো ছিল একজন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং সে কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না ৷ ইবরাহীমের যারা অনুসরণ করেছে তারাই তার সাথে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক রাখার অধিকারী’’। (সূরা আল ইমরানঃ ৬৭) ইবরাহীম খলীল (আঃ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল একসাথে সুর মিলিয়ে বলেছেনঃ
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا ِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
‘‘হে আমাদের রব! আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (অনুগত) বানিয়ে দাও৷ আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম৷ তোমার এবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুল-ত্রুটি মাফ করে দাও৷ তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (وَوَصَّىٰ بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ) ‘‘ঐ একই মিল্লাতের পথে চলার জন্য তিনি তার সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলেন এবং এরই উপদেশ দিয়েছিলেন ইয়াকুবও তার সন্তানদেরকে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার সন্তানেরা! আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করোনা’’। (সূরা বাকারঃ ১৩২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (وَقَالَ مُوسَىٰ يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ) ‘‘মুসা তার কওমকে বলল, হে লোকেরা! যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে থাকো তাহলে কেবল তার উপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো’’। (সূরা ইউনুসঃ ৮৪) সাবার রাণী বলেছিলেনঃ (رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين) ‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর বড়ই জুলুম করেছি এবং এখন আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ রাববুল আলামীনের আনুগত্য কবুল করে নিয়েছি’’। (নামালঃ ৪৪)
[13] - মোটকথা তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো ইসলাম পরিশুদ্ধ হবেনা। কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহএর মর্মার্থ এটিই। সুতরাং لاإله এই কথার মাধ্যমে প্রত্যেক ঐ তাগুতকে অস্বীকার করা হয়েছে, আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত করা হয়। আর إلا الله কালেমার এই অংশের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর একত্ববাদ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ) ‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। সুতরাং আল্লাহর এবাদতকে একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাগুতের এবাদতকে অন্য একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং একজন মানুষ কেবল তখনই মুসলিম বলে গণ্য হবে, যখন সে আল্লাহর এবাদত করবে এবং একই সাথে তাগুত থেকে দূরে থাকবে।
আর طاغوت শব্দের উৎপত্তি হয়েছে الطغيان থেকে। তাগুত বলা হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে, যে অন্যায় ও বিদ্রোহে সীমা লংঘন করে। আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ ﴾اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى﴿ ‘‘এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে। কেননা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে’’। (সূরা তোহাঃ ২৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ) ‘‘যে সময় পানির তুফান সীমা অতিক্রম করলো তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে আরোহন করিয়েছিলাম’’। (সূরা আলহাক্কাহঃ ১১) অর্থাৎ পানি যখন অত্যন্ত বেড়ে গেল। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ﴾ فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ ﴿ ‘‘তাই সামূদ জাতিকে একটি সীমাহীন বিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে’’। (সূরা আলহাক্কাহঃ ৫) অর্থাৎ বিকট ও ভয়াবহ একটি চিৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তি বা বিষয় সীমা অতিক্রম করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। শয়তানকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণে এবং সীমালংঘন করার কারণে তাগুত বলা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে মাবুদের এবাদত করা হয়, সেই মাবুদ যদি উক্ত এবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাকে তাগুত বলা হয়। যাদুকর এবং গণক উভয়ই তাগুত। এমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেক মাবুদই তাগুত।
[14] - আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক জানেন, -এই কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় বলা বৈধ ছিল। এখন শুধু আমরা বলবোঃ আল্লাহই ভাল জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর সালাফদেরকে এই কথা বলতে শুনা যেতনা যে, الله ورسوله أعلم (আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)।