উসূলে ফিক্বহ (ফিক্বহের মূলনীতি) আমর বা নির্দেশ (الأمر) শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি

আমরের শব্দরূপ চারটি। যেমন:

১.فعل الأمر বা নির্দেশ জ্ঞাপক ক্রিয়া। যেমন: আল্লাহর বাণী:

اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ

অর্থাৎ তুমি তিলাওয়াত করো কিতাব হতে যা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে (সূরা আল-আনকাবূত ২৯:৪৫)।

(ক্রিয়ার অর্থ জ্ঞাপক ইসম বা বিশেষ্য)।

২. اسم فعل الأمر যেমন: حي على الصلاة (ছ্বালাতের জন্য আসো।)

৩. المصدر النائب عن فعل الأمر (নির্দেশ জ্ঞাপক ক্রিয়া পদের স্থলাভিষিক্ত মাছদার বা ক্রিয়ামূল)। যেমন:

فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَاب

যখন তোমরা কাফিরদের সাথে যুদ্ধে মোকাবিলা করো তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত করো (সূরা মুহাম্মাদ:৪৭:৪)।

৪. المضارع المقرون بلام الأمر (নির্দেশ জ্ঞাপক লাম যুক্ত ফেলে মুদ্বারে-ভবিষ্যৎকালীন ক্রিয়া)। যেমন: لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ

যেন তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আনো (সূরা আল-মুজাদালাহ ৫৮:৪)।

কোন কোন সময় আমরের ছীগাহ ছাড়াও طلب الفعل বা ক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি পাওয়া যায়। যেমন: কোন কাজকে এরূপ বিশেষিত করা যে, এটা ফরয অথবা ওয়াজীব অথবা মানদূব অথবা তা আনুগত্য মূলক কাজ অথবা কোন কাজের কর্তাকে প্রশংসা করা অথবা কাজ বর্জনকারীকে নিন্দা করা অথবা কোন কাজের ছাওয়াব ধার্য হওয়া অথবা কোন কাজ পরিত্যাগকরীর শাস্তি ধার্য হওয়া।[1]

ما تقتضيه صيغة الأمر নির্দেশ জ্ঞাপক ছীগাহ-শব্দের চাহিদা: সাধারণত নির্দেশ জ্ঞাপক ছীগাহ আদিষ্ট বিষয় ওয়াজিব হওয়া এবং তা তৎক্ষণাৎ পালিত হওয়ার চাহিদা প্রকাশ করে। আমর এর ছীগাহ ওয়াজিব হওয়ার দলীল: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

যারা তার আদেশের বিরূদ্ধাচারণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে (সূরা আন-নূর ২৪ : ৬৩)।

অত্র আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণের কারণ হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের বিরূদ্ধাচারণকারীদের সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, তারা ফিতনায় নিপতিত হবে। আর ফিতনা হলো সত্যপথ হতে বিচ্যুত হওয়া। অথবা তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। কেবল ওয়াজিব বর্জনের কারণে এরূপ হুশিয়ারী দেয়া হয়। তাই প্রমাণিত হয় যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ পালন ওয়াজিবের চাহিদা প্রকাশ করে।

أمر নির্দেশ জ্ঞাপক ক্রিয়া তৎক্ষণাৎ পালনের চাহিদা প্রকাশ করে এ প্রসঙ্গে দলীল হলো, আল্লাহর বাণী:

فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ

তোমরা সৎকাজে প্রতিযোগিতা মূলক এগিয়ে যাও (সূরা আল-বাক্বারা ২:১৪৮)।

শারঈ নির্দেশিত সকল বিষয় কল্যাণকর। তাই কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ তাৎক্ষণিকভাবে পালন করা ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। এ ব্যাপারে আরো দলীল হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার দিন কুরবানীর পশু যবেহ করা ও মাথা মুন্ডন করার জন্য ছাহাবীদেরকে নির্দেশ দেন। কিন্তু তা পালনে ছাহাবীদের বিলম্ব করাকে তিনি অছন্দ করেন। এ কারণে যে কষ্ট তিনি পেয়েছিলেন তা উম্মে সালমার নিকট ব্যক্ত করেন। তাই বুঝা যায়, তাৎক্ষণিক আদেশ পালন অধিক সতর্কতা ও দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য অধিকতর সহায়ক। তা ছাড়া বিলম্বে নির্দেশ পালনে অনেক সমস্যা রয়েছে। (উদাহরণ স্বরূপ তাৎক্ষণিক নিদের্শ পালন না করায়) অনেক ওয়াজিব বিষয় একত্রিত হয়, ফলে একপর্যায়ে তা পালনে ব্যক্তি অÿমতা প্রকাশ করে। আমর কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন দলীলের দাবির প্রেক্ষিতে ওয়াজিব ও তৎক্ষণাৎ পালনের চাহিদা থেকে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে অন্যতম হলো:

