সাহাবী এবং আহলে বাইতের ব্যাপারে বিদআতীরা যা বলে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত

تبرؤ أهل السنة والجماعة مما يقوله المبتدعة في حق الصحابة وأهل البيت

সাহাবী এবং আহলে বাইতের ব্যাপারে বিদআতীরা যা বলে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَيَتَبَرَّءُونَ مِنْ طَرِيقَةِ الرَّوَافِضِ الَّذِينَ يُبْغِضُونَ الصَّحَابَةَ وَيَسُبُّونَهُمْ وَطَرِيقَةِ النَّوَاصِبِ الَّذِينَ يُؤْذُونَ أَهْلَ الْبَيْتِ بِقَوْلٍ أَوْ عَمَلٍ وَيُمْسِكُونَ عَمَّا شَجَرَ بَيْنَ الصَّحَابَةِ وَيَقُولُونَ: إِنَّ هَذِهِ الْآثَارَ الْمَرْوِيَّةَ فِي مَسَاوِيهِمْ مِنْهَا مَا هُوَ كَذِبٌ وَمِنْهَا مَا قَدْ زِيدَ فِيهِ وَنُقِصَ وَغُيِّرَ عَنْ وَجْهِهِ ، وَالصَّحِيحُ مِنْهُ هُمْ فِيهِ مَعْذُورُونَ: إِمَّا مُجْتَهِدُونَ مُصِيبُونَ وَإِمَّا مُجْتَهِدُونَ مُخْطِئُونَ وَهُمْ مَعَ ذَلِكَ لَا يَعْتَقِدُونَ أَنَّ كُلَّ وَاحِدٍ مِنَ الصَّحَابَةِ مَعْصُومٌ عَنْ كَبَائِرِ الْإِثْمِ وَصَغَائِرِهِ بَلْ يَجُوزُ عَلَيْهِمُ الذُّنُوبُ فِي الْجُمْلَةِ وَلَهُمْ مِنَ السَّوَابِقِ وَالْفَضَائِلِ مَا يُوجِبُ مَغْفِرَةَ مَا يَصْدُرُ مِنْهُمْ إِنْ صَدَرَ حَتَّى إِنَّهُمْ يُغْفَرُ لَهُمْ مِنَ السَّيِّئَاتِ مَا لَا يُغْفَرُ لِمَنْ بَعْدَهُمْ ؛ لِأَنَّ لَهُمْ مِنَ الْحَسَنَاتِ الَّتِي تَمْحُو السَّيِّئَاتِ مَا لَيْسَ لِمَنْ بَعْدَهُمْ وَقَدْ ثَبَتَ بِقَوْلِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُمْ خَيْرُ الْقُرُونِ وَأَنَّ الْمُدَّ مِنْ أَحَدِهِمْ إِذَا تَصَدَّقَ بِهِ كَانَ أَفْضَلَ مِنْ جَبَلِ أُحُدٍ ذَهَبًا مِمَّنْ بَعْدَهُمْ ثُمَّ إِذَا كَانَ قَدْ صَدَرَ مِنْ أَحَدِهِمْ ذَنْبٌ فَيَكُونُ قَدْ تَابَ مِنْهُ أَوْ أَتَى بِحَسَنَاتٍ تَمْحُوهُ أَوْ غُفِرَ لَهُ بِفَضْلِ سَابِقَتِهِ أَوْ بِشَفَاعَةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الَّذِي هُمْ أَحَقُّ النَّاسِ بِشَفَاعَتِهِ أَوِ ابْتُلِيَ بِبَلَاءٍ فِي الدُّنْيَا كُفِّرَ بِهِ عَنْهُ فَإِذَا كَانَ هَذَا فِي الذُّنُوبِ الْمُحَقَّقَةِ ؛ فَكَيْفَ الْأُمُورُ الَّتِي كَانُوا فِيهَا مُجْتَهِدِينَ: إِنْ أَصَابُوا فَلَهُمْ أَجْرَانِ وَإِنْ أَخْطَئُوا فَلَهُمْ أَجْرٌ وَاحِدٌ وَالْخَطَأُ مَغْفُورٌ ثُمَّ إِنَّ الْقَدْرَ الَّذِي يُنْكَرُ مِنْ فِعْلِ بَعْضِهِمْ قَلِيلٌ نَزْرٌ مَغْفُورٌ فِي جَنْبِ فَضَائِلِ الْقَوْمِ وَمَحَاسِنِهِمْ مِنَ الْإِيمَانِ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِهِ وَالْهِجْرَةِ وَالنُّصْرَةِ وَالْعِلْمِ النَّافِعِ وَالْعَمَلِ الصَّالِحِ وَمَنْ نَظَرَ فِي سِيرَةِ الْقَوْمِ بِعِلْمٍ وَبَصِيرَةٍ وَمَا مَنَّ اللَّهُ عَلَيْهِمْ بِهِ مِنَ الْفَضَائِلِ عَلِمَ يَقِينًا أَنَّهُمْ خَيْرُ الْخَلْقِ بَعْدَ الْأَنْبِيَاءِ لَا كَانَ وَلَا يَكُونُ مِثْلُهُمْ وَأَنَّهُمُ الصَّفْوَةُ مِنْ قُرُونِ هَذِهِ الْأُمَّةِ الَّتِي هِيَ خَيْرُ الْأُمَمِ وَأَكْرَمُهَا عَلَى اللَّهِ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের আকীদাহর অংশ হলো, তারা ঐ সমস্ত রাফেযীর[1] পথ পরিহার করে, যারা সাহাবীদেরকে ঘৃণা করে এবং তাদেরকে গালি দেয়।[2] তারা ঐ সব নাওয়াসেবদের[3] সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করে, যারা কথা কিংবা আচরণের মাধ্যমে আহলে বাইতকে কষ্ট দেয়। সাহাবীদের পরস্পরের মধ্যে যে সমস্ত মতবিরোধ, ফিতনা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে কথা বলা থেকে তারা বিরত থাকে।[4]

