শারঈ মানদন্ডে মুনাজাত :
‘মুনাজাত’ (مُنَاجَاةٌ) আরবী শব্দ। সেই থেকে نَاجَى يُنَاجِىْ مُنَاجَاةً ব্যবহার হয়। এর অর্থ পরস্পর চুপি চুপি কথা বলা।[1] শরী‘আতের পরিভাষায় মুনাজাত হল, ছালাতের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুছল্লীর চুপি চুপি কথা বলা। ছহীহ বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে উক্ত অর্থেই মুনাজাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذاَ قَامَ فِىْ صَلاَتِهِ فَإِنَّهُ يُنَاجِىْ رَبَّهُ.
‘নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ যখন তার ছালাতে দাঁড়ায়, তখন সে তার রবের সাথে মুনাজাত করে’।[2] অন্য হাদীছে এসেছে, إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذاَ كَانَ فِىْ الصَّلَاةِ فَإِنَّهُ يُنَاجِىْ رَبَّهُ ‘নিশ্চয়ই মুমিন যখন ছালাতের মধ্যে থাকে তখন সে তার রবের সাথে মুনাজাত করে’।[3] আরেক হাদীছে এসেছে, إِنَّ الْمُصَلِّىْ يُنَاجِىْ رَبَّهُ ‘নিশ্চয়ই মুছল্লী তার রবের সাথে মুনাজাত করে’।[4] অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَلَا يَبْصُقْ أَمَامَهُ فَإِنَّمَا يُنَاجِىْ اللهَ مَادَامَ فِىْ مُصَلَّاهُ.
‘যখন তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়াবে, তখন সে যেন তার সামনে থুথু না ফেলে। কারণ সে যতক্ষণ মুছাল্লাতে ছালাত রত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহর সাথে মুনাজাত করে’।[5]
উল্লেখ্য, হাদীছে উল্লিখিত يُنَاجِى শব্দটি ফে‘ল বা ক্রিয়া। আর তার মাছদার বা ক্রিয়ামূল হল (مُنَاجَاةٌ) মুনাজাত।
মুছল্লী ছালাতের মধ্যে সারাক্ষণই যে মুনাজাত করে এবং পুরো ছালাতটাই যে তার জন্য মুনাজাত তা উপরিউক্ত হাদীছগুলো থেকে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, মুছল্লী যখন ছালাত শেষ করে, তখন তার মুনাজাতও শেষ হয়ে যায়। মুছল্লী ছালাতের মাঝে আল্লাহর সাথে কিভাবে মুনাজাত করে তাও হাদীছে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ اللهُ تَعَالىَ قَسَمْتُ الصَّلَاةَ بَيْنِيْ وَبَيْنَ عَبْدِيْ نِصْفَيْنِ وَلِعَبدِىْ مَا سَأَلَ فَإِذَا قَالَ الْعَبْدُ اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ قَالَ اللهُ حَمِدَنِىْ عَبْدِىْ وَإِذَا قَالَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ قَالَ اللهُ تَعَالى أََثْنَى عَلَىَّ عَبْدِىْ وَإِذَا قَالَ مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ قَالَ مَجَّدَنِىْ عَبْدِىْ وَإِذَا قَالَ إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ قَالَ هَذَا بَيْنِيْ وَبَيْنَ عَبْدِيْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ فَإِذَا قَالَ اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ قَالَ هذَا لِعَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ.
‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি ছালাতকে আমার মাঝে ও আমার বান্দার মাঝে দুই ভাগে ভাগ করেছি। আমার বান্দার জন্য সেই অংশ, যা সে চাইবে। বান্দা যখন বলে, ‘আল-হামদুলিল্লা-হি রাবিবল ‘আলামীন’ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি জগৎ সমূহের প্রতিপালক)। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল। বান্দা যখন বলে, ‘আর-রহমা-নির রহীম’ (যিনি করুণাময় পরম দয়ালু)। তখন আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার গুণগান করল। বান্দা যখন বলে, ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দ্বীন’ (যিনি বিচার দিবসের মালিক) তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমাকে সম্মান প্রদর্শন করল। বান্দা যখন বলে, ইয়্যা-কানা‘বুদু ওয়া ইয়্যা-কানাসতাঈন (আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি)। তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ (অর্থাৎ ইবাদত আমার জন্য আর প্রার্থনা তার জন্য) এবং আমার বান্দার জন্য সেই অংশ রয়েছে যা সে চাইবে। যখন বান্দা বলে, ‘ইহদিনাছ ছিরাত্বাল মুস্তাক্বীম, ছিরা-ত্বল্লাযীনা আন‘আমতা ‘আলায়হিম, গাইরিল মাগযূবি ‘আলায়হিম ওয়ালায যা-ল্লীন (আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ যাদের উপর আপনি রহম করেছেন। তাদের পথ নয় যারা অভিশপ্ত এবং পথভ্রষ্ট)। তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা যা চেয়েছে, তা তার জন্য’।[6] (আমীন)।
অতএব, মুনাজাত বা আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে প্রার্থনা করার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হল ছালাত (বাক্বারাহ ৪৫)। সালাম ফিরানোর পর মুনাজাতের স্থান নেই। উপরিউক্ত ছহীহ হাদীছ দ্বারা তা-ই প্রমাণিত হয়। আরো বিস্তারিত দ্রঃ ‘শারঈ মানদন্ডে মুনাজাত’ শীর্ষক বই।
[2]. ছহীহ বুখারী হা/৪০৫, ১ম খন্ড, ৫৮, (ইফাবা হা/৩৯৬, ১/২২৭ পৃঃ), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৩। এছাড়া দ্রঃ হা/৪১৭, ৫৩১, ৫৩২ ও ১২১৪, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৯, ৭৬ ও ১৬২।
[3]. ছহীহ বুখারী হা/৪১৩, ১/৫৯ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪০২, ১/২২৯ পৃঃ), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৬।
[4]. মিশকাত হা/৮৫৬, ১/২৭১ পৃঃ, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৯৬, ২/২৮৪ পৃঃ।
[5]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহ বুখারী হা/৪১৬, ১/৫৯ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪০৫, ১/২৩০ পৃঃ); ছহীহ মুসলিম হা/১২৩০; ১ম খন্ড, পৃঃ ২০৭, ‘মসজিদ ও ছালাতের জায়গা সমূহ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৭১০, পৃঃ ৬৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৫৮, ২/২১৯ পৃঃ; ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[6]. ছহীহ মুসলিম হা/৯০৪, ১/১৬৯-৭০ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৬২), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১১; মিশকাত হা/৮২৩, পৃঃ ৭৮-৭৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৬৬, মিশকাত ২/২৭২ পৃঃ ।