الندب أمر (পালন করা বাঞ্ছনীয়) এমন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আল্লাহর বাণী:

وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ

তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সাক্ষী রাখো (সূরা আল-বাক্বারা ২:২৮২)।

পাস্পারিক ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সাক্ষী রাখার নির্দেশটি মানদূবের জন্য প্রযোজ্য। (ওয়াজিবের জন্য নয়)। দলীল হলো:

أن النبي صلّى الله عليه وسلّم اشترى فرساً من أعرابي ولم يشهد

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বেদূইন ব্যক্তির নিকট থেকে একটি ঘোড়া ক্রয় করেন। কিন্তু কোন সাক্ষী রাখেননি।[2]

২. الإطاحة বৈধতা অর্থে ব্যবহৃত হওয়া। কোন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার পর أمر ব্যবহৃত হলে অধিকাংশ সময় তা পালন করা বৈধ অথবা কোন বিষয় নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি হলেأمر এ অর্থে ওয়াজিব হয়। নিষেধাজ্ঞার পর أمر ব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا

যখন তোমরা ইহরাম থেকে হালাল হবে তখন শিকার করো (সূরা আল-মায়িদা ৫:২)।

এখানে প্রাণী শিকার করার নির্দেশটি বৈধতা ঘোষণা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, এ নির্দেশ আল্লাহর বাণীতে প্রাপ্ত নিষেধাজ্ঞার পর এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ

ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হালাল মনে করো না (সূরা আল-মায়িদা ৫:১)।

নিষিদ্ধ হওয়ার সংশয়ের পর أمرব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ হলো, বিদায় হজের সময় ইদের দিন পালনীয় কিছু কর্ম আগে-পরে পালন করা সম্পর্কে যারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রশ্ন করেছিল তাদের জবাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

افعل ولا حرج

পালন করো কোন সমস্যা নেই।[3]

৩. التهديد ধমক অর্থে। যেমন আল্লাহর বাণীঃ

اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

তোমরা যা ইচ্ছা করো, নিশ্চয় তিনি দেখেন তোমরা যা করো (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১:৪০)।

তিনি আরো বলেন,

إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَار

আমি জালিমদের জন্য অগ্নি প্রস্ত্তত রেখেছি (সূরা আল-কাহাফ ১৮:২৯)।

উক্ত নির্দেশের পর শাস্তি প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, নির্দেশটি ধমক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ পালন করা অর্থ ব্যতীরেকে বিলম্বে পালন করা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ: রমাদ্বানের ক্বাযা ছিয়াম পালন করা আদিষ্ট বিষয়। কিন্ত দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে বুঝা যায়, তা তাৎক্ষণিক পালন করা আবশ্যক নয় বরং বিলম্বে পালনীয়। যেমন: আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان يكون عليّ الصوم من رمضان فما أستطيع أن أقضيه إلا في شعبان، وذلك لمكان رسول الله صلّى الله عليه وسلّم

আমার রমাদ্বান মাসের ছিয়াম অবশিষ্ট থেকে যেতো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমাতে ব্যস্ত থাকার কারণে শা‘বান মাস ছাড়া অন্য সময়ে আমি তা আদায় করার সুযোগ পেতাম না।[4]

যদি নির্দেশটি বিলম্বে পালন করা হারাম হতো, তাহলে আয়িশা (রা.) কে তা পালন করার উপর বহাল থাকতে দেয়া হতো না।

ما لا يتم المأمور إلا به

যা ছাড়া নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন হয় না।

নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি কোন জিনিসের উপর নির্ভর করলে তখন ঐ জিনিসটিও নির্দেশিত হিসাবে গণ্য হয়। তাই নির্দেশিত বিষয়টি ওয়াজীব হলে ঐ জিনিসটিও ওয়াজীব হয়ে যায়, কাজটি মানদূব (বাঞ্ছনীয়) হলে ঐ জিনিসও মানদূব (বাঞ্ছনীয়) হয়ে যায়।

