প্রথম মূলনীতি: আল্লাহর সকল নামই অতি নান্দনিক।

 অর্থাৎ সেগুলো সৌন্দর্যে সর্বশীর্ষে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ﴾ [الاعراف: ١٨٠]

আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামের মাধ্যমে ডাক। (সূরা আল আরাফ: ৭: ১৮০)

কারণ তা পূর্ণাঙ্গ গুনাবলীসম্পন্ন, যাতে কোনোভাবেই কোনো প্রকার অপূর্ণতা নেই, না সম্ভাব্য কোনো অপূর্ণতা না অব্যক্ত কোনো অপূর্ণতা।

এর উদাহরণ ( الحي- আল হাইউ) ‘চিরঞ্জীব’ আল্লাহর নামসমূহের একটি নাম, যা এমন পূর্ণাঙ্গ জীবনকে নির্দেশ করে যা অস্তিত্বহীনতার পর্ব পেরিয়ে আসেনি এবং যাকে কখনো অস্তিত্বহীনতা স্পর্শ করবে না। যে জীবন সকল পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীর ধারক, যেমন: জ্ঞান, ক্ষমতা, শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি ইত্যাদি।

দ্বিতীয় উদাহরণ: ( العليم-আল আলীমু) ‘সর্বজ্ঞ’ আল্লাহর নামসমূহের একটি, যা পরিপূর্ণ জ্ঞানকে নির্দেশ করে, যে জ্ঞান কোনো অজ্ঞতার পর্ব পেরিয়ে আসেনি এবং যে জ্ঞানকে কোনো বিস্মৃতি স্পর্শ করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ قَالَ عِلۡمُهَا عِندَ رَبِّي فِي كِتَٰبٖۖ لَّا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنسَى ٥٢ ﴾ [طه: ٥٢]

মূসা বলল, ‘এর জ্ঞান আমার রবের নিকট কিতাবে আছে। আমার রব বিভ্রান্ত হন না এবং ভুলেও যান না’। [সূরা তাহা: ২০: ৫২]

সুপরিব্যাপ্ত জ্ঞান যা সবদিক থেকে সকল কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে, হোক তা আল্লাহ তা‘আলার কর্মাদি বিষয়ক অথবা মাখলুকের কর্মাদি বিষয়ক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ۞وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚ وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعۡلَمُهَا وَلَا حَبَّةٖ فِي ظُلُمَٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡبٖ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٥٩ ﴾ [الانعام: ٥٩]

আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি অবগত রয়েছেন স্থলে ও সমুদ্রে যা কিছু আছে। আর কোন পাতা ঝরে না, কিন্তু তিনি তা জানেন এবং যমীনের অন্ধকারে কোন দানা পড়ে না, না কোনো ভেজা এবং না কোন শুষ্ক কিছু; কিন্তু রয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবে। [আল আনআম: ৫৯]

﴿ ۞وَمَا مِن دَآبَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِ رِزۡقُهَا وَيَعۡلَمُ ُسۡتَقَرَّهَا وَمُسۡتَوۡدَعَهَاۚ كُلّٞ فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٦ ﴾ [هود: ٦]

আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিযকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল[1]। সব কিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে[2]। [সূরা হূদ: ১১: ৬]

﴿ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَيَعۡلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعۡلِنُونَۚ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ٤ ﴾ [التغابن: ٤]

আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তিনি তা জানেন এবং তিনি জানেন যা তোমরা গোপন কর এবং যা তোমরা প্রকাশ কর। আল্লাহ অন্তরসমূহে যা কিছু আছে সে বিষয়ে সম্যক অবগত। [সূরা আত-তাগাবুন : ৬৪: ৪]

তৃতীয় উদাহরণ: (الرحمن-আর রাহমানু) ‘পরম করুণাময়’ আল্লাহর নামসমূহের একটি যা পরিপূর্ণ রহমতকে শামিলকারী, যে রহমত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لله أرحم بعباده من هذه بولدها»

