রমযান মাসের ৩০ আসর অষ্টম আসর শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি
সিয়াম পালন এবং এর কাযার বিধানের দিক থেকে মানুষের প্রকারভেদের অবশিষ্ট আলোচনা

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি অনন্য, মহান, প্রবল, ক্ষমতাবান, শক্তিশালী, মহাপ্রতাপশালী; কল্পনা ও দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে আয়ত্ব করার উর্ধ্বে; প্রত্যেক সৃষ্টিকে তিনি মুখাপেক্ষিতার বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছেন; আপন শক্তিমত্তা প্রকাশ করেছেন দিবারাত্রির আবর্তনের মধ্য দিয়ে; দুরারোগ্য রোগীর ক্রন্দন শোনেন, যে নিজ অসুবিধার অনুযোগ-অভিযোগ করে; গুহাভ্যন্তরে আঁধার রাতে কৃষ্ণকায় পিঁপড়ের পদচিহ্ন তিনি দেখেন; অন্তরের অব্যক্ত এবং মনের লুকানো বিষয়ও তিনি জানেন; তাঁর গুণাবলিও তাঁর সত্তার মতোই (যেমনিভাবে তাঁর সত্তার প্রকৃত ধরণ কেউ জানে না তেমনিভাবে তাঁর গুণাগুণের প্রকৃত রূপ কেউ জানে না), যারা তার সাদৃশ্য নির্ধারণ করে (মুশাব্বিহা) তারা কাফের; কুরআন ও সুন্নায় তিনি নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন আমরা তা স্বীকার করি:

﴿أَفَمَنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ تَقۡوَىٰ مِنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٍ خَيۡرٌ أَم مَّنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٖ ﴾ [التوبة: ١٠٩]

‘যে তার গৃহের ভিত্তি আল্লাহর তাকওয়া ও সন্তুষ্টির উপর প্রতিষ্ঠা করল সে কি উত্তম নাকি ঐ ব্যক্তি যে তার গৃহের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এক গর্তের পতনোন্মুখ কিনারায়?’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৯) আমি পবিত্র ও মহান সে সত্তার প্রশংসা করি, আনন্দ ও বেদনা সর্বাবস্থায়।

আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, সৃষ্টি ও পরিচালনায় তিনি এক-অদ্বিতীয়:

﴿ وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ ﴾ [القصص: ٦٨]

‘আর আপনার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনীত করেন।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮) আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি শ্রেষ্ঠতম পুণ্যাত্মা নবী।

আল্লাহ সালাত তথা উত্তম প্রশংসা বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর হেরা গুহার সাথী আবূ বকরের ওপর, কাফেরদের মূলোৎপানকারী উমরের ওপর, স্বগৃহদ্বারে শহীদ উসমানের ওপর, শেষ রাতে সালাত আদায়কারী আলীর ওপর এবং তার সকল পরিবারবর্গ, সকল সাহাবী মুহাজির ও আনসারীগণের ওপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালাম পেশ করুন।

আমার ভাইয়েরা! ইতোপূর্বে সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে সাত প্রকার মানুষের কথা আলোচনা করেছি। আর এই হলো অবশিষ্ট প্রকারের মানুষের আলোচনা।

অষ্টম প্রকার: ঋতুবতী মহিলা।

সুতরাং ঋতুবতী মহিলার জন্য সিয়াম পালন করা হারাম; তার দ্বারা সিয়াম পালন সহীহ হবে না।

* কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

«مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ»، قُلْنَ: وَمَا نُقْصَانُ دِينِنَا وَعَقْلِنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «أَلَيْسَ شَهَادَةُ المَرْأَةِ مِثْلَ نِصْفِ شَهَادَةِ الرَّجُلِ» قُلْنَ: بَلَى، قَالَ: «فَذَلِكِ مِنْ نُقْصَانِ عَقْلِهَا، أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ» قُلْنَ: بَلَى، قَالَ: «فَذَلِكِ مِنْ نُقْصَانِ دِينِهَا»

‘তোমাদের মতো দীন ও জ্ঞানগত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আর কাউকে বিচক্ষণ লোকের বুদ্ধি হরণে এমন পারঙ্গম দেখিনি। তারা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দীন ও জ্ঞানগত অসম্পূর্ণতা কী? তিনি বললেন, নারীর সাক্ষ্য কি পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা বলল, নিশ্চয়। তিনি বললেন, এটাই হলো তোমাদের জ্ঞানগত কমতি। আর ঋতু অবস্থায় তার সালাত ও সিয়াম পালন করতে হয় না, এমন নয় কি? তারা বলল হ্যাঁ, তিনি বললেন, এটাই হলো দীনী কমতি।’[1]

হায়েয হলো: প্রকৃতিগত রক্তক্ষরণ নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য যা নারীদের নিয়মিত হয়ে থাকে।

সিয়াম পালনকারী নারীর যদি সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বেও ঋতুস্রাব দেখা দেয়, তাহলে তার ওই দিনের সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। তবে তা কাযা করতে হবে। তবে নফল সিয়াম হলে এর কাযা করাও নফল হবে।
আর যদি কোনো নারী রমযানের দিনের মধ্যভাগে ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে দিনের শুরুতে সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে ওই দিনের বাকী অংশেও সিয়াম পালন সহীহ হবে না।

প্রশ্ন হলো, দিনের অবশিষ্টাংশ সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে কি না?

এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুসাফিরের সিয়াম সম্পর্কিত মাসআলায় এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

আর যদি রমযানের রাতে সুবহে সাদিক উদয়ের সামান্য পূর্বেও কোনো নারী ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে তার ওপর সিয়াম পালন আবশ্যক। কেননা সে সিয়াম পালনে সক্ষমদের অন্তর্ভুক্ত, সিয়াম পালনে তার তো এখন কোনো বাধা নেই। তাই তার ওপর সিয়াম পালন ওয়াজিব। যদি সে সুবহে সাদিকের পর গোসল করে তবুও সিয়াম শুদ্ধ হবে। যেমন অপবিত্র ব্যক্তি সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পর গোসল করলেও তার সিয়াম শুদ্ধ হবে।

* কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«إِنْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيُصْبِحُ جُنُبًا مِنْ جِمَاعٍ، غَيْرِ احْتِلَامٍ فِي رَمَضَانَ، ثُمَّ يَصُومُ»

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নদোষ ছাড়া সহবাসজনিত নাপাক অবস্থায় সুবহে সাদিকের পর পবিত্রতা অর্জন করতেন এবং রমযানের সিয়াম পালন করতেন।’[2]

আর নিফাসওয়ালী মহিলাদের বিধান পূর্বোক্ত হায়েযওয়ালী মহিলাদের বিধানের মতোই।
হায়েয ও নিফাস অবস্থায় নারীর যে কয়দিন সিয়াম বাদ পড়বে, সে দিনগুলোর কাযা তার ওপর ওয়াজিব।

* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤]

‘তবে অন্য দিনে এগুলো গণনা (কাযা) করে নেবে।’ (সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৪)

* অনুরূপ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:

مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِي الصَّوْمَ، وَلَا تَقْضِي الصَّلَاةَ. فَقَالَتْ: أَحَرُورِيَّةٌ أَنْتِ؟ قُلْتُ: لَسْتُ بِحَرُورِيَّةٍ، وَلَكِنِّي أَسْأَلُ. قَالَتْ: «كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ، فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ، وَلَا نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلَاةِ»

‘ঋতুবতীর কী হলো যে, সে সিয়াম কাযা করে অথচ সালাত কাযা করে না? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি কি হারূরী? (অর্থাৎ খারেজি সম্প্রদায়ভুক্ত?) সে বলল, আমি হারূরী নই, বরং জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আমাদেরও এ অবস্থা হয়েছিল। তখন আমরা সিয়াম কাযা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। সালাতের জন্য নয়।’[3]

নবম প্রকার: যে দুগ্ধবতী কিংবা গর্ভবতী নারী সাওম পালনের কারণে নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন

এমতাবস্থায় তিনি সিয়াম পালন করবেন না; সাওম ভঙ্গ করবেন।

* কারণ, আনাস ইবন মালেক আল-কা‘বী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَضَعَ عَنِ الْمُسَافِرِ شَطْرَ الصَّلَاةِ، وَعَنِ الْمُسَافِرِ وَالْحَامِلِ وَالْمُرْضِعِ الصَّوْمَ، أَوِ الصِّيَامَ»

‘আল্লাহ তা‘আলা মুসাফিরদের সালাত অর্ধেক করেছেন। আর গর্ভবতী, স্তন্যদানকারিনী ও মুসাফির থেকে সিয়াম শিথিল করেছেন।’[4]যে কদিন তারা সিয়াম ত্যাগ করেছেন শুধুমাত্র ওই সিয়ামগুলো কাযা করা আবশ্যক। যখন তাদের জন্য কাযা করা সহজ হয় এবং শঙ্কা দূর হয়ে যায় তখনই তা কাযা করবে। যেমন অসুস্থ ব্যক্তি যখন সুস্থ হবে তখনই কেবল তার কাযা করবে।

[1] বুখারী: ৪০৩; মুসলিম: ১৩২।

[2] বুখারী: ১৯৩১; মুসলিম: ১১০৯।

[3] বুখারী: ৩২১; মুসলিম: ৩৩৫।

[4] আবূ দাঊদ: ২৪০৮; নাসাঈ: ২২৭৫; তিরমিযী: ৭১৫; ইবন মাজাহ: ১৬৬৭।