তারা বলে যে, সাহাবীদের দোষ-ত্রুটি আলোচনায় যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর কিছু মিথ্যা, কোনটিতে সংযোজন করা হয়েছে, কোনটি হতে কিছু অংশ বিয়োজন করা হয়েছে আবার কোনটিকে সঠিক স্থান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

সাহাবীদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনার হাদীছগুলো থেকে যা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান হলো, তাতে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। কেননা তারা ইজতেহাদ করেছিলেন। সুতরাং ইজতেহাদ করতে গিয়ে হয় তারা সঠিক সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছেন আর না হয় ভুল করেছেন। মূলতঃ ইজতেহাদের বিষয়টি এমন যে, মুজতাহিদগণ কখনো তাতে ভুল করে থাকে আবার কখনো তারা সঠিক সিদ্বান্তেও উপনীত হয়ে থাকে।

তা সত্ত্বেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা এই বিশ্বাস করেনা যে, প্রত্যেক সাহাবীই কবীরা ও সগীরা গুনাহ হতে মা’সুম; বরং তাদের দ্বারা গুনাহ হতে পারে। তবে ইসলাম গ্রহণে তাদের অগ্রগামিতাসহ এমনসব ফযীলত রয়েছে, যার দাবী এই যে, তাদের দ্বারা গুনাহ হয়ে থাকলেও তা ক্ষমাযোগ্য। এমনকি সাহাবীদের এমন গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে, যা পরবর্তীতে আগমণকারীদের বেলায় মাফ করা হবেনা। কেননা তাদের রয়েছে এমন অনেক সৎ আমল, যা পরবর্তীদের জন্য অর্জন করা অসম্ভব। সুতরাং সাহাবীদের এই সৎকর্মগুলো তাদের দোষ-ত্রুটি মিটিয়ে দিবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে, যে সাহাবীগণ ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ’’।[5] তাদের পরবর্তী যুগের কোনো মুসলিম উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় দান করলেও সে সাহাবীদের কারোর একমুষ্টি পরিমাণ খাদ্য দান করার সমান ছাওয়াব পাবেনা।

অতঃপর তাদের কারো দ্বারা ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলেও তা থেকে তিনি তাওবা করেছেন অথবা এমন সৎ আমল করেছেন, যা তার ভুল-ত্রুটিকে মিটিয়ে দিয়েছে অথবা সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণ ও সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়ার কারণে কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআতের দ্বারা তার সে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়া হবে। কেননা সাহাবীরাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআত পাওয়ার সর্বাধিক হকদার। অথবা দুনিয়াতে তাকে কোন মসীবতে ফেলা হয়েছে, যার কারণে উক্ত মসীবত তার গুনাহর কাফফারা হয়ে গেছে।

সুতরাং তাদের দ্বারা নিশ্চিতরূপে সংঘটিত গুনাহর অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে ঐসব ভুল-ত্রুটির কী অবস্থা হতে পারে, যাতে তারা ইজতেহাদ করেছিলেন? যদি তারা সেখানে হকে উপনীত হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের জন্য রয়েছে দু’টি নেকী। আর ভুল করে থাকলে রয়েছে একটি নেকী। আর ভুল-ত্রুটি তো ক্ষমাযোগ্যই।

এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তাদের কর্মসমূহ থেকে যে পরিমাণ কাজকে অপছন্দ করা হয়ে থাকে, তা অতি সামান্য ও নগণ্য। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ভালবাসা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হিজরত, দ্বীনের নুসরত (সাহায্য), উপকারী ইলম এবং সৎ আমলসহ তাদের আরো যেসব সুবিশাল ফযীলত ও অগণিত সৎকর্ম রয়েছে, তা দ্বারা উহা আচ্ছাদিত হয়ে গেছে।সুতরাং যে ব্যক্তি সজ্ঞানে ও জেনে-বুঝে সাহাবীদের পবিত্র জীবনীর প্রতি দৃষ্টি দিবে এবং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যেসব ফযীলত দান করেছেন, তার প্রতিও দৃষ্টিপাত করবে, সে নিশ্চিতভাবেই জানতে পারবে, তারাই নবীদের পরে সর্বোত্তম মানুষ। অতীতে সাহাবীদের মত মর্যাদাবান ও ফযীলতের অধিকারী কেউ ছিলনা। ভবিষ্যতেও তাদের মত ভাল লোক আর আসবেনা। তারা মুসলিম


ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই অংশে আহলে বাইত ও সাহাবীদের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রথমতঃ তাদের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান হলো ইফরাত (বাড়াবাড়ি) ও তাফরীত (অবহেলা ও শৈথিল্য) এবং সীমালঙ্ঘন ও কঠোরতার মাঝখানে। তারা উম্মতের সকল মুমিনকেই ভালবাসে। বিশেষ করে যেসব মুহাজির ও আনসার সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেছে এবং যারা উত্তমভাবে তাদের অনুসরণ করেছে, তারা তাদের সবাইকে ভালবাসে। তারা আহলে বাইতের প্রতিও অন্তর দিয়ে গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।

তারা সাহাবীদের মর্যাদা, ফযীলত ও নৈতিক গুণাবলী সম্পর্কে অবগত রয়েছে। সেই সাথে আহলে বাইতের জন্য আল্লাহ তাআলা যেসব হক নির্ধারণ করেছেন, তারা সেই হকগুলোও সংরক্ষণ করে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা রাফেযীদের তরীকা বর্জন করে এবং তাদের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখেনা। কারণ তারা সাহাবীদেরকে গালি দেয়[6], তাদের সমালোচনা করে এবং আলী (রাঃ) ও আহলে বাইতের ভালবাসায় সীমালংঘন করে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা নাওয়াসেবদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করে। কেননা তারা আহলে বাইতের সাথে শত্রুতা পোষণ করে, তাদেরকে কাফের বলে এবং তাদের সম্মানে আঘাত করে। সাহাবী এবং আহলে বাইতের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের মাজহাব পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাবের বিরোধী ও ভ্রান্ত মাজহাবগুলোর সাথে তুলনা করার জন্যই শাইখুল ইসলাম এখানে তা পুনরাবৃত্তি করেছেন।

দ্বিতীয়তঃ ফিতনার সময় সাহাবীদের মধ্যে যেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিল শাইখুল ইসলাম সেগুলোর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। সাহাবীদের দিকে যেসব দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধ করা হয় এবং তাদের নামে যেসব কুৎসা রটানো হয়, ইসলামের শত্রুরা সেগুলোকে সাহাবীদের বিরুদ্ধে আক্রমণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে এবং তাদের সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট করার সুযোগ খুঁজেছে। যেমন করেছে পরবর্তী যুগের কিছু আলেম এবং সমসাময়িক কতিপয় লেখক, যারা নিজেদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে ফয়সালাকারী নিযুক্ত করেছে এবং বিনা দলীলে কারো পক্ষ নিয়ে তাকে হকপন্থী বলেছে আবার কারো বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তাকে ভ্রান্ত বলেছে। বরং তারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং ঐসব মতলববাজ ও সুবিধাবাদীদের অন্ধ অনুসরণ করেই এরূপ করেছে, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে লিপ্ত। এর মাধ্যমে তারা মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাসের ব্যাপারে তাদেরকে সন্দিহান করে তুলতে চায় এবং তাদের সামনে সালাফে সালেহীনদের ঐসব লোকের চরিত্রকে কলঙ্কিত করে দিতে চায়, যারা ছিলেন এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এই কাজের পিছনে তাদের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা হলো ইসলামের বিশুদ্ধতা ও স্বচ্ছতায় আঘাত করা এবং মুসলিমদের ঐক্যে ফাটল ধরানো।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এখানে অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সত্যকে প্রকাশ করেছেন এবং প্রকৃত ঘটনাকে খোলাসা করেছেন। তিনি সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে, সাহাবীদের দিকে যেসব কথা সম্বন্ধ করা হয় এবং তাদের মধ্যে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা (ফিতনা, দলাদলি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ) হয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি দু’টি কথার মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাব খোলাসা করেছেন।

এক. তিনি বলেছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা সাহাবীদের মধ্যে সংঘটিত বাদানুবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে নিরব থাকে। অর্থাৎ তারা সে ব্যাপারে ঘাটাঘাটি করেনা এবং তাতে খোঁজাখুঁজিও করেনা। কেননা তাতে বেশী খোঁজাখুঁজি ও ঘাটাঘাটি করতে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ ও হিংসা জন্ম নিতে পারে। আর সাহাবীদের প্রতি অন্তরে হিংসা রাখা বড় ধরণের গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং নিরবতা পালন করা এবং সে বিষয়ে কথা না বলাই তা থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র পন্থা।

