উক্ত গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা - দ্বিতীয় অংশ

(৬) কোন দলীয় বা মাযহাবী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কৌশল করে কিংবা অপব্যাখ্যা করে শরী‘আতকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না :

উক্ত জঘন্য নীতির জয়জয়কার চলছে সহস্র বছর ধরে। একশ্রেণীর মানুষ অতি সামান্য জ্ঞান নিয়ে আল্লাহর জ্ঞানের উপর প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করছে। এই অপকৌশলের যে কী শাস্তি তা তারা ভুলে গেছে। মূল শরী‘আতকে উপেক্ষা করে দলীয় সিদ্ধান্ত ও মাযহাবী নীতি প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য থাকলে বানী ইসরাঈলের মত তাদের উপর আল্লাহর গযব নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। দাঊদ (আঃ)-এর সময় তারা মহা সত্যকে না মেনে মিথ্যা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে তারা বানর ও শূকরে পরিণত হয়েছিল এবং একই দিনে সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল (বাক্বারাহ ৬৫; মায়েদা ৬০)। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে যারা বিভ্রান্ত করবে তাদের পরিণাম এমনই হওয়া উচিৎ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন তোমার পক্ষে দলীল হতে পারে, আবার বিপক্ষেও দলীল হতে পারে’।[46] সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের জানা উচিৎ যে, শারঈ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি যাই করি এবং যে উদ্দেশ্যেই করি অন্তরের খবর আল্লাহ সবই জানেন (মুলক ১৩; আলে ইমরান ১১৯)।

উক্ত মিথ্যা কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে অসংখ্য হাদীছ জাল করা হয়েছে, হাদীছের শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে, বিভিন্ন অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া হয়েছে, অনুবাদে কারচুপি করা হয়েছে, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাদীছের উপর ছুরি চালান হয়েছে। বিশ্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ আলবানী (রহঃ)-এর বিশ্ব নন্দিত ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত’ বইটি এদেশে বিকৃত করে অনুবাদ করা হয়েছে। আলবানীর নামে সচিত্র নামায শিক্ষার মিথ্যা সিডি ছাড়া হয়েছে। প্রবীণ আলেমরা পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কারণ তারা মাযহাবী জাল ছিন্ন করতে রাযী নন।

প্রচলিত ফেক্বহী গ্রন্থ ও বাজারের নামায শিক্ষা বই সম্পর্কে হুঁশিয়ারী :

রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত সমাজ থেকে উঠে যাওয়ার কারণ হল, বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে প্রণীত ফেক্বহী গ্রন্থ ও বাজারে প্রচলিত ‘নামায শিক্ষা’ বই। এগুলোই বিদ‘আতী ছালাতের ভিত্তি। লেখকগণ জাল ও যঈফ হাদীছ এবং মিথ্যা কাহিনীর মর্মান্তিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। নিজেদের মাযহাবের কর্মকান্ডকে প্রমাণ করার জন্য জাল ও যঈফ হাদীছের আশ্রয় নিয়েছেন এবং নিজ নিজ মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক ফিক্বহী গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনুরূপভাবে অন্য মাযহাবের দলীল খন্ডন করার জন্য রচনা করেছেন পৃথক পৃথক ফিক্বহী উছূল। ফক্বীহগণের এই করুণ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লামা মারজানী হানাফী বলেন,

وَقَوْلُ الْفُقَهَاءِ يَحْتَمِلُ الْخَطَاءَ فِىْ أَصْلِهِ وَغَالِبُهُ خَالٍ عَنِ الْإِسْنَادِ ... فَإِنَّهُ يَحْتَمِلُ أَنْ يَكُوْنَ مَوْضُوْعًا قَدِ افْتَرَى عَلَيْهِ غَيْرَهُ.

