ইতোপূর্বে আমরা সর্বোচ্চ, সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর কতক ফযীলত জেনেছি। আরও জেনেছি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর বদৌলতে দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক ফযীলত, উপকার ও কল্যাণ হাসিল হয়, তবে মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকের জানা উচিৎ যে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুখে উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তার হক ও ফরযসমূহ আদায় করা এবং তার শর্তসমূহ পূর্ণ করা জরুরি, যা কুরআন ও সুন্নাহয় রয়েছে। একটি বিষয় প্রত্যেক মুসলিম জানে যে, যেসব ইবাদত দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করি সেসব ইবাদাতের নিজস্ব কিছু শর্ত রয়েছে, যা ব্যতীত সংশ্লিষ্ট ইবাদাত গ্রহণ করা হয় না। যেমন, সালাত অযু ব্যতীত গ্রহণ করা হয় না, অনুরূপ হজ তার শর্ত ব্যতীত গ্রহণ করা হয় না, অনুরূপ সকল ইবাদাত নির্ধারিত শর্ত ব্যতীত গ্রহণ করা হয় না, যেসব শর্ত কুরআন ও সন্নাহয় বিধৃত হয়েছে। অনুরূপ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণ করা হয় না, যতক্ষণ না বান্দা তার শর্তসমূহ পূরণ করবে, যার বর্ণনা কুরআন ও হাদীসে এসেছে।

আমাদের আদর্শ পূর্বসূরিগণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর শর্তের ওপর জোর তাগিদ করেছেন। কারণ, শর্ত বাস্তবায়ন করা ব্যতীত লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন, হাসান বসরী রহ. থেকে বর্ণিত, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো: “কতক লোক বলে: যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে সে জান্নাতে যাবে। তিনি বললেন: যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার হক ও ফরযসমূহ আদায় করবে সে জান্নাতে যাবে”।

প্রসিদ্ধ আরবি কবি ফারাযদাক স্বীয় স্ত্রীকে দাফন করছিলেন, তখন হাসান বসরী তাকে বলেন, এ দিনের জন্য কী প্রস্তুত করেছ? সে বলল: সত্তর বছর যাবৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষীকে প্রস্তুত করছি। হাসান বসরী বললেন: তোমার প্রস্তুতি খুব সুন্দর; কিন্তু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর কতিপয় শর্ত রয়েছে। খবরদার সতী-সাধ্বী নারীকে কখনো অপবাদ দিবে না”।

ওহাব ইবন মুনাব্বিহ জনৈক ব্যক্তিকে বলেন, যে তাকে প্রশ্ন করে ছিল: “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ কি জান্নাতের চাবি নয়? তিনি বললেন: অবশ্যই, তবে প্রত্যেক চাবির দাঁত রয়েছে, তুমি যদি দাঁত বিশিষ্ট চাবি নিয়ে আস তোমার জন্য খোলা হবে, অন্যথায় খোলা হবে না। তিনি দাঁত বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর শর্তের দিকে ইশারা করেছেন”।[1]

কুরআন ও সুন্নাহ অনুসন্ধান শেষে আহলে ইলমদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, সাতটি শর্ত ব্যতীত লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণযোগ্য নয়, সেগুলো হচ্ছে:

১. কালেমার অর্থ জানা, অর্থাৎ কালেমার ভেতর কী অস্বীকার ও কী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা জানা জরুরি, যা তার অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতার বিপরীত।

২. কালেমার ভেতর যা সাব্যস্ত করা হয়েছে তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা জরুরি, যা কালেমা সম্পর্কে সংশয় ও সন্দেহ পোষণ করার বিপরীত।

৩. কালেমার প্রতি পূর্ণ ইখলাস প্রদর্শন করা জরুরি, যা তার অর্থ ও দাবি বাস্তবায়ন করার সময় শির্ক ও রিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিপরীত।

৪. কালেমাকে মনে-প্রাণে সত্য জানা জরুরি, যা তার প্রতি মিথ্যারোপ করার বিপরীত।

৫. কালেমায় সাব্যস্ত সত্তাকে (আল্লাহকে) মহব্বত করা জরুরি, যা তার প্রতি কোনো প্রকার বিদ্বেষ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করার বিপরীত।