দুই. তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনায় যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, শাইখুল ইসলাম সেগুলোর জবাব দিয়েছেন। সাহাবীদের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে এবং তাদের শত্রুদের চক্রান্তকে প্রতিহত করার জন্যই তিনি তা করেছেন। শাইখুল ইসলামের জবাবগুলো সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

(১) যেসব হাদীছে তাদের দোষ-ত্রুটির কথা উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট বর্ণনা রয়েছে। সাহাবীদের সুনাম নষ্ট করার জন্য তাদের দুশমনরা এসব হাদীছ রচনা করেছে। যেমন করে থাকে রাফেযীরা। আল্লাহ তাআলা তাদের চেহারা কালো করুন! সুতরাং তাদের মিথ্যা বর্ণনার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাবেনা।

(২) এসব দোষ-ত্রুটি সম্বলিত বর্ণনার কোনটিতে সংযোজন করা রয়েছে, কোনটি হতে কিছু অংশ বিয়োজন করা হয়েছে আবার কোনটিকে সঠিক স্থান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এগুলোর মধ্যে মিথ্যা প্রবেশ করেছে এবং বর্ণনাগুলো বিকৃত করা হয়েছে। তাই এগুলোর উপর নির্ভর করা যাবেনা। কেননা সাহাবীদের ফযীলত ও মর্যাদা সর্বজন বিদিত এবং তাদের ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জ্ঞাত। সুতরাং বিকৃত ও সন্দিহান বিষয়ের পিছনে পড়ে নিশ্চিতভাবে জ্ঞাত বিষয়কে পরিত্যাগ করা যাবেনা।

(৩) সাহাবীদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনার হাদীছগুলো থেকে যা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান হলো, তাতে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। কেননা তারা ইজতেহাদ করেছিলেন। সুতরাং ইজতেহাদ করতে গিয়ে হয় তারা সঠিক সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছেন আর না হয় ভুল করেছেন। মূলতঃ ইজতেহাদের বিষয়টি এমন যে, মুজতাহিদগণ কখনো ভুল করে থাকেন আবার কখনো সঠিক সিদ্বান্তেও উপনীত হয়ে থাকেন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাহাবীদের যেসব ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে, তা ছিল এমন ইজতেহাদী বিষয় সমূহে, যাতে মুজতাহিদ সঠিক সিদ্বান্তে উপনীত হলে দু’টি ছাওয়াব পায় এবং ভুল করলেও একটি নেকী পায়। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা ও আমর বিন আস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ». (بخارى:7352)

‘‘কোন বিচারক ইজতেহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। পক্ষান্তরে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তার জন্যও একটি পুরস্কার রয়েছে’’।

(৪) সাহাবীগণ মানুষ ছিলেন। সুতরাং বনী আদমের অন্যান্য মানুষ দ্বারা যে ভুল-ত্রুটি হওয়া সম্ভব, তাদের দ্বারাও তা সংঘটিত হওয়া সম্ভব। সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা এই বিশ্বাস করেনা যে, সাহাবীদের প্রত্যেকেই কবীরা ও সগীরা গুনাহ থেকে মাসুম (নিষ্পাপ)। বরং তাদের কারো কারো দ্বারা গুনাহর কাজ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাদের দ্বারা কোন গুনাহ হয়ে থাকলেও গুনাহ মোচনের অনেক আমল রয়েছে। নিম্নে তা থেকে কিছু আমল বর্ণনা করা হলোঃ

(ক) ইসলাম গ্রহণে তাদের অগ্রগামীতাসহ এমনসব ফযীলত রয়েছে, যার দাবী হলো, তাদের দ্বারা গুনাহ হয়ে থাকলেও তা ক্ষমাযোগ্য। সুতরাং তাদের কারো দ্বারা যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, তাঁর অগণিত সৎ আমল থাকার কারণে সেই ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ হয়ে গেছে। যেমন এসেছে হাতেব বিন আবু বালতাআর ঘটনায়। মক্কা বিজয়ের বছর তার পক্ষ হতে একটি ভুল হয়ে গিয়েছিল। তিনি যেহেতু বদরের যুদ্ধে শরীক ছিলেন, তাই তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।[7] এমনকি সাহাবীদের এমন গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে, যা পরবর্তীতে আগমণকারীদের বেলায় মাফ করা হবেনা। কেননা তাদের রয়েছে এমন অনেক সৎ আমল, যা পরবর্তীদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সুতরাং সাহাবীদের এই সৎকর্মগুলো তাদের দোষ-ত্রুটি মিটিয়ে দিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَأَقِمْ الصَّلَاةَ طَرَفِي النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنْ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ﴾ ‘‘আর দিনের দুই প্রান্তে নামায প্রতিষ্ঠা করবে এবং রাতের প্রান্তভাগেও। সৎ কাজ অবশ্যই গুনাহসমূহকে দূর করে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)

