বড় শির্ক ও ছোট শির্ক বড় শির্কের প্রকারভেদ মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি

আনুগত্যের শির্ক বলতে বিনা ভাবনায় তথা শরীয়তের গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ ছাড়াই হালাল, হারাম, জায়েয, নাজায়েযের ব্যাপারে আলেম, বুযুর্গ বা উপরস্থ কারোর সিদ্ধান্ত অন্ধভাবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়াকে বুঝানো হয়।

এ জাতীয় আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«اِتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ وَالْـمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوْا إِلَـهًا وَّاحِدًا، لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ»

‘‘তারা আল্লাহ্ তা’আলাকে ছেড়ে নিজেদের আলিম, ধর্ম যাজক ও মার্ইয়ামের পুত্র মাসীহ্ (’ঈসা) (আ.) কে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে শুধু এতটুকুই আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই ইবাদাত করবে। তিনি ব্যতীত সত্যিকার কোন মা’বূদ নেই। তিনি তাদের শির্ক হতে একেবারেই পূতপবিত্র’’। (তাওবাহ্: ৩১)

’আদি’ বিন্ হাতিম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

أَتَيْتُ النَّبِيَّصَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِيْ عُنُقِيْ صَلِيْبٌ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ: يَا عَدِيُّ! اِطْرَحْ عَنْكَ هَذَا الْوَثَنَ، وَسَمِعْتُهُ يَقْرَأُ فِيْ سُوْرَةِ بَرَاءَةٍ:

«اِتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ»

قَالَ: أَمَا إِنَّهُمْ لَمْ يَكُوْنُوْا يَعْبُدُوْنَهُمْ وَلَكِنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا أَحَلُّوْا لَـهُمْ شَيْئًا اِسْتَحَلُّوْهُ وَإِذَا حَرَّمُوْا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوْهُ

‘‘আমি নবী (সা.) এর দরবারে গলায় স্বর্ণের ক্রুশ ঝুলিয়ে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে ডেকে বলেন: হে ’আদি’! এ মূর্তিটি (ক্রুশ) গলা থেকে ফেলে দাও। তখন আমি তাঁকে উক্ত আয়াতটি পড়তে শুনেছি। ’আদি’ বলেন: মূলতঃ খ্রিষ্টানরা কখনো তাদের আলিমদের উপাসনা করতো না। তবে তারা হালাল ও হারামের ব্যাপারে বিনা প্রমাণে আলিমদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতো। আর এটিই হচ্ছে আলিমদেরকে প্রভু মানার অর্থ তথা আনুগত্যের শির্ক’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩০৯৫)

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«وَلاَ تَأْكُلُوْا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوْهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُوْنَ»

‘‘যে পশু একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নামে জবাই করা হয়নি (বরং তা জবাই করা হয়েছে অন্য কারোর নামে অথবা এমনিতেই মরে গেছে) তা হতে তোমরা এতটুকুও খেয়ো না। কারণ, তা আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্যতার শামিল। শয়তানরা নিশ্চয়ই তাদের অনুগতদের কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে তোমাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্যে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা নিশ্চিতভাবে মুশ্রিক হয়ে যাবে। (আন’আম : ১২১)

ইসলাম বিরোধী কালা কানুনের আলোকে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসকদের বিচার-মীমাংসা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া এ শির্কের অন্তর্ভুক্ত। যেমন: সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার বা মদ জাতীয় হারাম বস্ত্তকে হালাল করার নীতি। পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে ওয়ারিসি সম্পত্তির সমবন্টন বা পর্দাহীনতার নীতি। বহুবিবাহের মতো হালাল বস্ত্তকে হারাম করার নীতি। এ সকল ব্যাপারে প্রশাসকদের অকুন্ঠ আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে হারাম ও একান্ত শির্ক। কারণ, মানব জীবনের প্রতিটি শাখায় তথা যে কোন সমস্যায় কোর’আন ও হাদীসের সঠিক সিদ্ধান্ত সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়াই সকল মোসলমানের একান্ত কর্তব্য। আর এটিই হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার গোলামী ও একত্ববাদের একান্ত দাবি। কেননা, আইন রচনার সার্বিক অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«أَلاَ لَهُ الْـخَلْقُ وَالأَمْرُ»

