শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া এই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তাআলার কালাম ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী] ১ টি
এই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তাআলার কালাম

وجوب الإيمان بأن القرأن كلام الله حقيقة

এই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তাআলার কালাম:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَمِنَ الْإِيمَانِ بِاللَّهِ وَكُتُبِهِ الْإِيمَانُ بِأَنَّ الْقُرْآنَ كَلَامُ اللَّهِ مُنَزَّلٌ غَيْرُ مَخْلُوقٍ مِنْهُ بَدَأَ وَإِلَيْهِ يَعُودُ وَأَنَّ اللَّهَ تَكَلَّمَ بِهِ حَقِيقَةً وَأَنَّ هَذَا الْقُرْآنَ الَّذِي أَنْزَلَهُ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ كلَامُ اللَّهِ حَقِيقَةً لَا كلَامُ غَيْرِهِ وَلَا يَجُوزُ إِطْلَاقُ الْقَوْلِ بِأَنَّهُ حِكَايَةٌ عَنْ كَلَامِ اللَّهِ أَوْ عِبَارَةٌ بَلْ إِذَا قَرَأَهُ النَّاسُ أَوْ كَتَبُوهُ فِي الْمَصَاحِفِ لَمْ يَخْرُجْ بِذَلِكَ عَنْ أَنْ يَكُونَ كَلَامَ اللَّهِ تَعَالَى حَقِيقَةً فَإِنَّ الْكَلَامَ إِنَّمَا يُضَافُ حَقِيقَةً إِلَى مَنْ قَالَهُ مُبْتَدِئًا لَا إِلَى مَنْ قَالَهُ مُبَلِّغًا مُؤَدِّيًا وَهُوَ كَلَامُ اللَّهِ حُرُوفُهُ وَمَعانِيهِ لَيْسَ كَلَامُ اللَّهِ الْحُرُوفَ دُونَ الْمَعَانِي وَلَا الْمَعَانِي دُونَ الْحُرُوفِ

আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান এবং তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করার মধ্যে এই বিশ্বাস করাও শামিল যে, কুরআন আল্লাহর কালাম। কুরআন আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল হয়েছে। উহা আল্লাহর কালাম ও সিফাত, মাখলুক নয়। উহা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে এবং আখেরী যামানায়[1] তাঁর দিকেই ফিরে যাবে। কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা প্রকৃতপক্ষেই কথা বলেছেন। এই কুরআন আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল করেছেন। উহা প্রকৃত অর্থেই আল্লাহর কালাম; অন্যের কালাম নয়।[2]

কুরআনের ব্যাপারে এই কথা বলা জায়েয হবেনা যে, এটি কেবল আল্লাহর কালামের বিবরণ অথবা আল্লাহ তাআলার সত্তায় যে কালাম প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তা প্রকাশের মাধ্যম। মানুষ এটি পাঠ করলেই কিংবা কাগজে লিখলেই তা আল্লাহ তাআলার প্রকৃত কালাম হতে বের হয়ে যায়না। কেননা কোন কালাম সর্বপ্রথম যার নিকট থেকে শুরু হয়, ঐ কালামকে তার দিকেই সম্বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে যে উক্ত কালামকে অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়, তার দিকে সেই কালামের সম্বন্ধ হয়না। কুরআনের অক্ষরগুলো এবং অর্থসমূহ আল্লাহ তাআলারই কালাম। কুরআনের মর্মার্থগুলো ব্যতীত শুধু অক্ষরগুলোই যে আল্লাহর কালাম, তা নয় এবং উহার অক্ষরগুলো ছাড়া শুধু মর্মার্থগুলোই যে তাঁর কালাম, তাও নয়; বরং অক্ষরসমূহ এবং মর্মার্থসমূহ মিলেই আল্লাহর কালাম।