(খ) অন্যদের তুলনায় সাহাবীদের সৎআমল বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফযীলতের ক্ষেত্রে কেউ সাহাবীদের সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারবেনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, সাহাবীগণই ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। তাদের পরবর্তী যুগের কোন মুসলিম উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় দান করলেও সে সাহাবীদের কারোর একমুষ্টি পরিমাণ খাদ্য দান করার সমান ছাওয়াব পাবেনা। বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«خَيْرُ القرون قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ»

‘‘আমার উম্মতের মধ্যে আমার যুগের মানুষেরা সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর পরবর্তী যুগের লোকেরা’’।[8] القرون শব্দটি القرن এর বহুবচন। القرن বলা হয় একই যুগের বা কাছাকাছি যুগের এমন একদল মানুষকে, যারা বিশেষ কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি কাজে অংশগ্রহণ করে। নির্দিষ্ট মেয়াদী একটি সময়কেও কার্ন বলা হয়।

(গ) তাদের কাছে গুনাহ মোচনের অনেক কাফ্ফারা এবং উপকরণ ও মাধ্যম রয়েছে, যা অন্যদের কাছে নেই। তাদের কারো দ্বারা ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলেও তা থেকে তিনি তাওবা করেছেন অথবা এমন সৎ আমল করেছেন, যা তার ভুল-ত্রুটিকে মিটিয়ে দিয়েছে অথবা সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণ ও সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়ার কারণে তার সেই গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ গুনাহটি করার পূর্বে সে যত সৎ আমল করেছে, সেগুলোর তুলনায় গুনাহটি খুব নগণ্য হওয়ার কারণে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআতের দ্বারা তার সে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অথবা দুনিয়াতে তাকে কোন মসীবতে ফেলা হয়েছে, যার কারণে উক্ত মসীবত তার গুনাহর কাফফারা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তাকে পরীক্ষা ও মসীবতে ফেলা হয়েছে। অতঃপর সেই গুনাহ উক্ত মসীবতে ফেলে কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। যেমন সহীহ হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلا وَصَبٍ، وَلا هَمٍّ وَلا حُزْنٍ، وَلا أَذًى وَلا غَمٍّ، حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا، إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ»

‘‘মুসলিম কোন ক্লান্তি, কষ্ট, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, নির্যাতন ও বিষণ্ণতার শিকার হলে, এমনকি কাঁটাবিদ্ধ হলেও এর বদলে আল্লাহ্ তাআলা তার গুনাহ্ মাফ করে দেন’’।[9] ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং মসীবতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সাধারণ মুমিনদের গুনাহ মাফ হলে সাহাবীগণ তাতে পতিত হয়ে ক্ষমা পাওয়ার আরো বেশী হকদার হবেন।

সুতরাং সাহাবীদের দ্বারা যেসব ভুল-ত্রুটি নিশ্চিতভাবেই হয়েছে, তার ব্যাপারটি যদি এমন হয় যে, সৎকাজ থাকার কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তাহলে ঐসব গুনাহ কেন ক্ষমা করা হবেনা, যাতে তারা মুজতাহিদ ছিলেন। শরীয়তের হুকুম জানার জন্য শ্রম ব্যয় করাকে الاجتهاد বলা হয়। মুজতাহিদগণ যদি ইজতেহাদ করতে গিয়ে সঠিক সিদ্বান্তে উপনীত হতে পারেন, তাহলে তাদের দু’টি নেকী হবে আর ভুলের মধ্যে পড়ে গেলে একটি নেকী হবে। আর মুজতাহিদের ভুল ক্ষমা করে দেয়া হবে। যেমন একটু পূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং সাহাবীদের থেকে যে সামান্য পরিমাণ ভুল-ত্রুটি হয়েছে, তাতে দু’টি অবস্থার একটি অবস্থা হতে পারে। (১) হতে পারে সাহাবী ইজতেহাদ করতে গিয়ে ভুলটি করে ফেলেছেন। তাতে তিনি বিনিময় প্রাপ্ত হবেন এবং তার ভুলটি মাফ করে দেয়া হবে। (২) এও হতে পারে যে, গুনাহটি ইজতেহাদে ভুল করার কারণে হয়নি; এমনিতেই হয়েছে। কিন্তু তার কাছে এত বিশাল পরিমাণ আমলে সালেহ, অগণিত ফযীলত এবং সৎকাজে অগ্রগামিতা রয়েছে, যা তার গুনাহর কাফফারা হয়ে গেছে এবং গুনাহকে মিটিয়ে দিয়েছে।

