যাযাবর লিখেছেন ‘হর্স পাওয়ার দিয়ে ইঞ্জিনের দাম বাড়ে, সিলিন্ডার দিয়ে মোটর গাড়ির। হীরার মুল্য দ্যুতিতে, চাপরাশির তার তকমায়। সাবালক বাঙালীর দাম নিরুপিত হয় চাকরির ওজনে।’ কথাটা সত্য। আমাদের সমাজে চাকুরে ছেলের যে কি দর তা বেশির ভাগ মেয়ের বাবাদের ব্যবহারেই জানা যায়। পৃথিবীর সব থেকে খারাপ ছেলেও যদি ভালো একটা চাকরি করে তবে চাকরি তার সব দোষ ঢেকে নেয়। মানে ছেলে মদখোর, নেশাখোর, মেয়েবাজ যাই হোক না কেন চাকরির জন্য তার সাত খুন মাপ। মেয়ে পক্ষ থেকে তার দোষ গুলোর সুন্দর সুন্দর ব্যাখ্যা বেরোয়। যেমন, মদ তো আজকাল হাই সোসাইটির সবাই খায়, মদ না খাওয়া মানে তো মান্ধাতা আমলের ছেলে। একটু আধটু তো খাবেই! আর চারিত্রিক অধঃপতনের ব্যাখ্যায় বলে, ‘বিয়ের আগে কে না মেয়েবাজ হয়? আমরাই তো কত মেয়ের পেছনে ঘুরেছি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে!’

জুয়া খেলা, লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, খারাপ ভাষায় গালি দেওয়া এসব বিয়ের আগে ছেলেরা করেই থাকে। বিয়ের পর দেখবা কেমন লাইনে চলে এসেছে।

এরকম করে সব দোষ গুলোর ব্যাখ্যা মেয়ে পক্ষ থেকেই বেরিয়ে আসে। টাকা দেখে চরিত্র, ভদ্রতা, ব্যক্তিত্ব সবকিছুকেই দূরে ঠেলে দেয় অথবা নজরান্দাজ করে অনেক মেয়ের বাবা-ভাইয়েরা। আশ্চর্য লাগে এদের থিওরি দেখে। এরা টাকাকেই সুখের একমাত্র উপায় বলে মনে করে। এদের কাছে ভালো ব্যবহার, আদর্শ ও চরিত্রের কোনো দাম নেই। এরকম অবিভাবকরা কত মেয়ের যে জীবন নষ্ট করে তার ইয়াত্তা নেই!

অথচ হাদীসে অর্থ ও রূপের আগে দীন ও সততা দেখে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিবাহের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে পাত্র ও পাত্রী উভয়ের ধার্মিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আল্লাহ বলেন,

﴿ وَلَا تَنكِحُواْ ٱلۡمُشۡرِكَٰتِ حَتَّىٰ يُؤۡمِنَّۚ وَلَأَمَةٞ مُّؤۡمِنَةٌ خَيۡرٞ مِّن مُّشۡرِكَةٖ وَلَوۡ أَعۡجَبَتۡكُمۡۗ وَلَا تُنكِحُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ حَتَّىٰ يُؤۡمِنُواْۚ وَلَعَبۡدٞ مُّؤۡمِنٌ خَيۡرٞ مِّن مُّشۡرِكٖ وَلَوۡ أَعۡجَبَكُمۡۗ أُوْلَٰٓئِكَ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلنَّارِۖ وَٱللَّهُ يَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱلۡجَنَّةِ وَٱلۡمَغۡفِرَةِ بِإِذۡنِهِۦۖ وَيُبَيِّنُ ءَايَٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَذَكَّرُونَ ٢٢١ ﴾ [البقرة: ٢٢١]

‘তোমরা মুশরিক মেয়েদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। নিশ্চয়ই একজন ঈমানদার মেয়ে মুশরিক মেয়ের চেয়ে উত্তম। যদিও সে তোমাদেরকে মোহিত করে। তোমরা মুশরিক পুরুষদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। নিশ্চয়ই একজন ঈমানদার পুরুষ মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম। তারা জাহান্নামের দিকে আহবান করে। আর আল্লাহ জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন। তিনি মানুষের জন্য তাঁর নিদর্শনাবলি সুস্পষ্ট তুলে ধরেন। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২২১)

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ: لِمَالِهَا، وَلِحَسَبِهَا، وَلِجَمَالِهَا، وَلِدِينِهَا، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ

‘মেয়েদের চারটি গুণ দেখে বিবাহ করা হয়- তার ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা, সৌন্দর্য এবং ধর্ম। তবে তোমরা ধার্মিকতার দিক বিবেচনাই অগ্রাধিকার দাও। অন্যথায় তোমাদের উভয় হস্ত অবশ্যই ধূলায় ধূসরিত হবে। [বুখারী : ৫০৯০; মুসলিম : ১৪৬৬]

