নারীর অর্থোপার্জনের অধিকার ও বিজ্ঞাপনে পণ্য নারী!

ফ্যাঙ্ক বুকম্যান বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে সবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে বটে কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।’

এই সর্বগ্রাসী লোভের কারণে সমাজে নীতিবোধ হচ্ছে ক্ষতবিক্ষত, মূল্যবোধ হচ্ছে বিধ্বস্ত। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, বণিকশ্রেণির সর্বগ্রাসী লোভের সবচেয়ে নির্মম শিকার হচ্ছে আমাদের নারীসমাজ। সমান অধিকার, নারীস্বাধীনতা ও স্বাবলম্বী করার নামে নারীদেরকে কত সূক্ষ্মভাবে যে প্রতারিত করা হচ্ছে হতভাগা নারী তা আঁচই করতে পারছে না। লম্পট, লুটেরা নারীর সামনে চাণক্যময় এই শব্দগুলোর মুলা ঝুলিয়ে রেখে তাদের চূড়ান্ত সর্বনাশসাধন ও নারীসত্তাকে দেউলিয়া করে ফেলেছে। ফলে আজ নারীকে তার সমহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার আহ্বান জানালে, গৌরবদীপ্ত স্বকীয়তায় প্রস্ফূটিত হওয়ার আকুলতা জানালে এই বণিকশ্রেণি তাদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। নারীর অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে বলে সব শিয়াল মিলে হুক্কা হুয়ার সুরে গান ধরে।

আমি যতদূর অনুধাবন করতে পারি, যে নারীর অধিকার নিয়ে এই শ্রেণি হইচই বাঁধায় সেই নারীসমাজ কিন্তু ইসলামের আদর্শকে তাদের দৈনন্দিন জীবনে সাংঘর্ষিক কিংবা জীবন-জীবিকার প্রতিবন্ধক মনে করছে না। বরং লুটেরা নারীর সামনে প্রতিবন্ধকতার কৃত্রিম জলছাপ আঁকছে। আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না যে, যারা তথাকথিত নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার তারা কোনো না কোনোভাবে নারীকে ব্যবহার করছে মাল কামানোর জন্য। কেউ ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার মালিক, যাদের ব্যবসার মূলভিত্তি হচ্ছে বিবস্ত্র-অর্ধবিবস্ত্র নারীর উদ্বাহু নৃত্য। কেউ প্রিন্টমিডিয়ার মালিক, যাদের পত্রিকার কাটতির জন্য চাই আবেদনময়ী উলঙ্গ নারীর নোংরা ছবি। কেউ হোটেল-মোটেলের মালিক, যাদের গ্রাহক ও বোর্ডার টানতে চাই রূপসী ললনাদের ছবির লম্বা লম্বা এ্যালবামের বই। আর কেউ বা বণিক, যাদের পণ্য বিস্তৃতির সওদা হিসেবে চাই নারীর সম্ভ্রম-সম্মান। উদাহরণস্বরূপ একটি তথ্য উল্লেখ করি।

পণ্যের প্রচার-প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন বিজ্ঞাপন। বণিকরা এবার বিজ্ঞাপনের অভিনব এক স্পট আবিষ্কার করেছে। পত্রিকায় প্রকাশ, জাপানি কোম্পানিগুলো এই বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তা। বলা যায়, এর চেয়ে খেকারে বিজ্ঞাপন স্পট আর হতে পারে না। এ স্পট চুম্বকের মতো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। বিজ্ঞাপনের এই আকর্ষণীয় (?) স্পটটি হচ্ছে যুবতীদের উরু! এখন পণ্যের বিজ্ঞাপন স্পট হিসেবে যুবতীদের উরু ভাড়া দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং কোম্পানির বিজ্ঞাপন স্পট হিসেবে উরু ভাড়া দেয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জাপানি যুবতীরা। জেট্টাই রায়োকি পিআর নামের এক কোম্পানি এ বিজ্ঞাপন সার্ভিস জনপ্রিয় করা এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ড কোম্পানির কাছে উপস্থাপন করার কাজ করে যাচ্ছে। জেট্টাই রায়োকি শব্দের অর্থ হচ্ছে পরম ‘আকর্ষণীয় এলাকা’ তথা অত্যন্ত গোপনীয় শূন্যস্থান। শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে মহিলাদের মিনি স্কার্ট বা শর্টসের নিচে এবং হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজার ওপরের উরুর অংশ।

