লা-তাহযান [হতাশ হবেন না] লা-তাহযান - অনুচ্ছেদ সূচি ড. আয়িদ আল করনী
২৩৬. হতাশ হবেন না (আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে গবেষণা করুন)

এ পৃথিবী ও বিশ্বজগতে আল্লাহর যেসব নিদর্শনাবলি আছে আপনি যদি তা নিয়ে গবেষণা করেন, তবে আপনি এমন সব বিস্ময়কর জিনিস পাবেন যা আপনার দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা দূর করে দিবে; (কেননা) আত্মা আজব, বিস্ময়কর ও অদ্ভুত বিষয়ে আনন্দ পায়।

ইমাম বুখারী (রহঃ) ও ইমাম মুসলিম (রহঃ) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এক অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন এবং (সে অভিযানে) তিনি আবু উবাইদাহ (রাঃ)-কে আমাদের নেতা (হিসেবে নিয়োজিত করলেন বা) বানিয়ে দিলেন। কোরাইশদের একটি কাফেলার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করার কথা ছিল। তিনি যেহেতু আমাদের খাবারের জন্য অন্য কিছু পেলেন না, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে যাত্রার জন্য মাত্র এক কৌটা খেজুর আমাদেরকে যোগাড় করে দিলেন। সুতরাং আমরা যেদিন বেরিয়ে পড়লাম সেদিন থেকে সামনের কিছু দিন পর্যন্ত আবু উবাইদাহ (রাঃ) আমাদের প্রত্যেককে প্রতিদিন একটি করে খেজুর দিতেন।”

হাদীসের রাবী (বর্ণনাকারী) জাবের (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “তারা সে একটি করে খেজুর দিয়ে কী করত?” তিনি উত্তর দিলেন, “আমরা শিশুদের মতো করে সে একটি খেজুর চুষে খেতাম। তারপর আমরা পানি পান করতাম। সারাদিনের মতো আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। (খেজুর শেষ হয়ে গেলে পরে) আমরা আমাদের লাঠি দিয়ে গাছের পাতা পেড়ে তা পানিতে ভিজিয়ে খেতাম। তখন আমরা খাবারের তালাশে সমুদ্র তীরে হাটছিলাম এমন সময় একদিন আমরা এমন কিছু একটা দেখতে পেলাম যা দূর থেকে বিশাল বালুর পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছিল।

যখন আমরা এটার কাছে গেলাম তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, এটা তিমি নামক এক বিশাল সামুদ্রিক সৃষ্টি। আবু উবাইদাহ (রাঃ) প্রথমে বললেন যে, এ প্রাণীটি বিনা জবাইতে মারা গেছে (তাই এটা খাওয়া হারাম)। (কিন্তু) পরে তিনি বললেন, “না, (আমরা) আল্লাহর রাসূলের দূত। আমরা আল্লাহর পথে আছি এবং আমরা ভয়াবহ শোচনীয় অবস্থায় আছি। অতএব তোমরা সবাই এটা খাও।”

আমরা তিনশতজন সবাই একমাস ধরে এটা খেয়ে খেয়ে মুটিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে কীভাবে আমরা বর্শা নিয়ে এটার চক্ষু কোটরে ঢুকিয়ে দিতাম। চক্ষু কোটরের ভিতর থেকে আমরা ষাড়ের মতো বড় বড় চর্বির টুকরাসমূহ কেটে বের করে আনতাম। জন্তুটি এতই বিশাল ছিল যে, যখন আবু উবাইদাহ (রাঃ) আমাদের তেরজনকে এটির চক্ষু কোটরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বললেন, তখন এ তেরজনের সবার জন্য এটার চোখের ভিতরে যথেষ্ট জায়গা হলো। তিনি এর খাঁচার একটি হাড় নিয়ে মাটিতে খাড়া করেছিলেন। তারপর তিনি সবচেয়ে উচু একটি উট নিয়ে তার ওপরে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা একজনকে চড়ালেন এবং তারা এ খাচার হাড়ের নিচ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারল।

