অপব্যাখ্যা ও তার জবাব :

(১) রাফ‘উল ইয়াদায়েনকে মুসলিম সমাজ থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য যঈফ ও জাল হাদীছ এবং বানোয়াট কেচ্ছা-কাহিনী ছাড়াও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন নিম্নের হাদীছটির ব্যাপারে ড. ইলিয়াস ফয়সাল ‘নবীজীর স. নামায’ বইয়ে অনেক চর্বিতচর্বণ করেছেন।[1]

عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ كُنَّا إِذَا صَلَّيْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ قُلْنَا السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَأَشَارَ بِيَدِهِ إِلَى الْجَانِبَيْنِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ عَلاَمَ تُوْمِئُوْنَ بِأَيْدِيْكُمْ كَأَنَّهَا أَذْنَابُ خَيْلٍ شُمُسٍ إِنَّمَا يَكْفِىْ أَحَدَكُمْ أَنْ يَضَعَ يَدَهُ عَلَى فَخِذِهِ ثُمَّ يُسَلِّمُ عَلَى أَخِيْهِ مَنْ عَلَى يَمِيْنِهِ وَشِمَالِهِ.

জাবের ইবনু সামুরা (রাঃ) বলেন, আমরা যখন রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করতাম, তখন ‘আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’, ‘আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’ বলতাম। মুছল্লী তার দুই পার্শ্বে দুই হাত দিয়ে ইশারা করত। ফলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা কেন তোমাদের হাত দ্বারা ইঙ্গিত করছ, যেন তা অবাধ্য ঘোড়ার লেজ। তোমাদের কোন মুছল্লীর জন্য যথেষ্ট হবে তার হাত তার রানের উপর রাখা। অতঃপর তার ডানে ও বামের ভাইকে সালাম দেয়া।[2]

পর্যালোচনা : উক্ত মর্মে ছহীহ মুসলিমে পরপর তিনটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটিতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তাশাহ্হুদের সময় হাত তুলে সালাম দিতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া তিনটি হাদীছ একই রাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। অথচ অপব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে যে, রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম মুসলিম যদি এই হাদীছকে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের বিরুদ্ধে পেশ করতে চাইবেন, তবে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করার পক্ষে কেন তিনি পাঁচটি হাদীছ উল্লেখ করলেন? [3] অবশ্য যারা অপব্যাখ্যা করেন, তাদের অন্তরও হয়ত সঠিক বিষয়টি জানে। মাযহাবী গোঁড়ামীর কারণে তারা প্রকাশ করেন না। তবে আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন। আল্লাহ রক্ষা করুন এবং হেদায়াত দান করুন!

জ্ঞাতব্য : উক্ত মর্মে একটি জাল হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য সেটা হয়ত তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা না করে এটি পেশ করলেও ততটা আফসোস হত না।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ كَأنِّىْ بِقَوْمٍ يأتوْنَ مِنْ بَعْدِىْ يَرْفعوْنَ أيْدِيَْهِمْ فِى الصَّلاَةِ كَأَنَّهَا أَذْنَابُ خَيْلٍ شُمْسٍ.

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমি এমন এক সম্প্রদায়ের সাথে রয়েছি, যারা আমার পরে আসবে। তারা অবাধ্য ঘোড়ার লেজের ন্যায় ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করবে ।[4]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি মিথ্যা ও মুনকার। কারণ ছহীহ মুসলিমে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, এটি তার বিরোধী।[5]

(২) মিথ্যাচার করা হয় যে, মূর্তিপূজার ভালবাসা ছাড়তে না পেরে ছাহাবীরা গোপনে বগলে পুতুল রাখতেন। ফলে তাদেরকে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই যুগে যেহেতু কেউ পুতুল রাখে না সুতরাং রাফ‘উল ইয়াদায়েন করার প্রয়োজন নেই।

পর্যালোচনা : প্রথমতঃ উক্ত ঘটনার কোন প্রমাণ নেই। এটা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন? মূতলঃ হাদীছ জাল করার মত এটাও একটি সাজানো মিথ্যা কাহিনী। দ্বিতীয়তঃ ছাহাবীদের বিরুদ্ধে মূর্তি পূজা ও তার প্রতি ভক্তির মিথ্যা অপবাদ কী পরিমাণ জঘন্য কাজ হতে পারে? ছাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা সম্পর্কে না জানার কারণেই তাদের উপর এই অপবাদ দেয়া হয়েছে। মূল কথা হড়, তাদের পক্ষে যদি রাসূল (ছাঃ)-এর নামে জাল হাদীছ রচনা করা সম্ভব হয়, তাহলে এটা তো কোন ব্যাপারই নয়।

