হজের সাথে সংশ্লিষ্ট আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিসমূহ প্রথম ভাগ - মক্কায় পৌঁছার পূর্বে আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিসমূহ ইসলামহাউজ.কম
দ্বিতীয় অধ্যায় - লোক দেখানোর জন্য ও সুনামের উদ্দেশ্যে হজ করা

‘রিয়া’ (الرياء) শব্দটি الرؤية (দেখা) শব্দ থেকে নির্গত, আর তার মানে হলো: মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদতকে প্রকাশ করা, ফলে তারা ইবাদত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করে।[1]

‘রিয়া’ ও ‘সুম‘আ’ -এর মধ্যে পার্থক্য:

‘রিয়া’ হলো জনগণকে দেখানোর জন্য আমল করা, আর ‘সুম‘আ’ হলো তাদেরকে শুনানোর জন্য আমল করা। সুতরাং ‘রিয়া’ -এর সম্পর্ক দৃষ্টিশক্তির অনুভূতির সাথে; আর সুম‘আ’ -এর সম্পর্ক হলো শ্রবণশক্তির অনুভূতির সাথে। আর তার মধ্যে শামিল হবে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার আমলকে গোপন করা, অতঃপর তা জনগণের নিকট বর্ণনা বা প্রচার করা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো আমল করা থেকে সতর্ক করেছেন; নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللَّهُ بِهِ

“যে ব্যক্তি স্বীয় খ্যাতি অর্জনের চিন্তায় ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জনমনে তার আসল চেহারা উন্মোচন করে দেবেন; আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জনগণকে তার প্রকৃত অবস্থা দেখিয়ে দেবেন।”[2]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ، قَالُوا : وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : الرِّيَاءُ، يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ : إِذَا جَازَى النَّاسَ بِأَعْمَالِهِمْ : اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ مِنْ جَزَاءٍ ؟»

“আমি তোমাদের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ভয় করি, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হলো ‘ছোট্ট শির্ক’। সহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! ‘ছোট্ট শির্ক’ কী? জবাবে তিনি বললেন: লোক দেখানো আমল। কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দিবেন, তখন তিনি এ জাতীয় লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলবেন: তোমরা ঐসব লোকের কাছে যাও, যাদেরকে দেখানোর জন্য তোমরা দুনিয়াতে আমল করতে; তারপর দেখ- তাদের নিকট তোমরা কোনো প্রতিদান পাও কিনা?।”[3]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করেছেন, যাতে তিনি তাঁর হজকে একান্তভাবে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট করে নেন, লোক দেখানো ও সুখ্যাতি অর্জনের কারণ না বানান; আর সে দো‘আর একটি হলো:

«اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا حَجَّةً غَيْرَ رِيَاءٍ وَلاَ مُهابَةٍ وَلاَ سُمْعَةٍ» .

“হে আল্লাহ! আপনি এটাকে এমন হজে পরিণত করুন, যাতে (আপনার উদ্দেশ্য ছাড়া) কোনো রকম ‘রিয়া’ (প্রদর্শনী), প্রতিপত্তি ও সুনামের উদ্দেশ্য না থাকে।”[4]

আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, হজের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় লোক দেখানোর জন্য, তাহলে হজটি বাতিল বলে গণ্য হবে; আর হজের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, তারপর হঠাৎ করে তার ওপর ‘রিয়া’ বা লোক দেখানোর নিয়ত এসে আপতিত হয়, অতঃপর তা যদি মনে মনে থাকে এবং তা মন থেকে দূর করে দেয়, তাহলে তা তার জন্য ক্ষতিকর হবে না; আর যদি সে লোক দেখানোর নিয়তটি তার সাথে স্থায়ী হয়ে পড়ে, তাহলে তা তার পুরো হজটাকে নষ্ট করে ফেলবে। কারণ, হজ এমন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যার শেষটা প্রথম অংশের সাথে সংযুক্ত।[5]

বস্তুত হজ হলো একসাথে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত একটি ইবাদত, আর মুসলিমগণকে তা পালন করার সময় অনেক কষ্ট ও ক্লান্তির শিকার হতে হয়; কিন্তু তারা এসব কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেন আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ও তাঁর জান্নাত পাওয়ার দাবিতে।

আর যে জিনিসটি তাদেরকে এসব কষ্ট ও ক্লান্তিকে ভুলিয়ে রাখে, তা হলো নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বর্ণিত ঐসব হাদীস, যা হজের ফযীলত ও হাজী সাহেবের সাওয়াব প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।