অবশেষে যখন আমরা সে স্থান ত্যাগ করলাম তখন আমরা এর মাংস থেকে ফেরৎ যাত্রার জন্য খোরাক নিয়ে নিলাম। আমরা যখন মদীনায় পৌছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে যা ঘটেছিল তা বললাম, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ রিযিক আল্লাহ তোমাদের জন্য সাগর থেকে বের করে এনেছেন। আমাদেরকে খাওয়ানোর মতো এটার কোন মাংস কি তোমাদের কাছে আছে?” আমরা এর কিছুটা মাংস আল্লাহর রাসূলের নিকট পাঠিয়ে দিলাম আর তিনি এর থেকে কিছুটা খেলেন।”

“আমাদের প্রভু তিনি যিনি প্রতিটি বস্তুকে এর আকৃতি দান করেছেন ও তারপর (একে) সঠিক পথ-প্রদর্শন করেছেন।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত- ৫০)

মাটিতে যখন বীজ বপন করা হয় তখন যতক্ষণ পর্যন্ত না খুব সামান্য ভূমিকম্পন হয় ততক্ষণ পর্যন্ত (বীজ থেকে) অংকুর উদ্‌গম হয় না। এ সামান্য ঝাঁকিকে রিক্টার স্কেল (ভূমিকম্প-মাপাক যন্ত্র) টের পায় বা নিরুপণ করতে পারে তখন বীজ ফেটে গিয়ে অংকুর উদ্‌গম হতে শুরু করে।

فَإِذَا أَنزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنبَتَتْ مِن كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ

“(অতঃপর যখন) আমি জমিনের উপরে বৃষ্টি বর্ষণ করি (তখন) তা আলোড়িত হয়, স্ফীত হয় ও সর্ব প্রকার চোখ জুড়ানো উদ্ভিদ উপন্ন করে।” (২২-সূরা হাজ্জঃ আয়াত-৫)

رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَىٰ كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَىٰ

“আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে এর আকৃতি দান করেছেন ও পরে (একে) সঠিক পথ-পদর্শন করেছেন।” (২০-সুরা ত্বাহাঃ আয়াত-৫০)

বিশ্বতন্ত্র গবেষক ড. জগলুল আননাজ্জার তার একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, বহুযুগ আগে একটি ধূমকেতু আলোর গতিতে যাত্রা শুরু করেছে কিন্তু এখনও এটা পৃথিবীতে এসে পৌছতে পারেনি।

“অতএব, আমি নক্ষত্ররাজির অস্তাচলের শপথ করছি।” (৫৬-সূরা আল ওয়াকেয়াহঃ আয়াত-৭৫)

“আমাদের প্রভু তিনি যিনি প্রতিটি বস্তুকে এর আকৃতি দান করেছেন অতঃপর (প্রত্যেককেই) সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত- ৫০)

১৯৫৩ সালে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি (Recent Happenings), নামক পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিস্ময়কর ঘটনা হলো ‘ওনা’র কাহিনী। বহু পুলিশের পাহারায় প্যারিসে প্রবেশকারী ওনা ছিল ৮০,০০০ (আশি হাজার) কিলোগ্রামেরও বেশি ওজনের এক মোটা সোটা নরওয়ের তিমি (মাছ)। এ অতিকায় দৈত্যটিকে বহন করতে আটটি ট্রাক্টর লাগে। সবকটি ট্রাক্টরকে একটি ট্রান্সপোর্ট ট্ৰেইলারের সাথে বাধা হয়েছিল।