ব্যাখ্যা: পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের রূকনসমূহের অন্যতম। ঈমানের এ দু’টি মূলনীতির মধ্যে এই বিশ্বাসও শামিল যে, কুরআন আল্লাহর কালাম। কেননা আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আল্লাহর সুমহান সিফাতগুলোর প্রতি ঈমানকেও শামিল করে। আল্লাহর কালাম তাঁর সুমহান সিফাতসমূহের মধ্যেই গণ্য। কালামকে আল্লাহ তাআলা নিজের দিকে সম্বন্ধিত করেছেন। সিফাতকে তার মাউসুফের দিকে ইযাফাত করার যে নিয়ম রয়েছে, এটি হচ্ছে সেই নিয়মের ইযাফত। আল্লাহর সিফাতসমূহ মাখলুক নয়। সুতরাং আল্লাহর কালামও মাখলুক নয়।

অনেক ফির্কা এই মাসআলায় মতভেদ করেছে। তাদের মতে কুরআন মাখলুক। (নাউযুবিল্লাহ)। যারা কুরআনকে মাখলুক বলে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া তাদের কতিপয়ের মত এই অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।

এক. জাহমীয়াদের মতামতঃ তারা বলে থাকে, আল্লাহ তাআলা কথা বলেন না। তিনি অন্যের মধ্যে কালাম সৃষ্টি করেছেন। সেই কালামকেই তার দিকে সম্বন্ধ করে বর্ণনা করা হয়। তাই তাদের মতে রূপক অর্থে আল্লাহ তাআলার দিকে কালামের সম্বন্ধ করা হয়, প্রকৃত অর্থে নয়। কেননা তিনি কালাম সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তিনি কথা বলেন মানে অন্যের মধ্যে কথা সৃষ্টি করেন।

আল্লাহর কালাম সম্পর্কে এই কথা বাতিল। এই কথা কুরআন ও হাদীছের দলীল বিরোধী এবং মানুষের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা বোধগম্য নয়। সালাফদের কথা এবং মুসলিমদের ইমামগণের মতেরও বিরোধী। কেননা প্রকৃতপক্ষে যে কথা বলতে পারেনা অথবা যার গুণাবলীর মধ্যে ‘কথা বলা’ বিশেষণ নেই, তাকে متكلم (বক্তা) বলা হয়না। সুতরাং কিভাবে এই কথা বলা যেতে পারে যে, قال الله ‘‘আল্লাহ বলেছেন’’, অথচ বাস্তবে উহার প্রবক্তা আল্লাহ তাআলা নন; বরং অন্য কেউ? কিভাবেই বা এটি বলা জায়েয হতে পারে যে, هذا كلام الله ‘‘এটি আল্লাহর কালাম’’, অথচ বাস্তবে উহা অন্যের কালাম; আল্লাহর নয়?!

শাইখুল ইসলাম বলেন, কুরআন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে শুরু হয়েছে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে। কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা প্রকৃতপক্ষেই কথা বলেছেন। তিনি এই কুরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল করেছেন, উহা প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর কালাম; অন্যের কালাম নয়ঃ এই বক্তব্যের মাধ্যমে শাইখের উদ্দেশ্য হচ্ছে, জাহমীয়া ফির্কার প্রতিবাদ করা। তারা বলে, কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে শুরু হয়েছে এবং তিনি কুরআনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে কথা বলেন নি; বরং রূপক অর্থে কুরআনকে আল্লাহর কালাম বলা হয়েছে। অথচ উহা অন্যের কালাম। আল্লাহর দিকে কুরআনকে সম্বন্ধ করার কারণ হলো, উহা আল্লাহর সৃষ্টি।

কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে শুরু হয়েছে, এই কথার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা থেকেই তা বের হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনি এর মাধ্যমে কথা বলেছেন। এখানে مِنْ হরফে জারটি সীমানার শুরু বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

তাঁর দিকেই ফিরে যাবেঃ অর্থাৎ কুরআন পুনরায় আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে। কেননা আখেরী যামানায় কুরআন উঠিয়ে নেয়া হবে। মানুষের অন্তরে কুরআনের কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা এবং কাগজেও লিখা থাকবেনা। এটি কিয়ামতের অন্যতম আলামত।

অথবা কুরআন আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে, -এই কথার অর্থ এও হতে পারে যে, কুরআনকে কেবল আল্লাহর দিকেই সম্বন্ধ করা হবে।