আর এসব হাদীসের মধ্য থেকে অন্যতম একটি হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যেখানে তিনি বলেছেন:

«الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا, والْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ»

“এক উমরা থেকে আরেক উমরা- উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের জন্য কাফ্ফারা, আর মাকবূল (কবুল) হজের একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।”[6]

কিন্তু সেখানে কোনো কোনো হাজী সাহেবকে দেখা যায়- তারা হজের নিয়ত করেন এবং কতবার হজ করেছেন তাকে সংখ্যায় প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আর তাদের কেউ কেউ চিন্তা করেন হজ থেকে ফিরে আসার সময় তাকে বলা হবে: ‘আল-হজ অমুক’। আবার কেউ চিন্তা করেন: সে যখন কোনো মাজলিসে কথা বলবে, তখন সে বলবে: ‘আমি সাতবার হজ করেছি’ অথবা সে বলবে: ‘আমি ‘আরাফাতে পনের বার অবস্থান করেছি’।

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, ‘হাজীগণের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যিনি চান- সাক্ষাতের সময় তাকে ‘আলহাজ্জ’ বলা হবে। আর হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনকারীগণের মধ্য থেকে এমন অনেক আছেন, যার চিন্তা হলো তার হজের সংখ্যাতথ্য প্রকাশ করা, ফলে তিনি বলেন, ‘আমি আরাফার ময়দানে বিশ বার অবস্থান করেছি’।[7] আর অনেক আশ্রয়দানকারী আছেন, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে মক্কায় অবস্থান করছেন, অথচ তিনি এখনও তার ভিতরকে পবিত্র করার কাজটি শুরু করেন নি, আর কখনও কখনও তার চিন্তার সম্পর্ক থাকে এমন সব অবদানের সাথে, যে অবদান তিনি তার কাছে থাকা কারও জন্য রেখেছেন। আবার কখনও কখনও তিনি বলেন, আশ্রয়দানকারী ও সেবক হিসেবে আজকে আমার বিশ বছর পূর্ণ হলো। আর একটা গোষ্ঠীর ওপর শয়তান ভর করেছে, তাদের কেউ কেউ হজ আদায়ের পদ্ধতির মধ্যে এমন কিছু নতুন বিষয় চালু করেছে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে আমি একদল লোককে দেখি- তারা তাদের ইহরামের মধ্যে কৃত্রিম ভান করে, যার ফলে তারা একটি কাঁধকে খোলা রাখে এবং কয়েক দিন এভাবে সূর্যের তাপের মধ্যে অবস্থান করে, তারপর তাদের চামড়া খসে পড়ে এবং তাদের মাথা ফুলে যায়, আর এর দ্বারা মানুষের মাঝে নিজের ভাব বা সৌন্দর্য প্রকাশ করে’।[8] আর এ ধরণের আকীদা পরিপন্থী কাজ এ যুগের মানুষের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে।

>
[1] ‘ফাতহুল বারী বি-শরহে ‘সহীহ আল-বুখারী’: (১১/৩৪৪); ‘ই‘লামুল মূওয়াক্কি‘ঈন’: (২/১৭০) তাফসীরে কুরতুবী: (২০/১২); আশ-শাতেবী, ‘আল-ই‘তিসাম’: (২/৩১২)।

[2] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ৬৪৯৯; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৯৮৬)।

[3] আহমাদ, আল-মুসনাদ: (২৩১৯)

[4] বায়হাকী, আস-সুনান (৪/৩৩২, ৩৩৩), কিতাবুল হজ।

[5] ‘জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম’: (১/৮১-৮৪); ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (পৃ. ৫৩০-৫৩৪)।

[6] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৬৮৩; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৩৪৯; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮৮৮; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ৯৩৩; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৬২৮।

আর হজের ফযীলত সম্পর্কে একগুচ্ছ হাদীস দেখুন: আত-তারগীব ওয়া আত-তারহীব: (২/১৬২-১৮৩); ‘মাজমা‘উ আয-যাওয়ায়েদ’: (৩/২০৬-২১০); ‘ইতহাফ আল-খায়রাত’: (৩/১৩৮-১৪১); ‘আল-মাতালেব আল-‘আলীয়া’: (৬/২৬২-২৯০)।

[7] অর্থাৎ আমি বিশবার হজ করেছি।

[8] ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩০-৮৩১) সংক্ষেপ করে উদ্ধৃত; আরও দেখুন: ‘আস-সুনান ওয়াল মুবতাদা‘আত আল-মুতা‘আল্লাকা বিল আযকার ওয়াস সালাওয়াত’: (পৃ. ১৫১-১৫২)।