তিমিটিকে এক মাসব্যাপী প্রদর্শনীতে রাখবার কথা ছিল এবং পরিদর্শকদেরকে এটার বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে আলোকিত পেটের ভিতর প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে বলে কথা ছিল। (কিন্তু) ব্যবস্থাপকগণ ও পুলিশরা এটাকে প্রদর্শন করার স্থানের ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। কারণ, যে দালানে বা রাস্তায় এটাকে প্রদর্শন করা হবে তার জন্য এ জন্তুর আকার ও ওজন হুমকিস্বরূপ ছিল।

কচি বয়স [মাত্র আঠার (১৮) মাস] হওয়া সত্ত্বেও এটা বিশ মিটারের এক বিস্ময়কর দৈর্ঘ্যে পৌছে গিয়েছিল।

এটা গত বছর নরওয়ের পানির স্রোতে ধরা পড়েছিল এবং এটাকে পরিদর্শনের জন্য ট্রেনে করে এক শহর থেকে আরেক শহরে নেয়ার কথা ছিল। (কিন্তু) এটার আকার ও ওজনের সমস্যার কারণে বাধ্য হয়ে এটাকে ত্রিশ মিটার দৈর্ঘ্যের এক বিশেষ ট্রেইলারে করে পরিবহন করতে হয়েছিল।

“আমাদের প্রভু তিনি, যিনি প্রতিটি জিনিসকে এর আকার (গঠন ও অবয়ব) দান করেছেন তারপরে একে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-৫০)

মা’মার ইবনে রশীদ আল বসরী থেকে আব্দুর রাজ্জাক আস্‌সনানী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, “আমি ইয়েমেনে এত বড় আকারের আঙুরের থোকা দেখেছি, যা একটি গাধার পূর্ণ বোঝা ছিল।”

“আর সারি সারি গুচ্ছ যুক্ত (থোকা ওয়ালা) লম্বা লম্বা খেজুর গাছ।” (৫০-সূরা ক্বাফঃ আয়াত-১০)

সকল প্রকার বৃক্ষ ও উদ্ভিদ একই প্রকার পানি দ্বারা পুষ্ট হয়।

“অথচ আমি ফল হিসেবে তাদের কতককে কতকগুলোর উপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।” (১৩-সূরা রাআদঃ আয়াত-৪)

প্রতিটি উদ্ভিদই এর নিজস্ব বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্বারা সমৃদ্ধ। কিছুকে শক্ত করে (মজবুতভাবে) সৃষ্টি করা হয়েছে; কিছুর গায়ে কাটা আছে, যা দিয়ে এরা নিজেদেরকে রক্ষা করে এবং এগুলো ছাড়া অন্যান্য এমন কিছু আছে সেগুলো তিক্ত ও ঝাঁঝাল।

“আমাদের প্রতিপালক তিনি, যিনি সবকিছুকে এর অবকাঠামো দান করে একে সঠিক পথ দেখিয়েছেন।” (২০-সূরা তাহাঃ আয়াত-৫০)

নভোচারীরা বলেন যে, বেলুন যেভাবে প্রসারিত হয় এ মহাবিশ্ব সেভাবে অল্প অল্প করে প্রসারিত হচ্ছে।

وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ

“আমি ক্ষমতা দিয়ে আকাশকে বানিয়েছি এবং অবশ্যই আমি (তা দিয়ে মহাশূন্যের প্রশস্ততাকে) প্রসারিত করি।” (৫১-সূরা যারিয়াতঃ আয়াত-৪৭)

অন্যরা বলেন যে, ভূমি যখন সংকুচিত হচ্ছে তখন সাগর-মহাসাগর প্রসারিত হচ্ছে।

“তবে কি তারা দেখে না যে, আমি অবশ্যই ভূমিকে এর চতুর্দিক থেকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে (সংকুচিত করে) দিচ্ছি?” (২১-সূরা আম্বিয়াঃ আয়াত-৪৪)