‘এই নারী তার সন্তানের প্রতি যতটুকু করুণশীল আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের প্রতি এর থেকেও অধিক করুণাশীল।’[3] উক্ত হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন। আর তা হলো, এক যুদ্ধ শেষে এক নারী তার শিশুকে যুদ্ধবন্দিদের ভেতরে পেল। সে তাকে তুলে নিল, পেটের সঙ্গে লাগাল এবং তাকে দুধ পান করাল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত হাদীসটি ব্যক্ত করলেন। রহমান শব্দটি আল্লাহ তা‘আলার ওই ব্যাপক দয়া-করুণাকেও শামিল করে আছে যে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ ﴾ [الاعراف: ١٥٦]

আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত রয়েছে। (আল আরাফ: ৭: ১৫৬)

এই রহমতের ইঙ্গিত মুমিনদের জন্য ফেরেশতাদের প্রার্থনার মধ্যেও ব্যক্ত হয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলা নিম্নবর্তী আয়াতে উল্লেখ করেছেন।

﴿رَبَّنَا وَسِعۡتَ كُلَّ شَيۡءٖ رَّحۡمَةٗ وَعِلۡمٗا ﴾ [غافر: ٧]

হে আমাদের রব, আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। (গাফের: ৪০: ৭)

আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে সৌন্দর্য প্রতিটি নাম আলাদা থাকা অবস্থায় যেমন পাওয়া যায়, অনুরূপভাবে একটি নামকে অন্যটির সঙ্গে একত্র করার সময়ও পাওয়া যায়। আর একটি নামকে অন্যটির সঙ্গে একত্র করলে পরিপূর্ণতার পর আরও অধিক পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়।

এর উদাহরণ: ( العزيز الحكيم আল আযীযুল হাকীম) ‘সর্বশক্তিমান অধিক প্রজ্ঞাময়’। আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনের বহু জায়গায় এ দুটি নামকে একত্র করে উল্লেখ করেছেন। এ অবস্থায় প্রতিটি নাম একদিকে তার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গতাকে বুঝায়। যেমন ‘আল আযীয’ নামে ‘ইয্যত’ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ শক্তি এবং ‘আল হাকীম’ নামে পূর্ণাঙ্গ হিকমত ও প্রজ্ঞাকে বুঝায়। আর এ দুটিকে একত্র করলে অন্য আরেকটি পূর্ণাঙ্গ গুণকে বুঝায়। আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলার শক্তি হিকমতপূর্ণ। ফলে আল্লাহ তা‘আলার শক্তি কোনো জুলুম-অন্যায় ও অপকর্মকে দাবি করে না, যেমনটি হতে পারে সৃষ্টিজীবের মধ্যে যারা শক্তিধর তাদের ক্ষেত্রে। কেননা সৃষ্টিজীবের মধ্যে যে শক্তিমান সে হয়ত গুনাহ গোপন রাখার জন্য তার শক্তিমত্তাকে ব্যবহারে উদ্রগ্রীব হয়ে ওঠতে পারে। ফলে সে জুলুম-অন্যায় ও অপকর্ম করতে শুরু করবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর বিচার ও হিকমত পূর্ণাঙ্গ শক্তিমিশ্রিত, সৃষ্টিজীবের বিচার ও হিকমতের বিপরীত; কেননা সৃষ্টিজীবের বিচার ও হিকমতে নিচুতা ও অজ্ঞতা মিশ্রিত হয়।

[1] এখানে مستقر বা আবাসস্থল বলতে মাতৃগর্ভে অবস্থান মতান্তরে মৃত্যু পর্যন্ত দুনিয়ায় অবস্থানকে বুঝানো হয়েছে। আর مستودع দ্বারা কবরস্থ করার স্থান মতান্তরে জন্মের পূর্বে পিতৃমেরুদন্ডে অবস্থান কিংবা মৃত্যুর সময় বা স্থান বুঝানো হয়েছে।

[2] অর্থাৎ লওহে মাহফুযে।

[3] বর্ণনায় বুখারী, আদব অধ্যায়, অনুচ্ছেদ : সন্তানের প্রতি করুণা, তাকে চুম্বন করা ও গলায় লাগানো। হাদীস নং (৫৯৯৯); মুসলিম, তাওবা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ : আল্লাহ তাআলার রহমতের ব্যাপ্তি, হাদীস নং (২৭৫৪)