দুই. কুল্লাবিয়া সম্প্রদায়ের মতঃ অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ বিন কুল্লাবের অনুসারী কুল্লাবিয়া সম্প্রদায়ের মতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তারা বলে কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালামের বিবরণ। তাদের মতে, كلام الله هو المعنى القائم في نفسه لازم لذاته كلزوم الحياة والعلم ‘‘আল্লাহর কালাম বলতে এমন মর্মার্থ উদ্দেশ্য, যা আল্লাহর পবিত্র সত্তার সাথে যুক্ত। আল্লাহর হায়াত এবং ইলমের মতই এটি তাঁর সত্তার জন্য আবশ্যক। আল্লাহর কালাম তাঁর ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত নয়।[3] আল্লাহ তাআলার সত্তার মধ্যে এই মর্মার্থটি মাখলুক তথা সৃষ্টি নয়। অক্ষর দ্বারা গঠিত শব্দমালা এবং সেগুলো উচ্চারণের আওয়াজসমূহ সৃষ্টি। এগুলো আল্লাহর কালামের হেকায়াত (বিবরণ); এগুলো হুবহু আল্লাহর কালাম নয়।

তিন. আশায়েরাদের মতঃ আবুল হাসান আলআশআরী[4] (রঃ)এর অনুসারীগণ বলে থাকে, কুরআন আল্লাহর কালাম প্রকাশের এবারাত বা মর্মার্থ ও তাৎপর্য। সুতরাং তাদের মতে আল্লাহর কালাম হচ্ছে এমন এবারত বা মর্মার্থ ও তাৎপর্য, যা আল্লাহর পবিত্র সত্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। আর এই মর্মার্থ ও তাৎপর্য মাখলুক নয়। আমরা যেই শব্দগুলো পাঠ করি, তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সত্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত মর্মাথ ও তাৎপর্যেরই নাম। আমাদের দ্বারা পঠিত শব্দগুলো মাখলুক। এগুলো আল্লাহর কালামের বিবরণ, -এই কথা বলা যাবেনা।

কোন কোন আলেম বলেছেন, কুরআনের ব্যাপারে আশায়েরা এবং কুল্লাবিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ শুধু শাব্দিক। এই মতভেদে কোন লাভ নেই। আশায়েরা এবং কুল্লাবিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বলে থাকে, কুরআন দুই প্রকার। শব্দমালা এবং অর্থসমূহ। কুরআনের শব্দগুলো মাখলুক। কুরআনের মধ্যে যেই শব্দমালা রয়েছে, তা মাখলুক। আর কুরআনের অর্থগুলো কাদীম (অবিনশ্বর ও চিরন্তন) এবং তা আল্লাহ তাআলার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত। সমস্ত কুরআনের সব অর্থ মিলে মূলতঃ একটি অর্থই প্রকাশ করে, তা বিভক্তিযোগ্য নয় এবং একাধিকও নয়। সে যাই হোক, উপরোক্ত মত দু’টি এক রকম না হলেও পরস্পর কাছাকাছি।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই দু’টি মতকেই বাতিল হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ কুরআনের ব্যাপারে এই কথা বলা জায়েয হবেনা যে, এটি কেবল আল্লাহর কালামের বিবরণ। যেমন বলে থাকে কুল্লাবিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা অথবা এই কথাও বলা বৈধ হবেনা যে, উহা আল্লাহর কালাম প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। যেমন বলে থাকে আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকেরা।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ মানুষ এটি পাঠ করলেই কিংবা কাগজে লিখলেই তা আল্লাহ তাআলার প্রকৃত কালাম হতে বের হয়ে যায়না। কুরআন আল্লাহর কালাম। যেখানেই কুরআন পাওয়া যাবে, উহার অক্ষরসমূহ এবং মর্মার্থসমূহ আল্লাহর কালাম বলেই গণ্য হবে। চাই তা মানুষের অন্তরে সংরক্ষিত থাকুক বা জবানের মাধ্যমে তেলাওয়াত করা হোক অথবা কাগজে লিখিত অবস্থায় থাকুক। উপরোক্ত কোন অবস্থাতেই কুরআনকে আল্লাহ তাআলার প্রকৃত কালামের বাইরে গণনা করা যাবেনা।