১৯৮২ সালে “ফয়সাল ম্যাগাজিন” বাইশ কেজি ওজনের এক বাঁধা কপির কাহিনী বর্ণনা করেছিল যার ব্যাস ছিল ১ (এক) মিটার। একই খামারে তারা ২.৩ কেজি ওজনের একটি পিয়াজ পেয়েছিল যার ব্যাস ছিল ৩০ সেন্টিমিটার এবং ৬০ সেন্টিমিটার পরিধিবিশিষ্ট একটি টমেটোও পেয়েছিল।

এগুলোর ব্যতিক্রমধর্মী জিনিস যা মাত্র একজন মেক্সিকান কৃষকের খামারে পাওয়া গিয়েছিল।

“আমাদের প্রভু তিনি যিনি প্রতিটি বস্তুকে এর গঠন দান করে পরে একে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-৫০)

মাথায় আছে চার রকম তরল পদার্থঃ (তা থেকে) মুখে আছে তৃপ্তিদায়ক স্বাদ, যা খাদ্য ও পানীয়ের সাথে মিশে, নাকে আছে আঠালো স্রাব যা ধূলা-বালিকে ভিতরে প্রবেশে বাধা দেয়; চোখে আছে লোনা (স্বাদযুক্ত) (বা লবণাক্ত) পানি, যা শুষ্কতা প্রতিরোধ করে; এবং কানে আছে অমরস, যা প্রাণীকে পোকা-মাকড় থেকে এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

“এবং তোমাদের নিজেদের মাঝে (আমার নিদর্শনাবলি রয়েছে); তবে কি তোমরা তা দেখতে পাও না?” (৫১-সূরা আয যারিয়াতঃ আয়াত-২১)

“এবং যা তুমি জানতে না তিনি (আল্লাহ) তোমাকে তা শিখিয়েছেন।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত-১১৩)

“তিনি (আল্লাহ) মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।” (৯৬-সূরা আল আলাকঃ আয়াত-৫)

“এবং আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃজঠর থেকে বের করেছেন এমন অবস্থায় যে তোমরা কোন কিছুই জানতে না। এবং তিনি তোমাদেরকে শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও হৃদয় সৃষ্টি করে দিয়েছেন।” (১৬-সূরা আন নাহলঃ আয়াত-৭৮)

“আর আমি তাকে (যুদ্ধের) বর্মের ধাতব কোট নির্মাণ কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম।” (২১-সূরা আল আম্বিয়াঃ আয়াত-৮০)

“বরং তারা তা অস্বীকার করে যার জ্ঞান তারা অর্জন করেনি এবং এখনও যার ব্যাখ্যা তাদের নিকট এসে পৌছেনি।” (১০–সুরা ইউসুফঃ আয়াত-৩৯)

“এবং আমি তাদেরকে এমন কোন নিদর্শন দেখাইনি, যা এর অনুরূপ নিদর্শন থেকে শ্রেষ্ঠ নয়।” (৪৩-সূরা আয যুখরুফঃ আয়াত-৪৮)

“আমাদের প্রভু তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে এর গঠন দান করে একে পথ-নির্দেশ দিয়েছেন।" (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-৫০)

আত্মা এর প্রভুকে অমান্য না করলে এটা পরিত্যক্ত ও নিঃসঙ্গ বোধ করে না। হাসান বসরী (রহঃ) বলেছেন, “হে আদম সন্তান! মূসা (আঃ) যখন তিনবার খিযির (আঃ)-এর (কাজের) বিরোধিতা করেছিল বা (তার কাজের বিরুদ্ধে) আপত্তি করেছিল তখন খিযির (আঃ) বলেছিলেন, “এখনই তোমার ও আমার মাঝে বিদায়ের সময়।” তাহলে আপনার অবস্থা কেমন হবে- যে নাকি একদিনে বহুবার আপনার প্রভুর নাফরমানী করেন? আপনি কি এতটা নিশ্চয়তা বোধ করেন যে, তিনি একথা বলবেন না যে, “এটাই তোমার ও আমার মাঝে বিদায়ের কারণ (ঘটনা)”।