অতঃপর....

আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় এ সাক্ষাৎ থেকে খুব সহজেই আমি এবং যিনি বা যারা আমার কথাগুলো শুনেছেন অথবা পাঠ করেছেন -তাদের প্রত্যাশিত ফায়দা হাসিলের কারণে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করছি -তিনি যাতে আমাদের সকল আমলকে নির্ভেজালভাবে তাঁর উদ্দেশ্যে ও তাঁর মর্জি মাফিক বানিয়ে দেন; কিন্তু আমি ভালো মনে করছি যে, বিষয়বস্তুর ভিতরে প্রবেশ করার পূর্বে এমন কিছু কথা উপস্থাপন করব, যা এ অবস্থার জন্য যথাযথ হবে ইনশাআল্লাহ। আর তা হলো,

হে প্রিয় ভাইসব! আপনারা জানেন যে, আমাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার প্রদত্ত নি‘আমতরাজির মধ্যে সবচেয়ে বড় নি‘আমত হলো, তিনি আমাদেরকে এ দীন তথা দীন ইসলামের পথ দেখিয়েছেন, যা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সঠিক দীন। কারণ, তিনি এ দীনের মাধ্যমে প্রত্যেক হকের অধিকারীকে তার হক দিয়ে দিয়েছেন আর প্রত্যেক মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার মর্যাদার আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি ইবাদতের অবস্থানে ইবাদাতকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন আল্লাহর জন্য, যিনি এক, যাঁর কোনো শরীক নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ﴾ [البينة: ٥]

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫] কারণ, তিনি একমাত্র স্রষ্টা। সুতরাং ইবাদাত একমাত্র তাঁর জন্য হওয়াটাই আবশ্যক, আর তিনি হলেন প্রিয়, আপন মহিমায় মহীয়ান। ফলে সকল নিয়ত ও আমল আল্লাহ তা‘আলার জন্যই হওয়া আবশ্যক। আর সৃষ্টির সাথে লেনদেন ও আচার-আচরণ প্রসঙ্গে তিনি প্রত্যেক হকদারকে তার হক বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। সুতরাং স্বীয় নাফসের কিছু হক বা অধিকার রয়েছে, ওয়াজিব হলো সে অধিকার তাকে দিয়ে দেওয়া। আর পরিবার-পরিজনের কিছু অধিকার রয়েছে, ওয়াজিব হলো তা তাদেরকে দিয়ে দেওয়া। আর সঙ্গী-সাথীদেরও কিছু অধিকার রয়েছে, ওয়াজিব হলো তাদেরকে তা থেকে বঞ্চিত না করা। আর আমাদের মাঝে ও আমরা ভিন্ন অন্যদের মাঝে সংঘটিত চুক্তিসমূহের ব্যাপারে তিনি আমাদেরকে তা পূরণ করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং তা ভঙ্গ ও খিয়ানত করার ব্যাপারে নিষেধ করেন। সুতরাং ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ আমাদের দীন এমন এক দীন, যা সংক্ষেপে ও বিস্তারিতভাবে যাবতীয় উত্তম চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করে এবং সংক্ষেপে ও বিস্তারিতভাবে যাবতীয় মন্দ ও খারাপ চরিত্র থেকে নিষেধ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে যথাযথভাবে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে ব্যক্তি তাকে সর্বোত্তম দীন ও সুদৃঢ় মজবুত জীবন বিধান হিসেবে পাবে, আরও পাবে তাকে সকল যুগ-যমানা ও স্থানের জন্য যোগ্য ও যথোপযুক্ত দীন হিসেবে। আর এ দীন তার অনুসারীর জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে গৌরব, সম্মান ও মর্যাদার বিষয় এবং সৌভাগ্যের জামিনদার। আর এর দ্বারাই বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে, আর যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে, সে যেন ইসলামের প্রারম্ভিক কালের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি দেয়, যখন মুসলিমগণ বাহ্যিক ও ভিতরগত উভয়ভাবেই মুসলিম ছিলেন অথচ দুনিয়ার জীবন তাদেরকে প্রতারিত করতে পারে নি এবং আল্লাহর ব্যাপারেও কোনো প্রতারণা বা অহমিকা তাদেরকে প্রতারিত করতে পারে নি। অতএব, আমাদের জন্য আবশ্যকীয় করণীয় হলো আমরা আল্লাহর শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব এ জন্য যে, তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এ মহামূল্যবান সরল সঠিক দীনের মাধ্যমে, আর আমরা এ মহান নি‘আমতকে বেঁধে রাখব নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, সে অনুযায়ী বাহ্যিকভাবে ও অভ্যন্তরীণভাবে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে আমল করার মাধ্যমে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَإِن تَتَوَلَّوۡاْ يَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَيۡرَكُمۡ ثُمَّ لَا يَكُونُوٓاْ أَمۡثَٰلَكُم ٣٨﴾ [محمد: ٣٨]

