জাহিল সম্প্রদায় তাদের ইবাদত ও দীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ নয় - ২

আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালাম-কে পৃথিবীতে পাঠানোর পর হতে মানুষের জন্য তিনি দীন নির্ধারণ করেছেন। তিনি মানুষকে নাবী ও দীনবিহীনভাবে পৃথিবীতে পাঠাননি বরং তিনি ধারাবাহিকভাবে রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। আর মানুষের জন্য তিনি দীনকে বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন এবং তা স্পষ্টভাবে তাদের জন্য বর্ণনা করেছেন। আর সর্বশেষ নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দীন ইসলাম দেয়া হয়েছে যা কিয়ামত অবধি চালু থাকবে, তা রহিত হবে না। আর এ দীনের মাপকাঠি হলো কুরআন ও সুন্নাহ। সবযুগেই রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দীন নিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلا فِيهَا نَذِيرٌ) [فاطر: 24]

আর এমন কোন জাতি নেই যার কাছে সতর্ককারী আসেনি (সূরা ফাতির ৩৫:২৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(رُسُلاً مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ) [النساء: 165]

আর (পাঠিয়েছি) রসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রসূলগণের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে (সূরা আন নিসা ৪:১৬৫)।

সুতরাং সকলেই দলীল নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

أَنْ تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ

যেন তোমরা না বল যে, আমাদের নিকট কোন সুসংবাদদাতা কিংবা সতর্ককারী আসেনি। অবশ্যই তোমাদের নিকট সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছে। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান (সূরা আল মায়িদা ৫:১৯)।

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপর দলীল বহাল রাখেন। কিন্তু রসূলগণ যা নিয়ে আসেন জাহিলরা জেনে-বুঝে হঠকারিতা ও কু-প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণে রসূলগণের বিরোধিতা করে। বিশেষত ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা রিসালাত সম্পর্কে জানতো। এজন্য তাদের নামকরণ করা হয়েছে আহলুল ইলম বা আহলে কিতাব। তারা অপরাধী, কারণ তারা আহলে কিতাব এবং আহলুল ইলম অর্থাৎ রিসালাত সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের বিরোধিতা ও কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা উম্মতকে জাহিলদের রীতিনীতি ধারণ করতে নিষেধ করেছেন। বরং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অর্পিত দীন আঁকড়ে ধরতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছাহাবীগণ ও খুলাফায়ে রাশিদীন যার উপর পরিচালিত সেটাই হলো দীন, যা কিয়ামত অবধি আঁকড়ে ধরা উম্মতের উপর ওয়াজীব। যদি তাতে কোন মতভেদ দেখা দেয় তাহলে কিতাব ও সুন্নাহর দিকে তাদের প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজীব-আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ) [النساء:59]

অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)।

মতানৈক্য করা মানুষের স্বভাব। কিন্তু যখন মতানৈক্য দেখা দিবে আর আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারবো না তখন আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বলেছেন। যার কাছে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক দলীল পাওয়া যাবে তার নিকট থেকে তা গ্রহণ করতে হবে। আর কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী হলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো হকের অনুসরণ করা। রায় বা সিদ্ধান্ত সমর্থন করা অথবা বাপদাদা, পূর্বপুরুষ ও ব্যক্তি প্রধানদের রীতিকে সম্মান দেখানো মুসলিমদের উদ্দেশ্য নয়। এটা মুসলিমদের কাজ হতে পারে না। হক্ব গ্রহণ করাই মু’মিনের উদ্দেশ্য। হক্ব যেখানেই পাওয়া যাবে তা গ্রহণ করবে, কারণ হক্বই মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ) [النساء:59]

যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)। আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে যেতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً) [النساء:59]

এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)। অর্থাৎ এটা পরিনামে উৎকৃষ্টতর। দীন আল্লাহ তা‘আলার রহমত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মাঝে তার বিধান দিয়েছেন যা হক্ব বলে প্রমাণিত। আর তা হলো তার কিতাব-আল কুরআন। এজন্য তিনি বলেন,

(وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ) [آل عمران: 103]

আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

এখানে (بِحَبْلِ اللَّهِ) বলতে আল-কুরআন উদ্দেশ্য। আর (جَمِيعاً) এর অর্থ হলো সকলেই, কতিপয় নয়। ব্যাপক অর্থে সব সৃষ্টি তথা মানব ও জিন জাতি উভয় উদ্দেশ্য। বিশেষতঃ এ উম্মতকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَاناً وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا) [آل عمران: 103]

তোমরা বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তার অনুগ্রহে তোমরা হয়ে গেলে ভাই-ভাই। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

(شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّار) এখানে জাহিলী দীনকে বুঝানো হয়েছে।

(فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا) এ আয়াতাংশ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের মাধ্যমে আমাদের মুক্তির পথ উম্মুক্ত করেছেন। আর তা হচ্ছে আল-কুরআন। তাই তার নে‘আমতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং তার রজ্জু আল কুরআনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। কেননা কিতাব হলো আল্লাহর প্রসারিত রজ্জু। যে তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে সে মুক্তি পাবে। আর যে তা ছেড়ে দিবে সে ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাছে জাহিলদের অবস্থার কাহিনী বর্ণনা করে বলেন:

فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

জাহিলী কর্ম-কান্ড ও জাহিলদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা থেকে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তার কিতাব আঁকড়ে ধরতে নির্দেশ দেন, যা মতভেদ, ধ্বংস ও বিতর্ক থেকে নিরাপদ। আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত শক্তভাবে ধারণ করা ছাড়া কোন মুক্তি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعاً وَلا تَفَرَّقُوا) [آل عمران: 103]

আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

জাহিলরা তাদের দীনে মতভেদ সৃষ্টিকারী হিসাবে গণ্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ) [الروم: 32]

প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

তাদের মতভেদ বাতিল হওয়া সত্বেও তা নিয়ে তারা আনন্দিত হয়। এরূপভাবে তারা দুনিয়া নিয়েও মতপার্থক্য সৃষ্টি করে। কেননা দীন বিনষ্ট হওয়ায় দুনিয়াও নষ্ট হয়। দুনিয়া নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে তারা জামা‘আতবদ্ধ হতে পারে না। বরং প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ শাসন কর্তৃত্বের উপর বহাল থাকে। আর প্রত্যেক গোত্র অন্য গোত্রের লোকদের জীবন ও ধনসম্পদের উপর জবরদস্তি করে। এটা হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে আরবদের অবস্থা। তারা তাদের দীন ধ্বংসের মাধ্যমে দুনিয়া ধ্বংস করে। ভীতি, উৎকণ্ঠা ও দারিদ্রতা তাদের জন্য স্থায়ী হয়ে যায়। জাহিলদের প্রত্যেকেই যুদ্ধবাজ। তাদের প্রত্যেকেই অপরকে আক্রমণ ও অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। জাহিলী যুগে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ হতো। যেমন মদিনার আউস ও খাযরাজ গোত্র বংশগত দিক থেকে ভাই ভাই সম্পর্ক। তারা কাহতান নামক একই গোত্রীয় লোক ছিল। কিন্তু তাদের মাঝে এক ধ্বংসাত্নক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা একশত বছরের অধিক সময় ধরে চলতে থাকে। আউস ও খাযরাজ গোত্রের মাঝে সংঘটিত এ যুদ্ধের নাম দেয়া হয়েছে (حرب بعاث) হারবুন বুআ‘ছ।

ইয়াহুদীরা অগ্নিপূজা করতো। আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে জামা‘আতবদ্ধ করেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হলো, মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেল, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তারা একতাবদ্ধ হয়। তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার এ অনুগ্রহ তার রসূলের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَاناً) [آل عمران: 103]

আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রুছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তার অনুগ্রহে তোমরা হয়ে গেলে ভাই-ভাই (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাঝে আন্তরিকতা সৃষ্টি করে দেন। তাদের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেমে যায়। তারা ও আরবের অন্যান্য গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে দুনিয়া শান্তিময় হয়ে যায়। তারা জীবন ও ধনসম্পদের নিরাপত্তা লাভ করে, জমিনে নিরাপদে চলাফেরা করে। আরবের একগোত্র অন্যগোত্রের সাথে মিশে যায়, কেউ অনিষ্টের আশ্রয় নিতো না। তাদের মাঝে ভালবাসার বন্ধন সৃষ্টি হয় এবং তারা পরস্পর দীনি ভাই হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলে,

(إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ) [الأنعام: 159]

নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই (সূরা আল আন‘আম ৬:১৬৯)।

যারা তাদের দীনে বিভক্তি সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় তারা দীন বহির্ভূত। কেননা দীন একটিই। আর দীনের উপর মানুষের জামা‘আতও একটি। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়েরই নির্দেশ দিয়েছেন। যিনি এ নির্দেশ মেনে চলবেন তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমর্থন লাভ করবেন ও তার বন্ধু হবেন। আর যে দীনের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে সে বিশৃঙ্খলা ও জাহিলী কর্মের উপরই টিকে থাকে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে মুক্ত।