‘ফক্বীহদের বক্তব্যে ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, সেগুলো সনদ বিহীন। .. নিঃসন্দেহে তা জাল হওয়ারই প্রমাণ বহন করে, যা অন্যের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে’।[47] আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী হানাফী (রহঃ) ফিক্বহ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন,

فَكَمْ مِنْ كِتَابٍ مُعْتَمَدٍ اِعْتَمَدَ عَلَيْهِ أَجِلَّةُ الْفُقَهَاءِ مَمْلُوْءٌ مِنَ الْأَحَادِيْثِ الْمَوْضُوْعَةِ وَلاَ سِيَّمَا الْفَتَاوَى فَقَدْ وَضَّحَ لَنَا بِتَوْسِيْعِ النَّظْرِ أَنَّ أَصْحَابَهَا وَإِنْ كَانُوْا مِنَ الْكَامِلِيْنَ لَكِنَّهُمْ فِىْ نَقْلِ الْأَخْبَارِ مِنَ الْمُتَسَاهِلِيْنَ.

‘অনেক বিশ্বস্ত কিতাব, যার উপর বড় বড় ফক্বীহগণ নির্ভরশীল, সেগুলো জাল হাদীছ সমূহে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে ফাতাওয়ার কিতাব সমূহ। গভীর দৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, ঐ সকল গ্রন্থ প্রণয়নকারীগণ যদিও পূর্ণ ইলমের অধিকারী, কিন্তু হাদীছ সংকলনের ক্ষেত্রে তারা ছিলেন শিথিলতা প্রদর্শনকারী’।[48] অন্যত্র তিনি আরো পরিষ্কারভাবে সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলেন,

أَلاَتَرَى إِلَى صَاحِبِ الْهِدَايَةِ مِنْ أَجِلَّةِ الْحَنَفِيَّةِ وَالرَّافِعِىِّ شَارِح ِالْوَجِيْزِ مِنْ أَجِلَّةِ الشَّافِعِيَّةِ مَعَ كَوْنِهِمَا مِمَّنْ يُشَارُ إِلَيْهَا بِالْأنَامِلِ وَيَعْتَمِدُ عَلَيْهِ الْأمَاجِدُ وَالْأَمَاثِلُ قَدْ ذَكَرَا فِىْ تَصَانِيْفِهِمَا مَالَمْ يُوْجَدْ لَهُ أَثَرٌ عِنْدَ خَبِيْرٍ بِالْحَدِيْثِ.

(হে পাঠক!) তুমি কি হেদায়া রচনাকারীকে দেখ না, যিনি শীর্ষস্থানীয় হানাফীদের অন্যতম? এছাড়া ‘আল-ওয়াজীয’-এর ভাষ্যকার রাফেঈকে দেখ না, যিনি শাফেঈদের শীর্ষস্থানীয়? এই দু’জন ঐ সকল প্রধান ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় এবং যাদের উপর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ নির্ভর করে থাকেন। অথচ উক্ত কিতাবদ্বয়ে তারা এমন অনেক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, মুহাদ্দিছগণের নিকট যেগুলোর কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না’।[49] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮হিঃ) বহু পূর্বেই প্রভাবিত ফক্বীহদের সম্পর্কে বলে গেছেন,

وَجَمْهُوْرُ الْمُتَعَصِّبِيْنَ لاَيَعْرِفُوْنَ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ إِلاَّمَاشَاءَ اللهُ بَلْ يَتَمَسَّكُوْنَ بِأَحَادِيْثَ ضَعِيْفَةٍ وَآرَاءٍ فَاسِدَةٍ أَوْ حِكَايَاتٍ عَنْ بَعْضِ الْعُلَمَاءِ والشُّيُوْخِ.

‘মাশাআল­াহ দু’একজন ব্যতীত মাযহাবী গোঁড়ামী প্রদর্শনকারীদের কেউই কুরআন-সুন্নাহ বুঝেন না; বরং তারা অাঁকড়ে ধরেন যঈফ ও জাল হাদীছের ভান্ডার, বিভ্রান্তিকর রায়-এর বোঝা এবং কতক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও কথিত আলেমদের কল্প-কাহিনীর সমাহার’।[50]