“আর যদি তোমরা বিমুখ হও, তবে তিনি তোমাদের ছাড়া অন্য সম্প্রদায়কে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, তারপর তারা তোমাদের মত হবে না”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮]

সুতরাং দীনের মতো নি‘আমতের যখন শুকরিয়া আদায় করা হবে, তখন তা স্থায়ী হবে এবং বৃদ্ধি পাবে। আর যদি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা না হয়, তাহলে তা (দীন) বিলীন ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তার পরিবর্তে কুফুরী, বিদ‘আত ও পথভ্রষ্টতার লক্ষণ দেখা দেবে; আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি অনুমান ও অনুধাবন করতে পারে যেমনিভাবে শান্তি ও নিরাপত্তার মতো নি‘আমতের শুকরিয়া যখন আদায় করা হয় না, তখন তাকে ভয়-শঙ্কা দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হয় এবং রিযিকের মতো নি‘আমতের শুকরিয়া যখন আদায় করা হয় না, তখন তাকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনিভাবে যখন দীনের মতো নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করা না হয়, তখন সেই নি‘আমতকে ‘কুফুরী’ দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। আর ইসলাম ঐ ব্যক্তির নিকট সবচেয়ে প্রিয়, যে নিজেকে তার সাথে সম্পৃক্ত করে। সুতরাং যখন এমন মানুষ পাওয়া না যাবে, যারা তাদের প্রতি প্রদত্ত আল্লাহর নি‘আমতের কদর বা মর্যাদা বুঝতে পারবে, তাকে দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরবে এবং তাকে নি‘আমত মনে করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তা তাদের থেকে গুটিয়ে নিবেন। অতঃপর অচিরেই তা তাদের নিকট থেকে অন্যদের নিকট চলে যাবে।