‘‘জেনে রাখো, সকল সৃষ্টি তাঁরই এবং হুকুমের অধিকারীও একমাত্র তিনি। তিনিই হুকুম দাতা এবং তাঁর হুকুমই একান্তভাবে প্রযোজ্য’’। (আ’রাফ : ৫৪)

আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:

«وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيْهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللهِ»

‘‘তোমরা যে কোন বিষয়েই মতভেদ করো না কেন উহার মীমাংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই দিবেন’’। (শূরা : ১০)

তিনি আরো বলেন:

«فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ، ذَلِكَ خَيْرٌ وَّأَحْسَنُ تَأْوِيْلًا»

‘‘তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে উহার মীমাংসার জন্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূলের দিকেই প্রত্যাবর্তন করো। যদি তোমরা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে থাকো। এটিই হচ্ছে তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর পরিসমাপ্তি’’। (নিসা’ : ৫৯)

উক্ত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবিত হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার আইনানুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করা শুধু ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই নয় বরং তা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত এবং তা সত্যিকারার্থে আল্লাহ্ তা’আলার অধিকার বাস্তবায়ন ও নিজ আক্বীদা-বিশ্বাস সুরক্ষণের শামিল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানব রচিত বিধি-বিধানের আলোকে সকল বিচার-ফায়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিচ্ছে পরোক্ষভাবে সে যেন এ বিধান রচয়িতাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করছে।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«أَمْ لَـهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوْا لَـهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ»

‘‘তাদের কি এমন কোন (আল্লাহ্’র অংশীদার) দেবতাও রয়েছে যারা আল্লাহ্ তা’আলার অনুমোদন ছাড়া তাদের জন্য বিধি-বিধান রচনা করে’’। (শূরা : ২১)

তিনি আরো বলেন:

«وَإِنْ أَطَعْتُمُوْهُمْ إِنَّكُمْ لَـمُشْرِكُوْنَ»

‘‘তোমরা যদি তাদের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা নিশ্চিতভাবে মুশরিক হয়ে যাবে’’। (আন’আম : ১২১)

আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে মানব রচিত আইন গ্রহণকারীদেরকে ঈমানশূন্য তথা কাফির বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ يَزْعُمُوْنَ أَنَّهُمْ آمَنُوْا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيْدُوْنَ أَنْ يَّتَحَاكَمُوْا إِلَى الطَّاغُوْتِ وَقَدْ أُمِرُوْا أَنْ يَّكْفُرُوْا بِهِ، وَيُرِيْدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُّضِلَّهُمْ ضَلاَلًا بَعِيْدًا، ... فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا»

‘‘আপনি কি ওদের ব্যাপারে অবগত নন? যারা আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাব ও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের উপর ঈমান এনেছে বলে ধারণা পোষণ করছে। অথচ তারা তাগূতের (আল্লাহ্ বিরোধী যে কোন শক্তি) ফায়সালা কামনা করে। বস্ত্ততঃ তাদেরকে ওদের বিরুদ্ধাচরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। শয়তান চায় ওদেরকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করতে। ... অতএব আপনার প্রতিপালকের কসম! তারা কখনো ঈমানদার হতে পারে না যতক্ষণ না তারা আপনাকে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক বানিয়ে নেয় এবং আপনার সকল ফায়সালা নিঃসঙ্কোচে তথা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়’’। (নিসা’ : ৬০-৬৫)

অতএব যারা নিয়ত মানব রচিত বিধি-বিধান বাস্তবায়নের আহবান করছে পরোক্ষভাবে তারা বিধি-বিধান রচনা ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে অন্যকে আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার বানাচ্ছে। আর যারা আল্লাহ্ তা’আলার বিধান ছাড়া অন্য বিধানের আলোকে বিচারকার্য পরিচালনা করছে তারা নিশ্চিতভাবেই কাফির। চাই তারা উক্ত বিধানকে আল্লাহ্ তা’আলার বিধান চাইতে উত্তম, সম পর্যায়ের বা আল্লাহ্ তা’আলার বিধান এর পাশাপাশি এটাও চলবে বলে ধারণা করুকনা কেন। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের উক্ত আয়াতে বলেছেন: তারা ঈমান আছে বলে ধারণা পোষণ করে। বাস্তবে তারা ঈমানদার নয়। দ্বিতীয়তঃ তারা তাগূতকে বিচারক মানে ; অথচ তার বিরুদ্ধাচরণ ঈমানের অঙ্গ।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«فَمَنْ يَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى»