৬. কালেমার অর্থ ও দাবির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা জরুরি, যা তার অর্থ ও দাবিকে ত্যাগ করার বিপরীত।

৭. কালেমার অর্থ ও দাবি মনে-প্রাণে গ্রহণ করা জরুরি, যা তার অর্থ ও দাবির বাস্তবায়নকে প্রতিরোধ করার বিপরীত।

সাতটি শর্তকে জনৈক আহলে-ইলম এক কবিতায় একত্র করেছেন, যেমন:

علم يقين وإخلاص وصدقك مع محبة وانقياد والقبول لها

১. ‘ইলম’ অর্থাৎ অর্থ ও দাবি জানা, ২. ‘ইয়াকিন’ অর্থাৎ অর্থ ও দাবিকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা, ৩. ‘ইখলাস’ অর্থাৎ অর্থ ও দাবিকে বাস্তবায়ন করার সময় রিয়া ও শির্কে লিপ্ত না হওয়া। ৪. ‘সিদক’ অর্থাৎ কালেমার অর্থ ও দাবির প্রতি সত্যারোপ করা। ৫. ‘মহব্বত’ অর্থাৎ কালেমায় সাব্যস্ত সত্তাকে মহব্বত করা, ৬. ‘ইনকিয়াদ’ অর্থাৎ কালেমায় সাব্যস্ত সত্তার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করা, ও ৭. ‘কবুল’ অর্থাৎ কালেমার অর্থ ও দাবিকে সানন্দে গ্রহণ করা।

নিম্নে আমরা কুরআন ও সুন্নার আলোকে এসব শর্তের অর্থ ও দাবি সংক্ষেপে আলোচনা করছি, যেন প্রত্যেক শর্ত সবার নিকট পরিষ্কারভাবে স্পষ্ট হয়।[2]

প্রথম শর্ত: এ কালেমায় কী অস্বীকার আর কী সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্থ জানা জরুরি, যা কালেমা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার বিপরীত। অর্থাৎ যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, সে সকল প্রকার ইবাদাত আল্লাহকে উৎসর্গ করবে, তিনি ব্যতীত অন্যান্য মা‘বুদকে অস্বীকার করবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥﴾ [الفاتحة: ٥]

“নিশ্চয় আমরা আপনারই ইবাদাত করি এবং আপনার নিকট সাহায্য চাই”। [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৫] অর্থাৎ আমরা আপনার ইবাদাত করি, আপনি ব্যতীত কারো ইবাদত করি না, আপনার নিকট সাহায্য চাই, আপনি ব্যতীত কারো নিকট সাহায্য চাই না।

অপর আয়াতে তিনি বলেন,

﴿فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ ١٩﴾ [محمد : ١٩]

“জেনে রাখ যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]

অপর আয়াতে বলেন,

﴿ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦ ﴾ [الزخرف: ٨٦]

“তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]

এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ বলেছেন: যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ জেনে সাক্ষী দিবে তারাই এখানে উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মুখ ও অন্তরের সমন্বয় যে সাক্ষী তারা প্রদান করেছে তার অর্থ তারা জানে। উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، دَخَلَ الْجَنَّةَ»

“যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ জানা অবস্থায় মারা গেল সে জান্নাতে যাবে”।[3] এখানে তিনি ইলম তথা কালেমার অর্থ জানার শর্তারোপ করেছেন।

দ্বিতীয় শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবির প্রতি প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস লালন করা, তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ ও সংশয়কে আশ্রয় না দেওয়া। অর্থাৎ কালেমা উচ্চারণকারী তার অর্থ ও দাবিকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, যেন তাতে সন্দেহ ও সংশয় না থাকে, তবে এ জাতীয় দৃঢ় বিশ্বাস বা ইয়াকীন হাসিল করার জন্য পূর্ণ জ্ঞান থাকা জরুরি। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের গুণাবলির আলোচনায় বলেন,

﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ١٥﴾ [الحجرات: ١٥]

“মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করে নি। আর নিজেদের সম্পদ ও নিজদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৫]