(৩) ‘হানাফীদের কয়েকটি জরুরী মাসায়েল’ নামক পুস্তকের প্রণেতা মাওলানা মোঃ আবুবকর সিদ্দীক এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কতিপয় উদ্ভট ও অসত্য কথা লিখেছেন। যেমন- ‘ইমাম বুখারী যে ১৭ জন ছাহাবার রফে ইয়াদাইনের হাদীছ বর্ণনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে হযরত উমর, হযরত আলী, ইবনে উমার, আবূ সাঈদ, ইবনে যোবায়ের রফে ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন।... সুতরাং ইমাম বুখারীর রফে ইয়াদাইনের হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়’।[6]

পর্যালোচনা : উক্ত মন্তব্য অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। মূলতঃ মানসূখ কাহিনী রচনা করার জন্য যে সমস্ত বর্ণনা জাল করা হয়েছে, সেগুলো উক্ত লেখকের উপর ভর করেছে। ফলে দিশেহারা হয়ে গেছে। আল্লাহ হেদায়াত দান করুন-আমীন!

দৃষ্টি আকর্ষণ :

(ক) উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, রাফ‘উল ইয়াদায়েনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমলটি জাল হাদীছের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। আর এর কারখানা ছিল ইরাকের কূফা ও বছরায়। তাই ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিঃ) বলেন, وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِىِّ وَأَهْلِ الْكُوْفَةِ ‘এটা সুফিয়ান ছাওরী ও কূফাবাসীর বক্তব্য’।[7] একটি যঈফ বর্ণনায় এসেছে, একবার শুধু হাত উত্তোলন করতেন আর কোন স্থানে হাত উঠাতেন না। উক্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম আবুদাঊদ (২০৪-২৭৫ হিঃ) বলেন, قَالَ سُفْيَانُ قَالَ لَنَا بِالْكُوْفَةِ بَعْدُ ثُمَّ لاَ يَعْوْدُ ‘সুফিয়ান বলেন, ‘পুনরায় আর হাত তুলতেন না’ কথাটি পরবর্তীতে কূফায় আমাদেরকে বলা হয়েছে’।[8] এছাড়া অন্যান্য কতিপয় বিষয়ও কূফাবাসী পরিবর্তন করে দিয়েছে। ঈদের তাকবীর, জানাযার তাকবীর, তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা ইত্যাদি অন্যতম।

(খ) উপরে অনেক জাল ও যঈফ হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। সংখ্যা দেখে কেউ যেন ধোঁকায় না পড়ে। কারণ ‘জিরোর’ পর যত জিরোই বসানো হোক, তার যেমন কোন মূল্য নেই, তেমনি হাযারো জাল হাদীছ থাকলেও একটি ছহীহ হাদীছের সামনে সেগুলোর কোন মূল্য নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছোট্ট একটি বাণীই উক্ত ধাঁধার জবাব হতে পারে :

فَمَا بَالُ رِجَالٍ يَشْتَرِطُوْنَ شُرُوْطًا لَيْسَتْ فِىْ كِتَابِ اللهِ مَاكَانَ مِنْ شَرْطٍ لَيْسَ فِىْ كِتَابِ اللهِ فَهُوَ بَاطِلٌ وَإِنْ كَانَ مِائَةَ شَرْطٍ فَقَضَاءُ اللهِ أَحَقُّ وَشَرْطُ اللهِ أوْثَقُ.

‘মানুষের কী হল যে, তারা বেশী বেশী শর্তারোপ করছে, অথচ তা আল্লাহর বিধানে নেই? মনে রেখ, যে শর্ত আল্লাহর সংবিধানে নেই তা বাতিলযোগ্য, যদিও তা একশ’ শর্তের বেশী হয়। মনে রেখ, আল্লাহর সিদ্ধান্তই সর্বাধিক অভ্রান্ত এবং তাঁর শর্তই সর্বাধিক চূড়ান্ত’।[9]

[1]. ঐ, পৃঃ ১৮২-১৮৩; মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ২৭৯-২৮০।

[2]. ছহীহ মুসলিম হা/৯৯৮, ৯৯৯, ৯৯৭, ১/১৮১ পৃঃ, ‘ছালাত’ অনুচ্ছেদ-২৭; আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৪৪।

[3]. ছহীহ মুসলিম হা/৮৮৭, ৮৮৮, ৮৮৯, ৮৯০, ৮৯১, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৮, (ইফাবা হা/৭৪৫-৭৪৯), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।

[4]. মুসনাদুর রবী‘ হা/২১৩।

[5]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৪৪।

[6]. ঐ, পৃঃ ১৩।

[7]. তিরমিযী হা/২৫৭, ১/৫৯ পৃঃ।

[8]. আবুদাঊদ হা/৭৫০, ১/১০৯ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৪৩।

[9]. ছহীহ বুখারী হা/২৭২৯, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৭৭, ‘শর্ত সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৩; ছহীহ মুসলিম হা/৩৮৫২, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৯৪, ‘গোলাম আযাদ’, অনুচ্ছেদ-৩; মিশকাত হা/২৮৭৭, পৃঃ ২৪৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ৪৬, হা/২৭৫২ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।