সুধী পাঠক! আমাদের আলোচনা পড়লেই উক্ত মন্তব্যগুলোর বাস্তবতা প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ। উক্ত ফেক্বহী গ্রন্থ ছাড়াও অনেক বড় বড় বিদ্বান ছালাত সম্পর্কে বই লিখেছেন কিন্তু সেগুলোও জাল, যঈফ ও বানোয়াট কথাবার্তায় পরিপূর্ণ। প্রচলিত ‘তাবলীগ জামাআত’ কর্তৃক প্রণীত ‘ফাযায়েলে আমল’ বা ‘তাবলীগী নিছাব’ তার অন্যতম। বিভিন্ন ত্বরীকা ও যিকিরপন্থীদের বইগুলো তো মিথ্যা কাহিনীর ‘উপন্যাস সিরিজ’। বর্তমানে মুখরোচক শিরোনামে কিছু বই বাজারে ছাড়া হচ্ছে, যেগুলো প্রতারণা ও শঠতায় ভরপুর। তাই মুছল্লী হিসাবে ছালাত সংক্রান্ত মাসআলাগুলো যাচাই করা আবশ্যক।

সম্মানিত মুছল্লী!

বর্তমান সমাজে যে ছালাত প্রচলিত আছে, তা জাল ও যঈফ হাদীছ ভিত্তিক বানোয়াট ছালাত। রাসূল (ছাঃ) যে পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করতেন, সেই পদ্ধতি কোন মসজিদেই চালু নেই বললেই চলে। ২৪১ হিজরীর পূর্বে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলে গেছেন, ‘তুমি যদি এই যুগের একশ’ মসজিদেও ছালাত আদায় করো, তবুও তুমি কোন একটি মসজিদেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) ছালাত দেখতে পাবে না। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের নিজেদের ছালাত এবং তোমাদের সাথে যারা ছালাত আদায় করে, তাদের ছালাতের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখ’।[51]

বারোশ’ বছর পর আমরা যদি আজ তাঁর কথাটি বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা আমাদের ছালাতের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাব। তাই ভেজালমুক্ত ছালাত মুছল্লীর সামনে তুলে ধরার জন্যই ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত’ শীর্ষক এই লেখনী। ওযূ ও তায়াম্মুম সংক্রান্ত আলোচনার পর ফরয ছালাতসহ অন্যান্য ছালাতে যে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো উক্ত লেখনীতে সন্নিবেশিত হয়েছে। অতঃপর সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। তাই নিজের ছালাতকে পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রত্যেক মুছল্লীর কাছে এই বইটি থাকা অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি। সেই সাথে যাদের সামর্থ্য আছে তাদের উচিৎ অন্য মুছল্লীর নিকট বইটি পৌঁছে দিয়ে সহযোগিতা করা। ফলে ঐ মুছল্লী বিশুদ্ধভাবে ছালাত আদায় করে যত ছওয়াব পাবেন, তার সমপরিমাণ ছওয়াব ঐ ব্যক্তিও পাবেন, যিনি সহযোগিতা করলেন।[52]পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি- তিনি যেন আমাদের এই খেদমতটুকু কবুল করেন। যারা বইটি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং প্রকাশনায় সহযোগিতা করেছেন আল্লাহ যেন তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে প্রভূত কল্যাণ দান করেন- আমীন!!


[46]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৫৬, ১/১১৮ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪২৫), ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/২৮১, পৃঃ ৩৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৬২, ২/৩৮ পৃঃ।

[47]. নাযেরাতুল হক্ব-এর বরাতে আল-ইরশাদ, পৃঃ ১৪৬; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, পৃঃ ১৪৬।

[48]. আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী, জামে‘ ছাগীর-এর ভূমিকা নাফে‘ কাবীর, পৃঃ ১৩; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ৩৭।

[49]. আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী, আজওয়াবে ফাযেলাহ-এর বরাতে আল-ইরশাদ, পৃঃ ১৫৭; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, পৃঃ ১৫১।

[50]. ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া ২২/২৫৪-২৫৫।

[51]. আবুল হুসাইন ইবনে আবী ইয়ালা, ত্বাবাক্বাতুল হানাবিলাহ ১/৩৫০ পৃঃ- لَوْ صَلَّيْتَ فِىْ مِائَةِ مَسْجِدٍ مَا رَأَيْتَ أَهْلَ مَسْجِدٍ وَاحِدٍ يُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ عَلَى مَا جَاءَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَنْ أَصْحَابِهِ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ فَاتَّقُوا اللهَ وَانْظُرُوْا فِىْ صَلاَتِكُمْ وَصَلاَةَ مَنْ يُّصَلِّىْ مَعَكُمْ

[52]. মুসলিম হা/৫০০৭; মিশকাত হা/২০৯।