যুবতীদের স্পর্শকাতর এ আকর্ষণীয় অংশটাই বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করছে কোম্পানিটি। কোম্পানির দাবি, বিজ্ঞাপনের জন্য উরু ভাড়া দেয়া জাপানের যুবতীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। বেশ কিছু মহিলা এতে অংশ নিয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড কোম্পানি ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে সব যুবতী এক বা একাধিক সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এ সংযুক্ত তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য রিক্রুট করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কমিশন পেতে দিনের অন্তত আট ঘণ্টা একটা স্টিকার উরুর ওপর লাগিয়ে রাখতে হবে। এর ছবি তুলে তাদের পছন্দের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নতুন অ্যাকসেসরির জন্য পাঠাতে হবে।

এ চাতুরতামূলক গেরিলা বিজ্ঞাপন সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রায় ২,৮০০ জাপানি যুবতী এ সোশ্যাল মিডিয়ায় রেজিস্ট্রেশন করেছে। ফেইসবুকে গড়পরতা ৩৩০ জন বন্ধু জুটেছে।

জাপানি মেয়েরা তো এমনিতেই খাটো। তার ওপর শর্ত করা হয়েছে, দর্শকদের আকর্ষণ অটুট রাখার জন্য হাঁটুর নিচের অংশে মোজা পরিধান করতে হবে। সুতরাং বিজ্ঞাপনের লেখা কিংবা ছবি যথার্থভাবে দৃশ্যত করানোর জন্য কাপড়ের ওপরের দিকে কতটুকু যে উঠানো লাগে তা কে জানে!

তাহলে চিন্তা করুন, নারীর সম্ভ্রম এরা কত নিচুতে ঠেকিয়েছে। এবং এটাও ভাবুন, নারীর এই চূড়ান্ত সর্বনাশ দেখে মনুষ্যত্বের অব্যর্থ সংবিধান ইসলামের কথা বললে এদের গা জ্বালা শুরু হয় কেন? বাংলাদেশে কত স্থানে কত ভয়াবহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সেগুলো নিয়ে নারীবাদীদের কোনো মাথা ব্যথা দেখা যায় না। তখন তাদের মানবতাবোধ ও নারী অধিকারের কথাও স্মরণ হয় না। তখন হইচই করবে কেন? তবে যে থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়বে!

আক্ষেপ! নারীদের ইজ্জত-আব্রু এবং তাদের শরীর-দেহ এভাবে বিকিকিনি করার জন্যই তো বণিকদের এত সাধনা, উন্মাদীয় আস্ফালন। কিন্তু নারীরা কি তাদের পাতা ফাঁদে পা দেবে, না দেয়া উচিত? মনে রাখতে হবে, সম্ভ্রম নারীর, তাই রক্ষার দায়িত্বও তাদেরই। আর তা রক্ষায় ইসলামের বৈপ্লবিক আদর্শের বিকল্প নেই।

নৃতাত্ত্বিক ড. অতুল সুর লিখেছেন- ‘প্রাণিজগতে মানুষই একমাত্র জীব, যার জৈবিক চাহিদা সীমিত নয়। অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সন্তান উৎপাদনের জন্য জৈবিক মিলনের একটা বিশেষ ঋতু আছে। মাত্র সেই ঋতুতেই তাদের মধ্যে শারীরিক মিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগে। তারা স্ত্রী-পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদনে প্রবৃত্ত হয়। একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই এরূপ কোনো নির্দিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের বাসনা সব ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। এ জন্য মানুষের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষকে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকতে দেখা যায়।’