মোট কথা, সাহাবীদের দ্বারা যে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, তা তাদের বিশাল বিশাল সৎকাজের তুলনায় খুবই কম। পূর্বে যদিও তা বর্ণনা করা হয়েছে, তারপরও এখানে সংক্ষিপ্তাকারে তাদের ফযীলত ও সৎকর্মগুলো পুনরাবৃত্তি করা হলোঃ

(১) আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ছিল তাদের অগাধ বিশ্বাস। এটি ছিল তাদের সর্বোত্তম আমল।

(২) তারা আল্লাহ তাআলার কালেমাকে সুউচ্চ আসনে আসীন করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বোত্তম জিহাদ করেছেন। আর ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া হলো এই জিহাদ।

(৩) তারা আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করেছেন। এটিও ইসলামের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল।

(৪) তারা আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে বলেছেনঃ

﴿لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ﴾

‘‘এই সম্পদ সেইসব গরীব মুহাজিরদের জন্য, যারা নিজেদের ঘর-বাড়ী ও বিষয়-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে৷ এসব লোক চায় আল্লাহর অনুগ্রহ এবং সন্তুষ্টি৷ আর প্রস্ত্তত থাকে আল্লাহ ও তার রাসূলকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য৷ এরাই হলো সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ লোক’’। (সূরা হাশরঃ ৮)

(৫) তাদের রয়েছে উপকারী ইলম এবং অসংখ্য সৎআমল।

(৬) তারা নবীদের পরে আল্লাহ তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা। উম্মতে মুহাম্মাদী হলো সর্বোত্তম উম্মত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ﴾

‘‘তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম জাতি৷ তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কারের জন্য৷ তোমরা সৎকাজের হুকুম দিয়ে থাকো, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো’’। (সূরা আলইমরানঃ ১১০) আর সাহাবীগণ হলেন এই উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ হলেন আমার যুগের লোকগণ।(৭) সাহাবীগণ হলেন শ্রেষ্ঠতম উম্মতের মধ্য হতে বাছাইকৃত এবং আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি। যেমন ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল (রঃ) বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «أَنْتُمْ تُوفونَ سَبْعِينَ أُمَّة أَنْتُمْ خَيْرهَا وَأَكْرَمهَا عَلَى» اللَّه‘‘তোমাদের দ্বারা বড় বড় উম্মতের সংখ্যা সত্তরে পরিণত হয়েছে। তোমরা তাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট সবচেয়ে সম্মানিত’’। ইমাম তিরমিযী, ইবনে মাজাহ এবং হাকেম তাঁর কিতাব মুস্তাদরেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

[1] - শিয়াদের একটি উপদলকে রাফেযী বলা হয়। তাদেরকে জা’ফারীয়া হিসাবেও নামকরণ করা হয়। বর্ণিত হয়েছে যে, শিয়াদের একটি দল যায়েদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলীর কাছে এসে আবু বকর এবং উমারের প্রশংসা বর্জন করার আহবান জানালো। কিন্তু তিনি তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার কারণে তারা বললঃ إذا نرفضك অর্থাৎ তাহলে আমরাই আপনাকে বর্জন করলাম। এখান থেকেই তাদেরকে রাফেযী বলা হয়। এদের অন্যতম আকীদাহ হলো, তারা আহলে বাইত ছাড়া বাকী সাহাবীদেরকে ঘৃণা করে, গালি দেয় এবং তাদেরকে কাফের বলে।

[2] - শিয়া ও রাফেযীরা আমীরে মুআবীয়া (রাঃ)কে মারাত্মক ঘৃণা করে, গালি দেয় এবং কাফের মনে করে। কিন্তু আহ্লুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদায় বিশ্বাসী মুসলিমগণ তাঁকে গালি দেয়া এবং ঘৃণা করাকেও বৈধ মনে করেনা। কারণ তাঁর ফজীলতে সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

[3] - নাওয়াসেবরা রাফেযীদের বিপরীত। النصب শব্দের অর্থ হলো শত্রুতা পোষণ করা। তারা যেহেতু আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে, তাইতাদেরকে নাওয়াসেব বলা হয়।

