শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট নবী পরিবারের মর্যাদা ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী] ১ টি
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট নবী পরিবারের মর্যাদা

مكانة أهل البيت عند أهل السنة والجماعة

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট নবী পরিবারের মর্যাদা:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَيُحِبُّونَ أَهْلَ بَيْتِ رَسُولِ اللهِ صَلَّىْ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ، وَيَتَوَلَّوْنَهُمْ، وَيَحْفَظُونَ فِيهِمْ وَصِيَّةَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم:حَيْثُ قَالَ يَوْمَ غَدِيرِ خُمٍّ: "أُذَكِّرُكُمُ اللهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي" وَقَالَ أَيْضًا لِلْعَبَّاسِ عَمِّه وَقَدِ اشْتَكَى إِلَيْهِ أَنَّ بَعْضَ قُرَيْشٍ يَجْفُو بَنِي هَاشِمٍ- فَقَالَ: "وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ؛ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحِبُّوكُمْ؛ للهِ وَلِقَرَابَتِي وَقَالَ: "إِنَّ اللهَ اصْطَفَى بَنِي إِسْمَاعِيلَ، وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي إسْمَاعِيلَ كِنَانَةَ وَاصْطَفَى مِنْ كِنَانَةَ قُرَيْشًا، وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ، وَاصْطَفَانِي مِنْ بَنِي هَاشِمٍ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকগণ নবী পরিবারের সকল সদস্যকে ভালবাসে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে এবং তাদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ অসীয়তকে হেফাযত করে, যা তিনি গাদীরে খুম্মের দিন করেছিলেন। তিনি সেদিন বলেছেনঃ أُذَكِّرُكُمُ اللهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي « ‘‘আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে আল্লাহর আদেশ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি’’।[1] তাঁর চাচা আববাস যখন তাঁর নিকট অভিযোগ করলেন, কুরাইশদের কিছু লোক বনী হাশেমদের লোকদের সাথে দুর্ব্যবহার করছে, তখন তিনি বললেনঃ সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর জন্য এবং আমার সাথে আত্মীয়তার কারণে তোমাদেরকে ভালবাসবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানদের থেকে বনী ইসমাঈলকে বাছাই করে নিয়েছেন। ইসমাঈলের সন্তানদের থেকে বনী কেনানাকে নির্বাচন করেছেন। আর বনী কেনানা থেকে কুরাইশকে বাছাই করে নিয়েছেন। কুরাইশ বংশ থেকে নির্বাচিত করেছেন বনী হাশেমকে। আর হাশেমের বংশ থেকে নির্বাচন করেছেন আমাকে’’।[2]


ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম এখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহলে বাইতকে ভালবাসে। নবী পরিবাবের ঐ সমস্ত সদস্য আহলে বাইতের মধ্যে শামিল, যাদের জন্য সাদকাহ গ্রহণ করা হারাম করা হয়েছে। তারা হলেন আলী (রাঃ), জা’ফর, আকীল, আববাস (রাঃ) এবং তাদের পরিবারের সকল সদস্য। এমনি হারিছ বিন আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানগণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর স্ত্রী এবং কন্যাগণও আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا﴾

‘‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে’’। (সূরা আহযাবঃ ৩৩)

সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা নবী পরিবারের লোকদেরকে ভালবাসে এবং তাদেরকে সম্মান করে। কেননা তাদেরকে ভালবাসা ও সম্মান করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালবাসা ও সম্মান করার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে সম্মান করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى﴾ ﴿ ‘‘হে নবী! এসব লোককে বলে দাও, এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা৷ তবে আত্মীয়তার ভালবাসা অবশ্যই চাই’’। (সূরা শুরাঃ ২৩) সুন্নাতে এই বিষয়ে অনেক দলীল রয়েছে। এগুলো থেকে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া কিছু উল্লেখ করেছেন। তবে ভালবাসা পাওয়ার শর্ত হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মীয়দের সালাফগণের ন্যায় সুন্নাতের অনুসারী হতে হবে এবং দ্বীনের উপর সুদৃঢ় থাকতে হবে। যেমন ছিলেন আববাস ও তাঁর সন্তানগণ এবং আলী ও তাঁর সন্তানগণ।

পক্ষান্তরে যারা রাসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা করবে এবং দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেনা, তাদেরকে ভালবাসা নাজায়েয। যদিও সে আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত হয়।

