আখলাকের একটি সীমারেখা আছে যা অতিক্রম করলে তখন তা শত্রুতে পরিণত হয়, আবার যখন সে সীমায় কমতি করলে তা ত্রুটিপূর্ণ ও লাঞ্ছনাকর হয়।

ক্রোধের একটি সীমা রয়েছে। এটি হলো, প্রশংসিত বীরত্বতা ও নীচুতা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে আত্মসম্মানবোধ। এটি রাগের পূর্ণ গুণ। কিন্তু যখন এটি তার সীমা অতিক্রম করে তখন ব্যক্তি সীমালঙ্ঘনকারী ও অত্যাচারী হয়ে যায়। আবার এ সীমার চেয়ে কম হলে তখন তা ভীরুতা হয়, এটিকে তখন খারাপ জিনিস থেকে আত্মসম্মানবোধ বলা যায় না।

আগ্রহেরও একটি সীমা রয়েছে। আগ্রহের সীমা হলো, দুনিয়াবী বিষয়ে উপযোগিতা এবং দুনিয়ার পরিমিত অংশ প্রাপ্যের প্রচেষ্টা করা। কিন্তু যখন এ সীমায় ঘাটতি দেখা দেয় তখন তা অপমানকর ও অপচয় বলা হয়। আবার যখন এর সীমার চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা দিবে তখন তা অকল্যাণকর ও অপ্রশংসনীয় কাজে আগ্রহ প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

ঈর্ষারও একটি পরিধি রয়েছে। তা হলো পূর্ণতা অর্জনে প্রতিযোগিতা করা এবং সমজাতীয় লোকদের মাঝে নিজে এগিয়ে থাকা আত্মসম্মানবোধ। কিন্তু এ সীমা অতিক্রান্ত করে ঈর্ষাকৃত ব্যক্তির থেকে নি‘আমত চলে যাওয়া এবং তার কষ্ট হওয়ার আশা করলে তখন তা সীমালঙ্ঘন ও যুলুম হবে। আবার এ সীমার চেয়ে কম হবে তখন তা নীচুতা, দূর্বল হিম্মত ও ছোট মানসিকতা হিসেবে গণ্য হবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لاَ حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ الحِكْمَةَ فَهُوَ يَقْضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا».

“দু’ধরনের লোক ছাড়া অন্য কারো প্রতি ঈর্ষা করা যায় না। একজন হলো এমন ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তাকে তা সৎপথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। অপরজন হলো, যাকে আল্লাহ হিকমাত দান করেছেন, সে তার দ্বারা বিচার ফায়সালা করে এবং তা অপরকে শিক্ষা দেয়।”[1] এ ধরণের ঈর্ষা প্রতিযোগিতামূলক, এতে ঈর্ষাকারী ঈর্ষাকৃত ব্যক্তির অনুরূপ হতে চায়, কাউকে অপমানিত করার ইচ্ছা পোষণ নয় যাতে ঈর্ষাকৃত ব্যক্তির থেকে নি‘আমত দূরীভূত হয়ে যাওয়ার আশা পোষণ করা হয়ে থাকে।

প্রবৃত্তিরও রয়েছে একটি সীমারেখা। তা হলো আনুগত্য ও ফযীলতপূর্ণ কাজ করতে করতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হলে তা থেকে অন্তর ও বিবেককে বিশ্রাম ও আরাম দেওয়া এবং এ আরামের মাধ্যমে আরো ভালো কাজের প্রস্তুতি নেওয়া। অতএব, এ সীমা অতিক্রম করলে তখন তা অতিভোজন এবং অধিক সমকামী ও বিবাহ অন্বেষী হয়ে যাবে, যা ব্যক্তিকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যাবে। আবার উক্ত সীমার চেয়ে কম হলে এবং পূর্ণতা ও মর্যাদা অন্বেষী না হলে তা দুর্বলতা, অক্ষমতা ও অপমানজনক হবে।