আরেক হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِذَا خَطَبَ إِلَيْكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ، إِلَّا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الأَرْضِ، وَفَسَادٌ عَرِيضٌ»

‘যখন তোমাদের কাছে এমন কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেয় যার দ্বীনদারী এবং উত্তম আচরণে তোমরা সন্তুষ্ট, তার সাথে বিবাহ দাও। অন্যথায় পৃথিবীতে ফিতনা হবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেয়া দেবে।’[তিরমিযী : ১০৮৩, হাসান]

বস্তুতঃ সৎ চরিত্রই হচ্ছে দীনের প্রতীক এবং মুমিনের সৌন্দর্য। কেবল বদৌলতেই মানুষ মর্যাদার শিখরে উন্নীত হয়। আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا مِنْ شَيْءٍ يُوضَعُ فِي المِيزَانِ أَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الخُلُقِ، وَإِنَّ صَاحِبَ حُسْنِ الخُلُقِ لَيَبْلُغُ بِهِ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلَاةِ»

‘(কিয়ামত দিবসে) ওজনের পাল্লায় উত্তম চরিত্রের চেয়ে অন্য কোনো বস্তু ভারি বলে প্রমাণিত হবে না। আর একজন চরিত্রবান লোক নিয়মিত সাওম ও সালাত আদায়কারীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে।’ [তিরমিযী : ২০০৩, সহীহ]

কিন্তু যাযাবরের কথায়, চাকরির বাজারে যেমন সার্টিফিকেটের অপরিহার্যতা, বিয়ের বাজারেও তেমন অর্থের অপরিহার্য দেখা দিয়েছে। মানুষ যোগ্যতার বিচার করছে অর্থে। একজন মেয়ের বাবার কথায় ফুটে উঠেছে এই শ্বাশ্বত সত্য। ঘটনাটাও মজার!

রাজধানী ঢাকা থেকে শিবগঞ্জে পালিয়ে গিয়ে ধরা পড়ে এক প্রেমিকযুগল। পরে তাদের আটক করে শিবগঞ্জ থানা পুলিশ। আটকের পরও তারা নির্বিকার। প্রেমবাসনায় মগ্ন। থানায় গিয়ে দেখা যায়, আটক অবস্থায় প্রেমিক জুটি ওসির রুমে হাতে হাত রেখে আলাপচারিতায় রত। কিন্তু তখনই বাঁধল গোল। এসময় সেখানে হাজির হন মেযের শিল্পপতি বাবা নাঈদ আহম্মেদ সিদ্দিকী। তিনি ঢাকা থেকে হেলিকাপ্টার ভাড়া করে যান শিবগঞ্জ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার উপ-পরিদর্শক নুরুল ইসলামও যান মেয়ের বাবার সঙ্গে। সেখান থেকে ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় ফেরত এসে অপহরনের অভিযোগে প্রেমিককে ধানমন্ডি থানায় সোপর্দ করেছেন। আটক প্রেমিক যুগল হলো ধানমন্ডি এলাকার নাঈদ আহম্মেদ সিদ্দিকীর মেয়ে সাদিয়া আহম্মেদ শশী (১৫) এবং মোহম্মদপুর থানার আ. রাজ্জাকের ছেলে রাসেল খান (২৪)। শিবগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ শে অক্টোবর ঢাকা থেকে পালিয়ে শিবগঞ্জে যায় শশী ও রাসেল। সেখানে থানা পুলিশের হাতে আটক হয়। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্মক (এসআই) নুরুল ইসলাম জানান, প্রায় ৬ ভরি স্বর্ণ ও নগদ ৪৯ হাজার টাকা সহ শিবগঞ্জ থানার মাধ্যমে অপহৃত শশি ও অপহারনকারী রাশেল কে আটক করে ধানমন্ডি থানায় নেয়া হবে। অপহৃত মেয়েটিকে তার পিতার কাছে হস্তান্তরের পর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেয়েটির পিতা জানান, ঘরে নেই শোয়ার চৌকি আবার হাত দিছে চাঁদের দিকে!

সমস্যাটা এখানেই। প্রেম ধনী-গরিব মানছে না। আবার মেয়েদের বাবাদের দৃষ্টিতে সততায় নয়, অর্থে আবদ্ধ। রাসেল খানের সৌভাগ্যই বলা যায়। প্রেম করে না জিতুক, অন্তত প্রেমের উসিলায় উড়োজাহাজের ভ্রমণটা তো হয়ে গেল!