[4] - উছমান বিন আফফান (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর উষ্ট্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উছমান (রাঃ)এর হত্যাকে কেন্দ্র করে ভুল বুঝাবুঝিই এই যুদ্ধের মূল কারণ। এই যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলেন আলী (রাঃ) এবং অপর পক্ষে ছিলেন আয়েশা, তালহা এবং যুবায়ের (রাঃ)। যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয়। এখানে যে কথাটি আমি বলতে চাই তা হলো কোন পক্ষেরই যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল না।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধের জন্য বের হন নি। তিনি উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসার জন্যে বের হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর বের হওয়ার মধ্যেই মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণ রয়েছে। অতঃপর তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন যে, বের না হওয়াটাই ছিল ভাল। তাই তিনি যখনই বের হওয়ার কথা স্মরণ করতেন তখন কেঁদে ওড়না ভিজিয়ে ফেলতেন। এমনিভাবে যারাই আলী (রাঃ) এবং মুআবিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের সবাই পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছেন। আয়েশা (রাঃ)এর বের হওয়া সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছিলেন। বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আয়েশা (রাঃ) বনী আমেরের বাড়ি-ঘরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন তাঁকে দেখে কতগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল। তিনি বললেনঃ এই জলাশয়টির (পুকুরটির) নাম কি? লোকেরা বললোঃ এটির নাম ‘হাও-আব’। একথা শুনে আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ আমার ফেরত যেতে ইচ্ছে করছে। যুবায়ের (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ অগ্রসর হোন! যাতে মানুষেরা আপনাকে দেখতে পায় এবং হতে পারে আল্লাহ তা’আলা আপনার মাধ্যমে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দিবেন। তিনি পুনরায় বললেনঃ মনে হচ্ছে আমার ফেরত যাওয়া উচিৎ। কেননা আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি, তিনি আমাদেরকে (নবী পত্নীদেরকে) লক্ষ্য করে বলেছেনঃ ‘‘কেমন হবে তখনকার অবস্থা যখন তোমাদের কাউকে দেখে হাও-আবের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করবে?’’। (মুস্তাদরাকুল হাকীম। ইমাম ইবনে হাজার (রঃ) বলেনঃ হাদীছের সনদটি বুখারীর শর্ত অনুযায়ী, ফাতহুল বারী, (১২/৫৫)

হাদীছের সরল ব্যাখ্যা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ ‘‘হে আয়েশা! সেদিন তোমার অবস্থা কেমন হবে? যেদিন তোমাকে দেখে ‘হাও-আব’ নামক জলাশয়ের নিকটস্থ কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। আয়েশা (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর বাণীটি মুখস্থ রেখেছিলেন। তিনি যখন ইরাকের বসরা শহরের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ভবিষ্যৎ বাণীটি স্মরণ করে জিজ্ঞেস করলেন এটি কোন জলাশয়? লোকেরা বললো, এটি হাও-আবের জলাশয়। এই কথা শুনে তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে সক্ষম হলেন যে তিনি ফিতনায় পড়ে গেছেন এবং বার বার ফেরত আসার চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে তিনি নিরাপদে মদীনায় ফেরত আসলেন। তিনি নিজেও যুদ্ধ করেন নি এবং কাউকে যুদ্ধের আদেশও দেন নি।

সিফ্ফীনের ফিতনাঃ

উছমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি নিহত হওয়ার পর গোলযোগের মধ্য দিয়ে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু খলীফা নির্বাচিত হন। মদীনার বিজ্ঞ সাহাবীগণ তাঁর নিকট খেলাফতের বাইআত করেন। তাদের বাইআতের মাধ্যমে তিনি মুসলিম উম্মাহর চতুর্থ ন্যায়পরায়ন খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু মুআবীয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং সিরিয়াবাসী আলী রাযিয়াল্লাহুর আনুগত্য বর্জন করে। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, খেলাফতের দাবীতে তিনি আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর আনুগত্য বর্জন করেন নি, যেমনটি দাবী করে থাকে ইসলাম বিদ্বেষী কিছু এবং সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ শ্রেণীর লোকেরা; বরং তাঁর দাবী ছিল, প্রথমে উছমান হত্যার বিচার হবে, অতঃপর তিনি বাইআত করবেন। ঐদিকে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর কথা ছিল, তিনি যেহেতু নির্বাচিত খলীফা, তাই আগে তাঁর প্রতি প্রথমে মুআবীয়া আনুগত্য প্রকাশ করবেন। অতঃপর শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে এবং প্রকৃত হত্যাকারীদেরকে সনাক্ত করা সম্ভব হলে হত্যার বিচার হবে। এ ক্ষেত্রে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর অবস্থান সঠিক ছিল। কিন্তু মুআবীয়া তা এই যুক্তিতে মানতে পারলেন না যে, ন্যায়পরায়ন খলীফা এবং আশারায়ে মুবাশ্শারার অন্যতম সাহাবীর রক্তের বদলা নেয়ার পূর্বে কোনভাবেই আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে বাইআত করা যায়না। এতে করে কুরআনের আয়াতে হত্যার বদলে হত্যার ফরযীয়াতই বাতিল হয়ে যায়। উভয় পক্ষই নিজ নিজ দাবীর উপর অটল থাকার কারণেই মূলত এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে উভয় পক্ষই ইজতেহাদ করেছিলেন। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ইজতেহাদে সঠিক সিদ্বান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন বলে তিনি দু’টি পুরস্কার পাবেন। আর মুআবীয়ার ইজতেহাদ ভুল হয়েছিল। তাই তিনি একটি পুরস্কার পাবেন। এখানে কোন পক্ষই দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্য যুদ্ধ করেন নি। উভয়ের দাবীই ছিল এক ও অভিন্ন। সুতরাং আলী বা মুআবীয়ার কাউকেই দোষারোপ করা যাবেনা। এতে করে শুধু পাপের বোঝাই বৃদ্ধি পাবে। এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَقْتَتِلَ فِئَتَانِ عَظِيمَتَانِ يَكُونُ بَيْنَهُمَا مَقْتَلَةٌ عَظِيمَةٌ دَعْوَتُهُمَا وَاحِدَةٌ»