অতঃপর শাইখুল ইসলাম কুরআন আল্লাহ তাআলার কালামের মধ্যে গণ্য হওয়ার দলীল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ কোন কালাম সর্বপ্রথম যার নিকট থেকে শুরু হয়, উহাকে তার দিকেই সম্বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে যে উক্ত কালামকে অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়, তার দিকে সেই কালামের সম্বন্ধ হয়না। কেননা যে ব্যক্তি মুবাল্লিগ বা প্রচারক হয়ে অন্যের কালাম পৌঁছিয়ে দেয়, তাকে কেবল মাধ্যম বলা হয়। আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবার ৬ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَعْلَمُونَ﴾

‘‘আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে, তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শ্রবণ করা পর্যন্ত আশ্রয় দাও। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দাও৷ কেননা এরা একটি অজ্ঞ সম্প্রদায়’’। এই আয়াতে যেই শ্রবণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা কেবল প্রচারকারীর মাধ্যমেই হতে পারে। অর্থাৎ প্রচারকের নিকট থেকেই,কেবল শ্রবণ করা সম্ভব। আর শ্রুত জিনিষকেই আল্লাহর কালাম হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো যে, কোন কথা সর্বপ্রথম যে বলে, সেই কথাকে তার দিকেই সম্বন্ধ করা হয়।

চার. মুতাযেলাদের মতঃ তারা বলে থাকে, কুরআনের অক্ষরগুলোই শুধু আল্লাহর কালাম। উহার মর্মার্থ ও তাৎপর্য আল্লাহর কালাম নয়। তাই তারা বলে থাকে, সাধারণভাবে যখন এই কথা বলা হবে, ইহা আল্লাহর কালাম, তখন শুধু শব্দ উদ্দেশ্য হবে। যাকে আল্লাহর কালাম বলে নাম দেয়া হয়েছে, তার দ্বারা শুধু শব্দই উদ্দেশ্য হবে, উহার মর্মার্থ কালামের অংশ হবেনা;[5] বরং আল্লাহ তাআলার কালামের শব্দগুলো যা বুঝায়, উহা আল্লাহর কালাম নয়।[6]

অতঃপর শাইখুল ইসলামের উক্তিঃ ولا الحروف دون المعاني উহার অক্ষরগুলো ব্যতীত শুধু মর্মার্থগুলোই আল্লাহর কালাম নয়, -এর মাধ্যমে মুতাযেলাদের মাজহাবের বিপরীত মত বর্ণনা করেছেন। যেমন কুল্লাবীয়া এবং আশায়েরাদের মাজহাব। যেমন একটু পূর্বে ব্যাখ্যাসহ তাদের মাজহাব বর্ণনা করা হয়েছে।সঠিক মাজহাব হচ্ছে, অক্ষর এবং মর্মার্থগুলো সহকারেই কুরআন আল্লাহর কালাম। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত। আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতের দলীল-প্রমাণ দ্বারা ইহাই সুসাব্যস্ত।

[1] - আখেরী যামানায় এক রাতেই কুরআন উঠিয়ে নেয়া হবে। তখন মানুষের অন্তর এবং মুসহাফ থেকে কুরআন উঠে যাবে। তাদের অন্তরে ও মুসহাফে কুরআনের কোন অংশই অবশিষ্ট থাকবেনা। পৃথিবী তখন পাপাচারে ভরে যাবে। এমনকি আল্লাহ আল্লাহ বলার মত কোন লোক থাকবেনা। তখন সেই নিকৃষ্ট লোকদের উপর কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহই সর্বাধিক জানেন।

[2] - কুরআন ছাড়া আরো যেসব আসমানী কিতাব রয়েছে, সেগুলোও আল্লাহ তাআলার কালাম। যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর ইত্যাদি। তাতে যেসব আদেশ-নিষেধ ও হুকুম-আহকাম রয়েছে তাও আল্লাহ তাআলার কালাম। আল্লাহ তাআলার অন্যান্য সিফাতের মতই কথা বলা সিফাতটিও কাদীম (প্রাক্তন, আদি, চিরন্তন ও অবিনশ্বর)। তিনি প্রথম থেকেই এই বিশেষণে বিশেষিত। আর কথা বলা যেহেতু আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত, তিনি যখন ইচ্ছা কথা বলেন, সে হিসেবে আল্লাহর কথাগুলো নিত্য-নতুন হয়। তিনি তুর পাহাড়ে মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছেন, মিরাজের রাত্রিতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলেছেন। কিয়ামতের দিনও আদম (আঃ)এর সাথে কথা বলবেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে রাসূলদের কাছে যেসব কালাম ও কিতাব এসেছে, তাও আল্লাহর কালাম। অতীতে তিনি কথা বলেছেন, এখনো তিনি কথা বলার বিশেষণে বিশেষিত, যখন ইচ্ছা কথা বলেন এবং ভবিষ্যতেও কথা বলবেন। আল্লাহ তাআলার যেমন শুরু ও শেষ নেই, তেমনি তাঁর সিফাতেরও শুরু এবং শেষ নেই। কালামের ব্যাপারটিও সেরকম। আল্লাহ তাআলা সবসময় কথা বলার গুণে গুণান্বিত। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[3] - অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কালাম আল্লাহর নফসের সাথেই যুক্ত আছে। তিনি উহার মাধ্যমে কথা বলেন না। কিন্তু জিবরীল আল্লাহর পক্ষ হতে সেই কালাম হেকায়াত (বর্ণনা) করেন। তারা বলে এই কুরআনও আল্লাহর কালাম নয়; বরং আল্লাহর নফসে যেই কালাম রয়েছে, তার হেকায়াত মাত্র। জিবরীল এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা হেকায়াত করেছে। কুল্লাবিয়ারা আরো বলে, কুরআনের হরফ ও শব্দগুলো সৃষ্টি। কুরআনের অর্থ ও মর্ম সৃষ্টি নয়। তাদের মতে মানুষের হাতে যেই কুরআন রয়েছে, তা আল্লাহর কালাম নয়; অর্থাৎ এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা কথা বলেন নি। তা আল্লাহর নফসে যেই কালাম রয়েছে, তার হেকায়াত মাত্র। কুরআন সম্পর্কে এটিই হচ্ছে কুল্লাবিয়াদের মাজহাব।

[4] - সাহাবী আবু মুসা আশআরী (রাঃ)এর কবীলার দিকে নিসবত করে তাকে আশআরী বলা হয়। এটি ইয়ামানের একটি বিখ্যাত কবীলা। আবুল হাসান আশআরী প্রথমে মুতাযেলী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাওবা করে কুল্লাবীয়াদের মজহাবে প্রবেশ করেন। অতঃপর তিনি কুল্লাবীয়াদের মাজহাবও বর্জন করেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাবে ফিরে আসেন। তাঁর কিতাব ‘ইবানায়’ সুস্পষ্টরূপে তা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আশআরী মাজহাবের লোকেরা তা স্বীকার করেনা।

আশায়েরা মাজহাবের লোকেরা কেবল সাতটি সিফাতকে নামে মাত্র স্বীকার করে। তারা যেই সাতটি সিফাতকে আল্লাহ তাআলার জন্য সাব্যস্ত করে, তা হচ্ছে الْعِلْمُ وَالْقُدْرَةُ وَالْإِرَادَةُ وَالسَّمْعُ وَالْبَصَرُ وَالْكَلَامُ وَالْحَيَاةُ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা, শ্রবণ করা, দেখা, কথা বলা এবং জীবন। বাকীগুলোকে তারা তাবীল বা অস্বীকার করে। এই সাতটি সাব্যস্ত করার কারণ হলো, তারা মনে করে আকল তথা মানুষের বোধশক্তি এগুলো সাব্যস্ত করে; বাকীগুলো নয়। (আল্লাহই সর্বাধিক জানেন)

[5] - যারা কুরআনকে মাখলুক বলবে, তাদের জন্য কঠিন আযাবের হুশিয়ারী ও ধমক এসেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মক্কার কাফের অলীদ বিন মুগীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জবানে কুরআন শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। কুরআন শুনে সে বলতে লাগলঃ আমি কবিদের কবিতা শুনেছি, মানুষের কালাম সম্পর্কে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে, যাদু সম্পর্কেও আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা পাঠ করছেন, তা মানুষের কথা হতেই পারেনা। কাফেররা তার এই কথা শুনে কড়া প্রতিবাদ করলো। তাই সে তার কাফের বন্ধুদের চাপের কারণে কথা পাল্টাতে বাধ্য হলো। কিন্তু সে জানতো যে, কুরআন আল্লাহরই কালাম। যেমন সে প্রথমে স্বীকার করেছিল। কুরআন সেই ঘটনা বর্ণনা করেছে। অলীদ বিন মুগীরা যখন কুরআনকে মানুষের রচিত কথা বলল, তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য কঠিন আযাবের ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ (18) فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ (19) ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ (20) ثُمَّ نَظَرَ (21) ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ (22) ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ (23) فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ (24) إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ (25) سَأُصْلِيهِ سَقَرَ (26) وَمَا أَدْرَاكَ مَا سَقَرُ (27) لَا تُبْقِي وَلَا تَذَرُ (28) لَوَّاحَةٌ لِلْبَشَرِ (29) عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ﴾

‘‘সে চিন্তা -ভাবনা করলো এবং একটা ফন্দি উদ্ভাবনের চেষ্টা করলো। সে অভিশপ্ত হোক! কিভাবে!সে এই কথা উদ্ভাবন করলো? সে আবার অভিশপ্ত হোক, কিভাবে এই কথা অনুমান করলো? অতপর সে মানুষের দিকে চেয়ে দেখলো৷ তারপর ভ্রুকুঞ্চিত করলো এবং চেহারা বিকৃত করলো। অতঃপর সে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলো এবং অহংকার করলো এবং সত্য কবুল করা হতে বিরত থাকলো। অবশেষে বললোঃ এ তো এক চিরাচরিত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এ তো মানুষের কথামাত্র৷ শীঘ্রই আমি তাকে সাকারে (দোযখে) নিক্ষেপ করবো৷ তুমি কি জানো, সে সাকার কী? যা জীবিত ও রাখবেনা আবার একেবারে মেরেও ফেলবেনা। গায়ের চামড়া ঝলসিয়ে দেবে৷ সেখানে নিয়োজিত আছে উনিশজন কর্মচারী’’। (সূরা মুদ্দাছছিরঃ ১৮-৩০)

সুতরাং যারা কুরআনকে আল্লাহর কালাম না বলে মাখলুকের কালাম বলবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কিয়ামতের দিন অলীদ বিন মুগীরার সাথে সাকার নামক জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।

[6] - এটিই হচ্ছে আল্লাহর কালাম সম্পর্কে মুতাযেলাদের কথা। তাদের মতে আল্লাহর এমন কোন কালাম নেই, যা তাঁর যাতের সাথে قائم বা প্রতিষ্ঠিত। বরং আল্লাহর কালাম আল্লাহর অন্যান্য মাখলুকের মতই এবং উহাও অন্যতম সৃষ্টি। যেমন আল্লাহর আসমান, আল্লাহর যমীন, আল্লাহর উটনী, আল্লাহর ঘর ইত্যাদি। আল্লাহর নফসের মধ্যে কোন কালাম কায়েম নেই। আল্লাহ তাআলার কালাম এমন কিছু হরফের নাম, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং উহার নাম রেখেছে ‘কালাম’। যেমন তিনি উটনী সৃষ্টি করেছেন এবং উহার নাম দিয়েছেন আল্লাহর উটনী। তিনি কাবা ঘর সৃষ্টি করেছেন এবং উহার নাম দিয়েছেন বাইতুল্লাহ।

সুতরাং মুতাযেলা ও জাহমীয়াদের নিকট আল্লাহর কালাম হচ্ছে শুধু হরফসমূহের নাম। তাদের মতে আল্লাহর কালাম বলতে এমন কিছু হরফ ও আওয়াজকে বুঝায়, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং উহার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নিজের দিকে সম্বন্ধ করে নাম দিয়েছেন কালামুল্লাহ বা আল্লাহর কালাম। (নাউযুবিল্লাহ)