‘‘অতএব যে ব্যক্তি তাগূতকে অবিশ্বাস এবং আল্লাহ্ তা’আলাকে বিশ্বাস করে সেই প্রকৃতপক্ষে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরলো। অর্থাৎ ঈমানদার হলো’’। (বাক্বারাহ্ : ২৫৬)

আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাঁর বিধান বিমুখতাকে মুনাফিকের আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তিনি বলেন:

«وَإِذَا قِيْلَ لَـهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ رَأَيْتَ الْـمُنَافِقِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًا»

‘‘যখন তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার বিধান ও রাসূল (সা.) এর প্রতি আহবান করা হয় তখন আপনি মুনাফিকদেরকে আপনার প্রতি বিমুখ হতে দেখবেন’’। (নিসা’ : ৬১)

আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বিধান ছাড়া অন্য বিধানকে জাহিলী (বর্বর) যুগের বিধান বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন:

«أَفَحُكْمَ الْـجَاهِلِيَّةِ يَبْغُوْنَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُّوْقِنُوْنَ»

‘‘তারা কি জাহিলী যুগের বিধান চাচ্ছে? দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার বিধান চাইতে সুন্দর বিধান আর কে দিতে পারে?’’ (মা’য়িদাহ্ : ৫০)

ইব্নে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহু) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:

يُنْكِرُ تَعَالَى عَلَى مَنْ خَرَجَ عَنْ حُكْمِ اللهِ تَعَالَى الـْمُشْتَمِلِ عَلَى كُلِّ خَيْرٍ النَّاهِيْ عَنْ كُلِّ شَرٍّ، وَعَدَلَ إِلَى مَا سِوَاهُ مِنَ الآرَاءِ وَالأَهْوَاءِ وَ الاِصْطِلاَحَاتِ الَّتِيْ وَضَعَهَا الرِّجَالُ بِلاَ مُسْتَنَدٍ مِنْ شَرِيْعَةِ اللهِ كَمَا كَانَ أَهْلُ الْـجَاهِلِيَّةِ يَحْكُمُوْنَ بِهِ مِنَ الْـجَهَالاَتِ وَالضَّلاَلاَتِ، وَكَمَا تَحْكُمُ بِهِ التَّتَارُ مِنَ السِّيَاسَاتِ الْـمَأْخُوْذِ عَنْ جَنْكِيْزْخَانْ الَّذِيْ وَضَعَ لَهُمُ ‘‘الْيَاسِقَ‘‘ وَهُوَ عِبَارَةٌ عَنْ كِتَابِ أَحْكَامٍ اقْتَبَسَهَا مِنْ شَرَائِعَ شَتَّى مِنَ الْيَهُوْدِيَّةِ وَالنَّصْرَانِيَّةِ وَالْمِلَّةِ الإِسْلاَمِيَّةِ ، وَفِيْهَا كَثِيْرٌ مِّنَ الأَحْكَامِ أَخَذَهَا عَنْ مُجَرَّدِ نَظْرِهِ وَهَوَاهُ، فَصَارَتْ فِيْ بَنِيْهِ شَرْعًا يُقَدِّمُوْنَهَا عَلَى الْـحُكْمِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَهُوَ كَافِرٌ يَجِبُ قِتَالُهُ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى حُكْمِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ، فَلاَ يُحْكَمُ بِسِوَاهُ فِيْ قَلِيْلٍ أَوْ كَثِيْرٍ