‘‘আমার উম্মতের দু’টি বিশাল দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। তাদের মাঝে ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। কিন্তু উভয়ের দাবী হবে একটাই’’। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান)

এখানে দুইটি দল বলতে আলী (রাঃ) ও মুআবিয়া (রাঃ)এর দলকে বুঝানো হয়েছে। হিজরী ৩৬ সালে ইরাকের ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিফ্ফীন নামক স্থানে এই দল দু’টি পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে উভয় পক্ষের প্রায় ৭০ হাজার লোক নিহত হয়’’। (মু’জামুল বুলদান, (৩/ ৪১৪)

আলী ও মুআবিয়া (রাঃ)এর মাঝে যে সমস্ত যুদ্ধ হয়েছে তার কোন একটিও তাদের ইচ্ছায় হয়নি; বরং উভয় দলের মধ্যে কিছু পথভ্রষ্ট, কুপ্রবৃত্তির অনুসারী এবং কুচক্রী লোক ছিল। তারা সর্বদাই মানুষকে যুদ্ধের প্রতি উস্কানি দিতে থাকে। এতে করে বিষয়টি উভয়ের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ ‘‘আলী ও মুআবিয়া (রাঃ)এর দলের মধ্য থেকে যারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই আলী বা মুয়াবীয়া (রাঃ)এর কারো আনুগত্য করতোনা। আলী বা মুআবিয়া কখনই মুসলমানদের রক্তপাত কামনা করেন নি। কিন্তু যা কাম্য ছিলনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা হয়েই গেল। কথায় আছে ফিতনা যখন শুরু হয়ে যায় জ্ঞানীরাও তার আগুন নিভাতে অক্ষম হয়ে যায়’’। (মিনহাজুস্ সুন্নাহ, (২/২২৪)

[5] - নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, » «خَيْرُ أُمَّتِي قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ‘‘আমার উম্মতের মধ্যে আমার যুগের মানুষেরা সর্বোত্তম। অতঃপর পরবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর পরবর্তী যুগের লোকেরা’’। (বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল মানাকিব)

[6] - সুতরাং যে ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ মুমিন এবং আওলীয়াদের সর্দারদের ব্যাপারে অন্তরে হিংসা রাখবে তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? শুধু তাই নয় এই উম্মতের মধ্য হতে যারা সাহাবীদেরকে ঘৃণা করবে তারা ইহুদী এবং নাসারাদের চেয়েও নিকৃষ্ট। ইহুদীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হল তোমাদের ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কারা সর্বশ্রেষ্ঠ? উত্তরে তারা বললঃ মূসার সাহাবীগণ। নাসারাদেরকে বলা হলো, তোমাদের ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কারা সর্বশ্রেষ্ঠ? উত্তরে তারা বললঃ ঈসা ইবনে মারইয়ামের সাথী হাওয়ারীগণ। শিয়াদের একটি দল রাফেযীদেরকে বলা হলো, তোমাদের ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট? উত্তরে তারা বললঃ মুহাম্মাদের সাহাবীগণ। (দেখুনঃ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া)


[7] - হাতেব বিন আবু বালতাআর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা বিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তখন বিশেষ উদ্দেশ্যে আক্রমণের বিষয়টি সাহাবীদেরকে গোপন রাখতে বললেন। কিন্তু সাহাবী হাতিব বিন আবু বালতাআ শুধু তার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গোপন সামরিক তথ্য শত্রুদের জানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মক্কাবাসীদেরকে রাসূলের উদ্দেশ্য জানিয়ে তিনি একটি চিঠি লিখে একজন মহিলার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহীর মাধ্যমে হাতেবের এই কর্মের কথা জানতে পেরে সাথে সাথে কয়েকজন সাহাবীকে চিঠিটি উদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। তারা রাওযায়ে খাক নামক বাগানে মহিলাকে পাকড়াও করে চিঠি উদ্ধার করেন। এরপর হাতেবকে ডেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিঠির বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বললেন। হাতেব বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি কেবল আমার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার জন্যই এমনটি করেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাকে ক্ষমা করে দিলেন। উমার (রাঃ) তখন বলেছিলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন। আমি তার গর্দান উড়িয়ে ফেলি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ তুমি কি জানোনা যে, আল্লাহ তাআলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, তোমাদের মন যা চায় করতে পারো, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

[8] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল মানাকিব।

[9] - সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৫৩১৮।