বস্তুত মানুষের মধ্যে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকা স্ত্রী-পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই মানুষের মধ্যে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে। এটি আল্লাহরই বিধান এবং আল্লাহই এ নিয়ম প্রবর্তন করেছেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا ٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١ ﴾ [النساء: ١]

‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক প্রাণ থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১)

আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন,

﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]

‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ (সূরা আর-রূম, আয়াত : ২১)

পরিবার গঠন করে স্ত্রী-পুরুষের একত্রে থাকার অবশ্য আরো কারণ আছে। সেটা হচ্ছে বায়োলজিক্যাল বা জীববিজ্ঞানজনিত কারণ। শিশুকে লালন পালন করে স্বাবলম্বী করে তুলতে অন্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। এ সময় প্রতিপালন প্রতিরক্ষণের জন্য নারীকে পুরুষের আশ্রয়ে থাকতে হয়। মনে করুন অন্য প্রাণীর মতো মেলামেশার অব্যবহিত পরেই স্ত্রী-পুরুষ যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতো, তবে মা ও সন্তানকে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হত। সন্তানকে লালন পালন ও স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য মানুষের যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, একমাত্র এই জীবনজনিত কারণেই এ কথা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট। মানুষের মধ্যে সেই আদিম যুগ থেকেই পুরুষ বাইরে আর নারী নিযুক্ত থেকেছে গৃহকর্মে। এটা আল্লাহ তা‘আলারই বিশেষ হেকমত। তিনি এই হেকমতের মাধ্যমেই দুনিয়াকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করেন।

নারীকে আজ শ্রমবিভাজনের নামে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে, নারীর ঘরের কাজ সম্মানজনক নয়, সম্মানজনক হচ্ছে বাইরের কাজ, অর্থোপার্জন। কিন্তু অতুল সুরের সুরে সুর মিলিয়ে বলতেই হয়, নারীর এই গৃহকর্ম মোটেই ছোটো কিংবা অসম্মানের নয়। বরং মানবসভ্যতার ধারা অক্ষুণ্ন ও অটুট রাখার জন্য তা নিতান্তই অপরিহার্য। নারী স্বাধীনতার নামে শ্রমের এই বিভাজন ভেঙে ফেললে অদূর ভবিষ্যতে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে, সমাজব্যবস্থার ধারা ধ্বংসমুখে পতিত হবে।

নারীর গৃহকর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সন্তান লালন-পালন। সন্তান লালন-পালনে নারীপুরুষ উভয়ের বিশেষ ভূমিকা থাকে। তাদের যুগ্ম প্রচেষ্টার ফলেই সন্তানের জীবন ধারণ ও তা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা সুনিশ্চিত করে। কিন্তু মুনাফাখোর ও স্বার্থান্বেষী মহল নারীদেরকে বোঝাতে চাচ্ছে যে, সন্তান পালন সম্মানজনক কর্ম নয়, হেয় কর্ম! তাই নারীকে সম্মানিত হতে হলে গৃহ ছাড়তে হবে। গৃহের বাইরের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অর্থোপার্জন করতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ নারী স্বাধীনতার ধারণাকে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত ও বিকৃত করেছে।

ইসলামের বৈপ্লবিক আদর্শ যারা মানতে পারেন না, তাদেরকেও স্বীকার করতে হবে যে, নারী-পুরুষের দৈহিক গঠন ও সামর্থ্য কখনই একরকম নয় এবং এই শারীরিক পার্থক্যকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে আদিম শ্রমবিভাজন। পুরুষ বাইরে আর নারী কাজ করেছে গৃহে। এই শ্রমবিভাজন সামাজিক বিকাশকে শুধু ভারসাম্যতাই দেয়নি, যুগ যুগ ধরে তা প্রশংসনীয় ও গ্রহণীয় হয়ে এসেছে।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে মুনাফাখোরী এবং অর্থলিপ্সার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হওয়ায় নারী হয়েছে সবচেয়ে সস্তা পণ্য। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা এদেরকে যেনতেন কাজে ব্যবহার করে দুহাতে পয়সা কামাচ্ছে এবং যখনই অবাধ বিচরণ নামের ব্যভিচার বন্ধের দাবি উঠছে তখনই এরা নিজেদের ভবিষ্যত অন্ধকার ভাবছে। করছে অনৈতিক প্রতিবাদ।