‘‘আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত আয়াতে সে ব্যক্তিকে দোষারোপ করছেন যে ব্যক্তি সার্বিক কল্যাণময় আললাহ্ তা’আলার বিধান ছেড়ে মানব রচিত বিধি-বিধানের পেছনে পড়েছে। যেমনিভাবে জাহিলী যুগের লোকেরা ভ্রষ্টতা ও মূর্খতার মাধ্যমে এবং তাতার্রা চেঙ্গিজ খান রচিত ‘‘ইয়াসিক’’ নামক সংবিধানের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করতো। যা ছিলো ইহুদী, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের সংবিধানসমূহ থেকে বিশেষভাবে চয়িত। তাতে চেঙ্গিজ খানের ব্যক্তিগত মতামতও ছিল। ধীরে ধীরে তার সন্তানরা এ সংবিধানকে জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছে। যার গুরুত্ব তাদের নিকট কোর’আন ও হাদীসের চাইতেও বেশি। যে এমন করলো সে কাফির হয়ে গেলো। তার সাথে যুদ্ধ করা সবার উপর ওয়াজিব যতক্ষণনা সে আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর বিধানের দিকে ফিরে আসে। বর্তমান যুগে অধিকাংশ রাষ্ট্রে মানব রচিত যে সংবিধান চলছে তা অনেকাংশে তাতারদের সংবিধানেরই সমতুল্য’’। (আল্ ইরশাদ্ : ১০২-১০৩)

যে কোন মুফতি সাহেবের ফতোয়া কোর’আন ও হাদীসের বিপরীত জেনেও নিজের মন মতো হওয়ার দরুন তা মেনে নেয়া এ শির্কের অন্তর্ভুক্ত। সঠিক নিয়ম হচ্ছে, কোন গবেষকের কথা কোর’আন ও হাদীসের সঠিক প্রমাণভিত্তিক হলে তা মেনে নেয়া। নতুবা নয়।

ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূল (সা.) ছাড়া সবার কথাই গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য হতে পারে। এ জন্য তাঁরা সবাইকে কোর’আন ও হাদীসের সঠিক প্রমাণ ছাড়া কারোর কথা অন্ধভাবে মেনে নিতে নিষেধ করেছেন।

ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:

حَرَامٌ عَلَى مَنْ لـَمْ يَعْرِفْ دَلِيْلِيْ أَنْ يُفْتِيَ بِكَلاَمِيْ

‘‘যে ব্যক্তি (কোর’আন ও হাদীসের) দলীল সম্পর্কে অবগত নয় (যে কোর’আন ও হাদীসের উপর ভিত্তি করে আমি ফতোয়া দিয়েছি) তার জন্য আমার কথানুযায়ী ফতোয়া দেয়া হারাম’’। (শা’রানী/মীযান, ফুতূহাতি মাক্কিয়্যাহ্, দিরাসাতুল্ লাবীব : ৯০ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৭)

তিনি আরো বলেন:

إِذَا رَأَيْتُمْ كَلاَمَنَا يُخَالِفُ ظَاهِرَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ فَاعْمَلُوْا بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ، وَاضْرِبُوْا بِكَلاَمِنَا الْحَائِطَ

‘‘যখন তোমরা দেখবে আমার কথা কোর’আন ও হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী তখন তোমরা কোর’আন ও হাদীসের উপর আমল করবে এবং আমার কথা দেয়ালে ছুঁড়ে মারবে’’।

(শা’রানী/মীযান ১/৫৭ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৭-৯৮)

জনৈক ব্যক্তি ‘‘দানিয়াল’’ (কেউ কেউ তাঁকে নবী মনে করেন) এর কিতাব নিয়ে কূফায় প্রবেশ করলে ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) তাকে হত্যা করতে চেয়েছেন এবং তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

أَكِتَابٌ سِوَى الْقُرْآنِ وَالْـحَدِيْثِ

‘‘কোর’আন ও হাদীস ছাড়া অন্য কিতাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে কি?’’ (শা’রানী/মীযান, হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, সাবীলুর্ রাসূল : ৯৯)

তিনি আরো বলেন:

إِذَا جَاءَ الْـحَدِيْثُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَى الرَّأْسِ وَالْعَيْنِ، وَإِذَا جَاءَ عَنِ الصَّحَابَةِ  فَعَلَى الرَّأْسِ وَالْعَيْنِ، وَإِذَا جَاءَ عَنِ التَّابِعِيْنَ فَهُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ

‘‘রাসূল (সা.) ও সাহাবাদের বাণী সদা শিরোধার্য। তবে তাবেয়ীনদের বাণী তেমন নয়। কারণ, তারাও পুরুষ আমরাও পুরুষ। অর্থাৎ আমরা সবাই একই পর্যায়ের। সুতরাং প্রত্যেকেরই গবেষণার অধিকার রয়েছে’’। (যাফারুল্ আমানী : ১৮২ আল্ ইর্শাদ্ : ৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৮)

ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে আরো বলা হয়:

سُئِلَ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى: إِذَا قُلْتَ قَوْلًا وَكِتَابُ اللهِ يُخَالِفُهُ؟ قَالَ: اتْرُكُوْا قَوْلِيْ لِكِتَابِ اللهِ، قِيْلَ: إِذَا كَانَ قَوْلُ الرَّسُوْلِ يُخَالِفُهُ؟ قَالَ: اتْرُكُوْا قَوْلِيْ لِخَبْرِ الرَّسُوْلِ ، قِيْلَ: إِذَا كَانَ قَوْلُ الصَّحَابَةِ يُخَالِفُهُ؟ قَالَ: اتْرُكُوْا قَوْلِيْ لِقَوْلِ الصَّحَابَةِ

’’ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো: আপনার ফতোয়া যদি কোর’আনের বিপরীত বলে সাব্যস্ত হয় তখন আমাদের কি করতে হবে? তিনি বললেন: আমার ফতোয়া ছেড়ে দিয়ে তখন কোর’আনকে মানবে। বলা হলো: আপনার ফতোয়া যদি হাদীসের বিপরীত সাব্যস্ত হয়? তিনি বললেন: আমার ফতোয়া ছেড়ে দিয়ে তখন হাদীসকে মানবে। বলা হলো: আপনার ফতোয়া যদি সাহাবাদের বাণীর বিপরীত সাব্যস্ত হয়? তিনি বললেন: আমার ফতোয়া ছেড়ে দিয়ে তখন সাহাবাদের বাণী অনুসরণ করবে’’। (রাওযাতুল্ ’উলামা, ’ইক্ব্দুল্ জীদ্ : ৫৪ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৭)

ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) আরো বলেন:

لاَ تُقَلِّدْنِيْ وَلاَ تُقَلِّدَنَّ مَالِكًا وَلاَ غَيْرَهُ، وَخُذِ الْأَحْكَامَ مِنْ حَيْثُ أَخَذُوْا مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ

‘‘তুমি আমি আবু হানীফা এবং মালিক এমনকি অন্য যে কারোর অন্ধ অনুসরণ করোনা। বরং তারা যেভাবে হুকুম-আহ্কাম সরাসরি কোর’আন ও হাদীস থেকে সংগ্রহ করেছে তোমরাও সেভাবে সংগ্রহ করো’’।

(শা’রানী/মীযান, ’হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, ত’ুহ্ফাতুল্ আখ্ইয়ার্ : ৪ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৯)

ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

كُلُّنَا رَادٌّ وَمَرْدُوْدٌ عَلَيْهِ إِلاَّ صَاحِبَ هَذَا الْقَبْرِ

‘‘আমাদের সকলের মত গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য হতে পারে তবে রাসূল (সা.) এর মত অনুরূপ নয়। বরং তা সদা গ্রাহ্য। কারণ, তা ওহি তথা ঐশী বাণী’’। (ইক্ব্দুল্ জীদ্, আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির ২/৯৬ ইর্শাদুস্ সালিক ১/২২৭ আল্ ইর্শাদ্ : ৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ১০১)

তিনি আরো বলেন:

إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ، أُخْطِئُ وَأُصِيْبُ، فَانْظُرُوْا فِيْ رَأْيِيْ، فَكُلُّ مَا وَافَقَ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ فَخُذُوْهُ، وَكُلُّ مَا لَمْ يُوَافِقْ فَاتْرُكُوْهُ

‘‘আমি মানুষ। সুতরাং আমার কথা কখনো শুদ্ধ হবে। আবার কখনো অশুদ্ধ হবে। তাই তোমরা আমার কথায় গবেষণা করে যা কোর’আন ও হাদীসের অনুরূপ পাবে তাই মেনে নিবে। অন্যথায় তা প্রত্যাখ্যান করবে’’।