ويتولونهم তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেঃ অর্থাৎ তাদেরকে ভালবাসে। يتولون শব্দটি الولاء থেকে গৃহীত হয়েছে। الولاء শব্দের واو বর্ণে যবর দিয়ে পড়া হয়েছে। এর অর্থ হলো ভালবাসা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসীয়তকে হেফাযত করেঃ তারা সেই অসীয়ত অনুযায়ী আমল করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। তিনি গাদীরে খুম্মের দিন বলেছেনঃ ‘‘আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে আল্লাহর আদেশ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি’’। বন্যার বা বৃষ্টির পানি যেখানে গিয়ে জমা হয়, তাকে غدير (গাদীর) বলা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, খুম্ম একজন ব্যক্তির নাম। তার দিকে সেই স্থানের পানিকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে غدير خم ‘খুম্মের জলাশয়’।

কেউ কেউ বলেছেনঃ বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত একটি স্থানের নাম হলো খুম্ম। জলাশয়টিকে এই স্থানটির দিকে সম্বোধন করার কারণ হলো জলাশয়টি সেখানেই অবস্থিত ছিল। এই পুকুর বা জলাশয়টি মক্কা থেকে মদীনায় আসার রাস্তার পাশে (জুহফায়) অবস্থিত ছিল। বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে আসার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই জলাশয়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন এবং সেখানে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের মধ্যে উপরোক্ত কথাটিও ছিল, যা শাইখুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তিনি বলেছিলেনঃ আল্লাহ তাআলা আমার আহলে বাইতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এবং তাদের হক আদায় করার যে আদেশ দিয়েছেন, আমি তোমাদেরকে সেই আদেশ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।

وَقَالَ أَيْضًا لِلْعَبَّاسِ عَمِّه তিনি তাঁর চাচা আববাসকে বলেছিলেনঃ আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশিম বিন আবদে মানাফ। তিনি একটি অপছন্দনীয় বিষয় দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবগত করেছিলেন। তিনি জানালেন যে, কুরাইশদের কিছু লোক বনী হাশেমের লোকদের প্রতি দুর্ব্যবহার করছে। الجفاء অর্থ হলো সদাচরণ পরিহার করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন কসম করে বললেনঃ ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ না তারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য এবং আমার সাথে আত্মীয়তার কারণে তোমাদেরকে ভালবাসবে। অর্থাৎ দুই কারণে আহলে বাইতের লোকদেরকে ভালবাসতে হবে। (১) আহলে বাইতকে ভালবাসার মাধ্যমে তারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করবে। কেননা তারা আল্লাহর অলীদের অন্তর্ভূক্ত। (২) তারা ছিলেন রাসূলের আত্মীয়। সুতরাং তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশী হবেন এবং এর মাধ্যমে তাঁর প্রতি সম্মানও প্রদর্শন করা হয়। বনী হাশেমের ফযীলতের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, তারা হলেন তাঁরই আত্মীয়। আল্লাহ তাআলা ইসমাঈল বিন ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সাল্লামের বংশধর হতে উত্তম হিসাবে বনী কেননাকে নির্বাচন করেছেন। কেননা একটি গোত্রের নাম। তাদের পূর্ব পুরুষ ছিল কেনানা বিন খুযাইমা। কেনানা থেকে বাছাই করেছেন কুরাইশকে। কুরাইশরা হলো মুযার বিন কেননার সন্তান। কুরাইশ থেকে আল্লাহ তাআলা বনী হাশেমকে নির্বাচন করেছেন। এরা হলেন হাশেম বিন আব্দে মানাফের সন্তান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমাকে বনী হাশেম থেকে বাছাই করেছেন।

সুতরাং তিনি হলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশেম বিন আব্দে মানাফ বিন কুসাই বিন কিলাব বিন মুররাহ বিন কা’ব বিন লুআই বিন গালেব বিন ফিহির বিন মালেক বিন নযর বিন কেনানা বিন খুযাইমা বিন মুদরেকা বিন ইলয়াস বিন মুযার বিন নায্যার বিন মাআদ বিন আদনান।উপরোক্ত হাদীছ থেকে দলীল পাওয়া গেল যে, আরবদের ফযীলত রয়েছে। আর কুরাইশ বংশ হলো অন্যান্য আরব গোত্র হতে উত্তম। বনী হাশেম কুরাইশদের মধ্যে সর্বোত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী হাশেমের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। সুতরাং তিনি ব্যক্তিগত দিক থেকে সর্বোত্তম আদম সন্তান এবং তাঁর বংশ মর্যাদাও সর্বশ্রেষ্ঠ। এই হাদীছের মধ্যে বনী হাশেমেরও ফযীলত সাব্যস্ত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মীয়রাই হলো বনী হাশেম।

[1] - সহীহ মুসলিম।

[2] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ ফাযায়েল, অনুচ্ছেদঃ সৃষ্টিকুলের উপর আমাদের নবীর মর্যাদা। হা/৪২২১।