স্বাধীনতার নামে নারীর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে সামান্য কিছু পয়সা। এই স্বাধীনতার লক্ষ্য যদি হয় সুখী হওয়া, তবে হলফ করেই বলা যায়, এরা নারীদের সঙ্গে চরম প্রতারণা করেছে এবং সুখী করার নামে এদের সংসারকে ভরে দিয়েছে শূন্যতায়। সংসারটা মূলত নারীরাই পরিচালনা করে। সংসারমুখি সুগৃহিণী রচনা করে সাংসারিক সুখের ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ‘নারীপণ্য’ ব্যবহার করে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা সেই শ্বাশ্বত বুনিয়াদকে নারী স্বাধীনতার নামে ধ্বংসের মুখে নিপতিত করেছে।

আর যদি নারীকে পেশার সঙ্গে যুক্ত হতেই হয়, ইসলাম সেটাকেও বারণ করে না। বরং ইসলামের ইতিহাসের বহু ঘটনা এমন পাওয়া যায়, যেখানে নারী সরাসরি অর্থোপার্জনের কাজে অংশ গ্রহণ করেছেন। আসমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা মদীনার উপকণ্ঠ থেকে উটের খাদ্য সংগ্রহ করে সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করতেন, অনেক নারী সরাসরি কেনাবেচা করেছেন বলেও বর্ণনায় পাওয়া যায়।

পবিত্র কুরআনে সম্পদের মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। দেখুন আল্লাহর বাণী কী বলে :

﴿ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٞ مِّمَّا ٱكۡتَسَبُواْۖ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٞ مِّمَّا ٱكۡتَسَبۡنَۚ وَسۡ‍َٔلُواْ ٱللَّهَ مِن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٣٢ ﴾ [النساء: ٣٢]

‘পুরুষদের জন্য রয়েছে অংশ, তারা যা উপার্জন করে তা থেকে এবং নারীদের জন্য রয়েছে অংশ, যা তারা উপার্জন করে তা থেকে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৩২)

নারীর নিজের উপার্জিত অর্থের মালিক সে নিজেই। তার বাবা, ভাই বা স্বামীর তাতে কোনো অধিকার নেই। তারা কেউ তার মালিকানায় বাগড়া দিতে পারবেন না। বিখ্যাত প্রতাপশালী শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের স্ত্রী ঘরে চরকায় সূতা কাটতেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘অভাবের কারণে নয়, আমি পিতার নিকট থেকে আয়-রোজগারের এই শিক্ষা পেয়ে এসেছি।’

ইসলাম নারীদের বন্দি করতে চায় না। চায় তাকে নিরাপদ রাখতে। এ কারণেই ইসলাম নারীকে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে আসতে নিরুৎসাহিত করে। এর অর্থ এ নয় যে সে প্রয়োজনের সময় বের হতে পারবে না। নিরাপদ পরিবেশে ইসলামের চেতনা ভূলুণ্ঠিত না করে নারীর অর্থোপার্জনে ইসলাম কোনো অন্তরায় তৈরি করে না। অথচ ইসলামের শত্রুরা অপব্যাখ্যা করে স্বার্থ হাসিলের জন্য নারীদের ক্ষেপিয়ে তোলার চক্রান্ত করছে।

মনে রেখো নারী! এরা এভাবেই সামান্য মঞ্চের মাইক, স্লোগান দেবার সুযোগ প্রদান কিংবা এরচেয়েও সস্তা মূল্যের নগণ্য কিছু বস্তু দিয়ে তোমার ইজ্জত-সম্ভ্রম কেড়ে নিতে ওঁৎ পেতে আছে। এজন্যই বলি, নারী তার নিজস্ব বলয়ের স্বাধীনতা, অধিকার, সম্মান এবং অর্থোপার্জনের অধিকার লালন করুক। কিন্তু তারা যেন কারো হাতে ব্যবহৃত না হয়। তাদের দেহ, সম্ভ্রম ও ইজ্জতকে সওদা বানিয়ে কেউ মুনাফাখোরি না করুক। ধর্ষিত, সম্ভ্রমহারা, বিবস্ত্র নারীর দেহে সম্মানের চাদর পরিয়ে দেয়া যদি অপরাধ না হয় তবে নারীর প্রতি শালীনতার আহ্বান জানানোও অপরাধ নয়।