আল্লাহর বাণী: ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ অর্থ তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছে, সন্দেহ পোষণ করে নি।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ، لَا يَلْقَى اللَّهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا، إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ»

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি তার রাসূল। যে কোনো বান্দা এ দু’টি বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে সে জান্নাতে যাবে”।[4]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম মুসলিম আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ لَقِيتَ مِنْ وَرَاءِ هذا الْحَائِطِ يَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ، فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ»

“এ দেয়ালের পশ্চাতে তুমি যাকে পাবে, সে যদি নিজের অন্তর থেকে দৃঢ় বিশ্বাসসহ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য প্রদান করে, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান কর”।[5]

এ হাদীসে তিনি কালেমার জন্য ইয়াকীন বা দৃঢ় বিশ্বাস শর্তারোপ করেছেন।

তৃতীয় শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবি পূর্ণ ইখলাসসহ গ্রহণ করা, যেন তাতে শির্ক ও রিয়ার অংশ না থাকে। অর্থাৎ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার শির্ক থেকে আমলকে মুক্ত রাখা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ ٣﴾ [الزمر: ٣]

“জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই একনিষ্ঠ ইবাদাত”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]

অপর আয়াতে তিনি বলেন,

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ ٥﴾ [البينة: ٥]

“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তারই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ»

“আমার সুপারিশ দ্বারা ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে, যে ইখলাসের সাথে অন্তর থেকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে”।[6] এ হাদীসে তিনি কালেমার জন্য ইখলাস শর্ত করেছেন।

চতুর্থ শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবিকে সত্য জানা, মিথ্যারোপ না করা অর্থাৎ সততার সাথে বান্দার অন্তর থেকে এ কালেমা উচ্চারণ করা। সততার অর্থ, মুখের সাথে অন্তরের মিল থাকা। এ সততা না থাকায় অর্থাৎ অন্তরের সাথে মুখের মিল না থাকায় মুনাফিকদের দুর্নাম করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِذَا جَآءَكَ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ قَالُواْ نَشۡهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُۥ وَٱللَّهُ يَشۡهَدُ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَكَٰذِبُونَ ١﴾ [المنافقون: ١]

“যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী”। [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ১]

অত্র আয়াতে আল্লাহ তাদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছেন, কারণ তারা মুখে যা বলেছে তাদের অন্তরে সেটি ছিল না।

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتۡرَكُوٓاْ أَن يَقُولُوٓاْ ءَامَنَّا وَهُمۡ لَا يُفۡتَنُونَ ٢ وَلَقَدۡ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۖ فَلَيَعۡلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ وَلَيَعۡلَمَنَّ ٱلۡكَٰذِبِينَ ٣﴾ [العنكبوت: ٢، ٣]

“মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না। আর আমরা তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী”? [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ২-৩]

ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنَّ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ صَادِقًا مِنْ قَلْبِهِ، إِلا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ»

“এমন কেউ যে অন্তরের সততা থেকে সাক্ষ্য দিবে আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তার বান্দা ও রাসূল, অবশ্যই আল্লাহ তার ওপর জাহান্নাম হারাম করে দিবেন”।[7] এ হাদীসে তিনি কালেমার ভেতর সততার শর্তারোপ করেছেন।

পঞ্চম শর্ত: এ কালেমায় সাব্যস্ত সত্তাকে মহব্বত করা, যেন তার প্রতি বিদ্বেষ ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি না হয়, যেমন কালেমা উচ্চারণকারী আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, দীন ইসলাম ও মুসলিমদের মহব্বত করবে, যেসব মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করে ও তাতে সীমালঙ্ঘন করে না। পক্ষান্তরে যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর বিরোধিতা করে এবং তার বিপরীত বস্তুতে লিপ্ত হয়, যেমন শির্ক ও কুফর, তাদেরকে অপছন্দ করে। অতএব, কালেমার ঈমানের জন্য মহব্বত জরুরি। দলীল, আল্লাহর বাণী:

﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ ١٦٥﴾ [البقرة: ١٦٥]

“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৫]

হাদীসে এসেছে:

«أَوْثَقُ عُرَى الإِيمَانِ، الْحَبُّ فِي اللَّهِ، وَالْبُغْضُ فِي اللَّهِ»

“ঈমানের সবচেয়ে মজবুত রশি আল্লাহর জন্য মহব্বত করা ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ পোষণ করা”।[8]

ষষ্ঠ শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবি মনে-প্রাণে গ্রহণ করা, যা প্রত্যাখ্যান করার বিপরীত। সত্যিকারভাবে কালেমার অর্থ ও দাবিকে গ্রহণ করা জরুরি। যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের মুক্তি দিবেন। পক্ষান্তরে, যারা কালেমা গ্রহণ করবে না, বরং প্রত্যাখ্যান করবে তাদের থেকে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ ও তাদেরকে ধ্বংস করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ثُمَّ نُنَجِّي رُسُلَنَا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ كَذَٰلِكَ حَقًّا عَلَيۡنَا نُنجِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١٠٣﴾ [يونس : ١٠٣]

“অতঃপর, আমি নাজাত দেই আমার রাসূলদেরকে এবং তাদেরকেও যারা ঈমান এনেছে। এটা আমার দায়িত্ব যে, মুমিনদের নাজাত দেই”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৩]

অপর আয়াতে তিনি মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন,

﴿إِنَّهُمۡ كَانُوٓاْ إِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ يَسۡتَكۡبِرُونَ ٣٥ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦﴾ [الصافات : ٣٥، ٣٦]

“তাদেরকে যখন বলা হত, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই’ তখন নিশ্চয় তারা অহংকার করত। আর তারা বলত, আমরা কি এক পাগল কবির জন্য আমাদের উপাস্যদের ছেড়ে দেব”। [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৩৫-৩৬]

সপ্তম শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবির সামনে বশ্যতা স্বীকার করা, যা কালেমা ত্যাগ করার বিপরীত। কারণ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করার অর্থ আল্লাহর শরী‘আতের সামনে পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা, তার বিধানকে মেনে নেওয়া এবং স্বীয় চেহারাকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করা জরুরি, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থকে আঁকড়ে ধরার অর্থ এটাই। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَمَن يُسۡلِمۡ وَجۡهَهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰۗ ٢٢﴾ [لقمان: ٢٢]

“আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে নিজকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরল”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২] অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহকে আঁকড়ে ধরা। এখানে আল্লাহ তা‘আলা কালেমার সাথে শরী‘আতের প্রতি আনুগত্য প্রদানকে শর্ত করেছেন, অর্থাৎ আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ করা। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর জন্য এসব শর্ত জরুরি। কালেমার উদ্দেশ্য কখনো শব্দ গণনা ও বাক্য মুখস্থ করা নয়। এমন অনেক সাধারণ লোক আছে, যার ভেতর কালেমার সবক’টি শর্ত বিদ্যমান এবং সে তা আঁকড়ে ধরেছে, যদি তাকে বলা হয়: গণনা কর সে ভালো করে তা গণনা করতে পারবে না, পক্ষান্তরে কালেমার শব্দ মুখস্থকারী অনেক আছে, যে তীরের মত কালেমা উচ্চারণ করতে সক্ষম, তবে তাদের অনেকে কালেমা পরিপন্থী বস্তুতে লিপ্ত। অতএব কালেমার জন্য ইলম ও আমল উভয় জরুরি, তবেই ব্যক্তি সত্যিকারভাবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা তাওহীদের কালেমার পরিবারভুক্ত হবে, যার তাওফীক দাতা ও সাহায্যকারী সত্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। আমরা তার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে তার তাওফিক দান করেন, সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁর জন্যই নিবেদিত।

[1] এসব বাণী (আসার) ইবন রজব ‘কালিমাতুল ইখলাস’ (পৃ. ১৪) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

[2] এসব শর্তসমূহ আরো বিস্তারিত দেখুন (মা‘আরিজিল কবুল) গ্রন্থে: (১/৩৭৭)

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৬

[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭

[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩১

[6] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৯

[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২

[8] আহমদ ফিল মুসনাদ: (৪/২৮৬); সিলসিলাহ সহীহাহ: (১৭২৮)