আরাম-আয়েশ ও বিশ্রামেরও একটি সীমা রয়েছে। আর তা হলো, আনুগত্য ও মর্যাদা লাভের জন্য অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করা, ইন্দ্রিয় ও কার্যকারী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শক্তিশালী করা এবং এর জন্য সবকিছু যথাযথ ব্যবস্থা করা যাতে এগুলো পরিশ্রম ও কষ্টের ফলে দুর্বল হয়ে না পড়ে এবং দুর্বলতার ছাপ যাতে না থাকে। এ সীমা অতিক্রম করলে তা অবসন্নতা, অলসতা ও সময়ক্ষেপণতা হবে এবং এ কারণে বান্দার অনেক কল্যাণ ছুটে যাবে। আবার এর চেয়ে কমতি করলে তা জোরপূর্বক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাবে; এমনকি কখনও তা নি:শ্বেষ হয়েও যেতে পারে যেমন নার্সারীতে মাটি না থাকলে তা উপড়ে পরে এবং দাড়িয়ে থাকতে পারে না।

অপচয় ও কৃপণতার মাঝামাঝি দানশীলতার একটি সীমা রয়েছে। সুতরাং যখন এর সীমা পেরিয়ে যাবে তখন তা অপচয় ও অপব্যয় হবে আবার যখন সে সীমার চেয়ে কম করবে তখন তা বখিলতা ও কৃপণতা হয়ে যাবে।

বীরত্বের রয়েছে একটি সীমারেখা। যখন তা অতিক্রম করবে তখন তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, আবার যখন তা পরিমাণের চেয়ে কম হবে তখন তা ভীরুতা ও কাপুরুষতা বলে গণ্য হবে। বীরত্বের সীমা হচ্ছে যেখানে অগ্রগামী হতে হবে সেখানে অগ্রগামী হওয়া আর যেখানে বিরত থাকতে হয় সেখানে বিরত থাকা। যেমন মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ‘আমর ইবর ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেছিলেন, “আপনি কী বীর বা ভীরু তা আমাকে দেখান। আপনি যুদ্ধে এমনভাবে সামনে অগ্রসর হবেন যাতে আমি বলতে পারি যে, আপনি সবচেয়ে সাহসী মানুষ, আবার যদ্ধ থেকে এমনভাবে ভীরুতা দেখাবেন যে যাতে আমি বলতে পারি যে, আপনি সবচেয়ে ভিতু মানুষ। তখন ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, যখন কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে আমি সক্ষম তখন আমি বীর, কিন্তু যদি কোনো সুযোগ আমি গ্রহণ করতে না পারি তখন আমি ভীরু হয়ে যাই।

আত্মসম্মানবোধের একটি পরিধি আছে, কিন্তু তা যখন সীমা অতিক্রম করে তখন তা অপবাদ ও খারাপ ধারণায় পরিণত হয়, আবার যখন তা পরিমাণের চেয়ে কম হয় তখন তা গাফেলাতি ও অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়।

বিনয়ের রয়েছে একটি সীমারেখা, যখন এ সীমা অতিক্রম করে তখন তা অপমান ও অপদস্ত বলে গণ্য হয়, আবার সে সীমার চেয়ে কম হলে তা দম্ভ ও অহংকারে পরিণত হয়।

সম্মানেরও একটি সীমা রয়েছে। সে সীমা অতিক্রম করলে তা অহংকার ও অসচ্চরিত্র হিসেবে গণ্য হয়, আবার সে সীমার চেয়ে কম করলে তা অপমান ও হীনতায় পরিণত হয়।

এ সব কিছুর মূলনীতি হলো ন্যায়পরায়নতা ও ন্যায়বিচার। তা হলো বাড়াবাড়ি ও কমতির মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। এর ওপর ভিত্তি করেই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ সাধিত হয়; এমনকি শারীরিক কল্যাণও মধ্যম পন্থা অবলম্বন ব্যতীত অর্জিত হয় না। কেননা শরীরের কিছু অংশ যখন মধ্যম পন্থা তথা যথাযথভাবে না পেয়ে কম বা বেশি হয় তখন তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায় এবং শক্তিও কমে যায়। এমনিভাবেই প্রাকৃতিক কার্যসমূহ কাজ করে থাকে। যেমন ঘুমানো, জেগে থাকা, খাওয়া-দাওয়া, পান করা, যৌন কাজ, চলাফেরা, খেলাধুলা, নির্জনে থাকা ও মানুষের সাথে একত্রে থাকা ইত্যাদি যখন অতিরঞ্জিত এবং অতিকম করা এ দুয়ের মাঝামাঝি হয় তখন তা নায্যভাবে হয়ে থাকে; কিন্তু একটি কমতি করলে তখন অপরটিও কমতি হয় এবং এতে ফলাফলেও কমতি দেখা যায়।

>
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭১৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮১৬।