একথা স্মরণ রাখা চাই যে, ইসলাম নারী অধিকারের যে নিখুঁত রূপরেখা প্রদান করেছে এটা বাস্তবায়ন না করা হলে নারী কখনই তার প্রাপ্ত সম্মান ও অধিকার লাভ করতে পারবে না। আজ নারীকে ইসলাম যে সম্মান দিয়েছে সেটা নিশ্চিত না করে বরং তাদেরকে শ্রমিক-গৃহপরিচারিকা এবং অন্য পুরুষের ভোগের পণ্য বানানোর জঘন্য পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। এসব ঘৃণ্য পরিকল্পনা রুখতে না পারলে অচিরেই মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে, যার প্রথম ও চূড়ান্ত আঘাত আসবে খোদ নারীর ওপরেই। মনে রাখতে হবে বিশেষ এক হেকমতে মীরাছ ছাড়া অন্য সবখানেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে তার প্রাপ্ত যাবতীয় হক আদায় করার আদেশ করেছেন। এমনকি তিনি নারীর অধিকার শুধু নিশ্চিতই করেন নি, বরং তাদেরকে পুরুষের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছেন। যেমন

«سَاوُوا بَيْنَ أَوْلَادِكُمْ فِي الْعَطِيَّةِ، وَلَوْ كُنْتُ مُؤْثِرًا أَحَدًا لَآثَرْتُ النِّسَاءَ عَلَى الرِّجَالِ»

‘তোমরা দান-হাদিয়ার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করো। কেননা আমি যদি কাউকে অন্যের ওপর প্রাধান্য দিতাম তবে নারীকে প্রাধান্য দিতাম।’ [সুনানে বায়হাকী : ১২৩৫৭; তাবারানী : ১১৯৯৭]

সুতরাং শরঈ গণ্ডির মধ্যে যদি অগ্রাধিকার দেয়া সম্ভব হতো তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকেই অগ্রাধিকার দিতেন। সুতরাং নারীদের প্রতি দরদ ও অনুগ্রহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো বেশি থাকতে পারে না।

নারীদের গৃহকর্ম ও সংসার পরিচালনার আর্থিক লাভ কোনো অংশে বাইরে চাকরি করে টাকা উপার্জনের চেয়ে কম নয়। এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গৃহিণীদের দ্বারা যে গৃহকর্ম হয় তার খরচ ২২ হাজার কোটি টাকা! সুতরাং হিসেবে যুক্ত না হলেও গৃহিণীদের দ্বারা প্রতিবছর এই পরিমাণ টাকা আয় হচ্ছে। তো প্রগতিবাদী ও নারী স্বাধীনতার তথাকথিত দাবিদারদের কথা অনুযায়ী সব নারী যদি ঘরের বাইরে চলে আসে তবে সংসারই বা দেখবে কে আর বছরে এই বাইশ হাজার কোটি টাকার যোগানই বা দেবে কে? স্বার্থান্বেষী এই মহল কি এই পরিসংখ্যানটা মাথায় রাখে?

নারী তাদের ইজ্জত বিক্রি করে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করবে, ইসলাম তা কখনও বরদাশত করে না বরং পুরুষ নিজের রক্তকে ঘামে পরিণত করে ইজ্জতের সঙ্গে তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করবে এটাও আদেশ করে। যারা ইসলামের এই মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে না, সব বিতর্ক বাদ দিয়ে তাদেরকে মানুষ বলে আখ্যায়িত করা যায় কিনা- সর্বাগ্রে এই বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যেতে পারে!