(জাল্বুল্ মান্ফা’আহ্, ’হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, জামি’উ বায়ানিল্ ’ইল্মি ওয়া ফায্লিহী ২/৩৩ আল্ ইহ্কাম ফী উসূলিল্ আহ্কাম ৬/১৪৯ ঈক্বাযুল্ হিমাম ৭২ আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির ২/৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ১০১-১০২)

ইমাম শাফি’য়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

مَثَلُ الَّذِيْ يَطْلُبُ الْعِلْمَ بِلاَ حُجَّةٍ كَمَثَلِ حَاطِبِ لَيْلٍ يَحْمِلُ حُزْمَةَ حَطَبٍ، وَفِيْهِ أَفْعَى تَلْدَغُهُ وَهُوَ لاَ يَدْرِيْ

‘‘যে ব্যক্তি কোর’আন ও হাদীসের কোন প্রমাণ ছাড়া জ্ঞানার্জন করে সে ওব্যক্তির ন্যায় যে রাত্রি বেলায় কাঠ কেটে বোঝা বেঁধে বাড়ি রওয়ানা করলো অথচ তাতে সাপ রয়েছে যা তাকে দংশন করছে। কিন্তু তার তাতে কোন খবরই নেই’’। (ই’লামুল্ মুওয়াক্বক্বি’য়ীন, সাবীলুর্ রাসূল : ১০১)

ইমাম আবু হানীফা এবং শাফি’য়ী (রাহিমাহুমাল্লাহ) আরো বলেন:

إِذَا صَحَّ الْـحَدِيثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ، إِذَا رَأَيْتُمْ كَلاَمِيْ يُخَالِفُ الْـحَدِيْثَ فَاعْمَلُوْا بِالْـحَدِيْثِ وَاضْرِبُوْا بِكَلاَمِيَ الْـحَائِطَ

‘‘কোন হাদীস বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলে তা আমার মায্হাব বলে মনে করবে। জেনে রাখো, আমার কোন সিদ্ধান্ত হাদীসের বিপরীত প্রমাণিত হলে তখন হাদীস অনুযায়ী আমল করবে এবং আমার কথা দেয়ালে ছুঁড়ে মারবে’’।

(ইক্ব্দুল্ জীদ্, আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির ২/৯৬ রাদ্দুল্ মুহ্তার ১/৪৬ রাস্মুল্ মুফ্তী : ১/৪ ঈক্বাযুল্ হিমাম : ৫২, ১০৭ দিরাসাতুল্ লাবীব : ৯১ সাবীলুর্ রাসূল : ১০১)

ইমাম শাফি’য়ী (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন:

إِذَا قُلْتُ قَوْلًا وَكَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ خِلاَفَ قَوْلِيْ فَمَا يَصِحُّ مِنْ حَدِيْثِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْلَى، فَلاَ تُقَلِّدُوْنِيْ

‘‘আমি যদি এমন কোন কথা বলে থাকি যা নবী (সা.) এর কথার বিপরীত তখন নবী (সা.) এর বিশুদ্ধ হাদীস অনুসরণ করাই সর্বোত্তম। অতএব তখন আমার অন্ধ অনুসরণ করবে না’’। (ইক্ব্দুল্ জীদ্, ই’লামুল্ মুওয়াক্বক্বি’য়ীন ২/২৬১ ঈক্বাযুল্ হিমাম ১০০, ১০৩ সাবীলুর্ রাসূল : ১০০)

তিনি আরো বলেন:

أَجْمَعَ الْعُلَمَآءُ عَلَى أَنَّ مَنِ اسْتَبَانَتْ لَهُ سُنَّةُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ لَهُ أَنْ يَّدَعَهَا لِقَوْلِ أَحَدٍ

‘‘সকল আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূল (সা.) এর হাদীস যখন কারোর নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় তখন অন্য কারোর কথার কারণে তা প্রত্যাখ্যান করার কোন অধিকার সে ব্যক্তির আর থাকে না’’। (হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, শা’রানী/মীযান, তাইসীর : ৪৬১)