ওয়াজীবের উদাহরণ: গোপ্তাঙ্গ ঢেকে রাখা ওয়াজীব। যেহেতু গোপ্তাঙ্গ ঢেকে রাখা কাপড় ক্রয় করার উপর নির্ভর করে তাই কাপড় ক্রয় করা ওয়াজীব হয়ে যায়।

মানদূবের উদাহরণ: জু‘আর দিন সুগন্ধি ব্যবহার করা মানদূব (বাঞ্ছনীয়)। যেহেতু সুগন্ধি দেয়া তা ক্রয় করার উপর নির্ভর করে তাই সুগন্ধি-প্রসাধনি ক্রয় করা মানদূব (বাঞ্ছনীয়) হিসাবে গণ্য। এ নিয়মটি একটি ব্যাপক মূলনীতির অন্তর্গত। আর তা হলো,

الوسائل لها أحكام المقاصد، فوسائل المأمورات مأمور بها، ووسائل المنهيات منهي عنها

কোন বিষয়ে উদ্দেশ্যে এর হুকুম ‘উপকরণের’ হুকুম হিসাবে গণ্য হবে। তাই আদিষ্ট বিষয়ের উপকরণ আদিষ্ট বলেই গণ্য এবং নিষিদ্ধ বিষয়ের উপকরণ নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

[1]. কোন বিষয়কে ফরয হিসাবে বিশেষিত করার উদাহরণ হলো: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

فأعلمهم أن الله قد فرض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة

তুমি তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত ছ্বলাত ফরয করেছেন।

ছহীহ বুখারী হা/১৩৩২, ছহীহ মুসলিম হা/১৯। ওয়াজীব এর উদাহরণ:

غسل الجمعة واجب على كل محتلم

জুমু‘আর দিন গোসল করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর ওয়াজীব। ছহীহ বুখারী হা/ ৮২০, ছহীহ মুসলিম হা/৮৪৬।

কোন কর্ম আনুগত্য হিসাবে বিশেষিত করার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

من أطاع أميري فقد أطاعني

যে কেউ আমার আমীরের আনুগত্য করলো, সে যেন আমারই আনুগত্য করলো। আবূ দাউদ হা/ ২৫৫৪।

কোন কর্মের কর্তাকে প্রশংসা করার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

نعم الرجل عبد الله لو كان يقوم من الليل

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ কতই না উত্তম লোক! যদি সে রাতে তাহাজ্জুদের ছ্বলাত আদায় করতো। বায়হাক্বী হা/১১২।

কোন কাজ বর্জন করার কারণে নিন্দা করার উদাহরণ হলো:

من ترك الرمي بعدما علمه رغبة عنه، فإنها نعمة كفرها

তীর নিক্ষেপ শিক্ষা করার পর যে অজ্ঞতা বশতঃ তা ছেড়ে দিলো, সে মূলত একটি নি‘আমতের সাথে কুফরী করলো। জামে ছহীহ লি-সুনান হা/৬১৪২ ।

কোন কর্মের উপর ছাওয়াব ধার্য হওয়ার উদাহরণ হলো:

من صلى علي صلاة صلى الله عليه بت عشرا

যে আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার উপর দশবার দয়া করেন।

ছহীহ মুসলিম হা/৩৮৪, আবূ দাউদ ৫২৩।

কোন কাজ বর্জন করার কারণে শাস্তি ধার্য হওয়ার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

من ترك ثلاث جمع تهاونا طبع الله على قلبه

যে কেউ অবহেলা করে পরপর তিন জুমু‘আ ছেড়ে দিবে আল্লাহ তার অন্তরে মহর মেরে দিবেন।

আবূ দাউদ হা/১০৫২, নাসাঈ হা/১৩৫৯।

সুতরাং দেখা যায়, আমরের চার ছীগাহ ও আনুষঙ্গিকসহ মোট ১২ ভাবে আমর হতে পারে।

[2].আবূ দাউদ হা/৩৬০৭, নাসাঈ হা/৬২৪৩।

[3]. বুখারী হা/৮৩, মুসলিম হা/১৩০৬।

[4]. ছহীহ বুখারী ১৯৫০, ছহীহ মুসলিম ১১৪৬।