সুতরাং হে ভাইসব! আমি আপনাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি সকল কাজে ন্যায়নীতি অবলম্বন করার এবং সকল বিষয় বা কাজে তুলনামূলক পর্যালোচনার, আর সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয়ে হুকুম বা সিদ্ধান্ত দেওয়ার উপদেশ দিচ্ছি। আর পর্যালোচনায় সমান হয়ে গেলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বিধান করার উপদেশ দিচ্ছি, আর এটা একটি বড় ধরনের নিয়ম-নীতি। বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হলো আল্লাহর দিকে তার চলার ক্ষেত্রে এবং আল্লাহর বান্দাগণের সাথে চালচলন ও আচরণের ক্ষেত্রে সে নীতির অনুসরণ করা, যাতে সে ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। আর আল্লাহ তা‘আলা ন্যায়নীতিবান লোকদেরকে ভালোবাসেন। আর তোমাদের ওপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো, তোমাদের নিকট যে আমানত রাখা হয়েছে, তোমরা তা যথাযথভাবে সম্পাদন কর। যেমন, প্রত্যেক মানুষ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এমনভাবে পালন করবে, যা তার নিকট দাবি করা হবে, কোনো প্রকার কম-বেশি না করে। সুতরাং যে ব্যক্তি তার আমানতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে, সে ব্যক্তি লাভবান ও সফলকাম হবে, আর যে ব্যক্তি সেক্ষেত্রে ভুল করবে, সে হবে হতভাগ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বান্দাগণকে সংশোধন করতে চাইবে এবং তাদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করার ইচ্ছা করবে, তার ওপর আবশ্যক হলো নিয়তকে একনিষ্ঠ ও নির্ভেজাল করা এবং আমলকে পরিশুদ্ধ করা। সুতরাং যখন নিয়ত পরিষ্কার হবে এবং কল্যাণসমূহ ও তা অর্জনের সর্বোত্তম পদ্ধতি সম্পর্কে ইজতিহাদ (গবেষণা) ও চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে আমল পরিশুদ্ধ হবে, যখন সে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এবং সংস্কার ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ইজতিহাদ -এ দু’টি বিষয় দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হবে, তখন সকল জিনিস পরিশুদ্ধ হবে এবং সকল কাজ যথাযথভাবে সুসম্পন্ন হবে। আর যখন ‘ইখলাস’ অথবা ‘ইজতিহাদ’ এ দু’টি বিষয়ের কোনো একটির ঘাটতি হবে, তখন এর সমপরিমাণে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে। আর আল্লাহর বান্দাগণকে দাওয়াত দেওয়ার সময় অন্যতম একটি হিকমত বা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অন্যের কাজগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেবে সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতার দৃষ্টিতে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা যাকে রক্ষা করেন সে ব্যতীত প্রত্যেকেই অনিবার্যভাবে ভুল করে; কিন্তু এটা হিকমতের অন্তর্ভুক্ত নয় যে, মানুষ শুধু ভুল-ত্রুটির দিকটাই দেখবে এবং নির্ভুল ও সঠিক দিকটি পাশ কাটিয়ে যাবে; বরং সে (ভুল ও সঠিক) দু’টি দিকই দেখবে এবং উভয়ের মাঝে তুলনামূলক পর্যালোচনা করবে, তারপর সে ভুল সংশোধন করার ব্যাপারে চেষ্টা করবে। কারণ, মুমিনগণ একটি প্রাসাদের মতো, যার এক অংশ অপর অংশকে মজবুতভাবে বেঁধে রাখে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু’টি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন:

«لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً ، إنْ سَخط مِنْهَا خُلُقاً، رَضِيَ مِنْهَا خُلُقاً آخَرَ».

“কোনো মুমিন পুরুষ যেন কোনো মুমিন নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ না করে। কারণ, যদি তার কোনো একটি স্বভাব তার কাছে অপছন্দ হয়, তবে তার অন্য আরেকটি স্বভাব-চরিত্র তার কাছে পছন্দ হতে পারে।”[1]

কখনও কখনও আপনার দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, আপনার সাথী ভুল করেছে। আর যখন আপনি তা ভালোভাবে পর্যালোচনা করবেন, তখন আপনার নিকট পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, সে ভুল করে নি। সুতরাং একনিষ্ঠতাসহ ও ভালো উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিষয় ও কাজের ব্যাপারে পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করাটা সে বিষয় বা কাজের শুদ্ধতা ও সফলতার অন্যতম উপায়।

অতএব, হে আমার ভাই! হিকমত সম্পর্কে জানুন এবং হিকমতের (প্রজ্ঞার) নীতি অনুসরণ করুন, আর প্রত্যেক পাওনাদারকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিন এবং প্রত্যেক কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি প্রদান করুন। প্রত্যেক মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার মর্যাদার স্বীকৃতি দিন আর এটাই হলো হিকমত বা প্রজ্ঞা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِيَ خَيۡرٗا كَثِيرٗاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٦٩﴾ [البقرة: ٢٦٩]

“আর যাকে হিকমত প্রদান করা হয় তাকে তো প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। আর বিবেকবানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬৯]

[1] সহীহ মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ।