আল্লাহ তাআলার সিফাতসমূহের প্রতি বিশ্বাস করাও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের অন্তর্ভূক্ত

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

ومن الإيمان بالله الإيمان بما وصف به نفسه في كتابه ووصفه به رسوله محمد صلى الله عليه وسلم من غير تحريف ولا تعطيل ومن غير تكييف ولا تمثيل

আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কিতাবে নিজেকে যেই সুউচ্চ গুণাবলী দ্বারা বিশেষিত করেছেন এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র সুন্নাতে আল্লাহর যেই মহান গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, কোন প্রকার تحريف (পরিবর্তন), تعطيل (অস্বীকার ও বাতিল), تكييف (পদ্ধতি ও ধরণ বর্ণনা) এবং কোন প্রকার تمثيل (উদাহরণ, উপমা ও দৃষ্টান্ত পেশ) করা ব্যতীতই সেগুলোর প্রতি ঈমান আনয়ন করাও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে শামিল।


ব্যাখ্যাঃ যেসব মূলনীতির উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) তা সংক্ষেপে উল্লেখ করার পর এবার সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া শুরু করেছেন। মূলনীতিগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি সর্বাগ্রে প্রথম মূলনীতি অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আনয়নের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে আল্লাহর ঐ সুমহান সিফাতগুলোর প্রতি বিশ্বাস করাও শামিল হবে, যদ্বারা তিনি তাঁর কিতাবে নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা যদ্বারা তাঁর সম্মানিত রাসূল পবিত্র সুন্নাতে তাঁকে গুণান্বিত করেছেন। ঐ সিফাতগুলো আমরা আল্লাহর জন্য ঠিক সেভাবেই সাব্যস্ত করবো, যেভাবে তা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে বর্ণিত হয়েছে। এই সিফাতগুলো যেই শব্দে বর্ণিত হয়েছে এবং সেগুলো যেই অর্থ প্রদান করেছে, তা সহকারেই আমরা আল্লাহর পবিত্র সত্তার জন্য সাব্যস্ত করি। শব্দগুলোর কোন পরিবর্তন করিনা, তার অর্থগুলোও বাদ দেইনা এবং আল্লাহর সুমহান সিফাতগুলোকে আমরা মাখলুকের সিফাতের সাথে তুলনাও করিনা। এগুলো সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে আমরা কেবল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের উপরই নির্ভর করি। কোন অবস্থাতেই আমরা এতে কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত সীমা অতিক্রম করিনা। কেননা আল্লাহর সিফাতগুলো توقيفية তথা অহীর উপর নির্ভরশীল।

التحريف পরিবর্তনঃ তাহরীফ অর্থ হচ্ছে পরিবর্তন করা এবং কোন জিনিষকে তার আসল অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলা। বলা হয় انحرف عن كذا লোকটি এই অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে। এই কথা ঠিক তখনই বলা হয়, যখন লোকটি তার সঠিক অবস্থান থেকে সরে যায়। আল্লাহর সিফাতে তাহরীফ দুইভাবে হতে পারে।
(১) তাহরীফে লাফযী: যে শব্দসমূহের মাধ্যমে আল্লাহর সিফাতগুলো বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে অন্য শব্দ দ্বারা বদল করাকে তাহরীফে লাফযী তথা শাব্দিক পরিবর্তন বলা হয়। এই প্রকার তাহরীফ এক শব্দের সাথে অন্য শব্দ বা অক্ষর যুক্ত করে অথবা অক্ষর কমানোর মাধ্যমে হতে পারে কিংবা শব্দের মধ্যকার অক্ষরের হরকত (জের, যবর ও পেশ) পরিবর্তন করার মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন গোমরাহ সম্প্রদায়ের লোকেরা আল্লাহ তাআলার বাণী: ﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾ ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশে সমুন্নত হয়েছেন’’-এর মধ্যে استوى শব্দকে পরিবর্তন করে استولى বানিয়ে ফেলেছে। আল্লাহর আয়াতের মধ্যে তারা একটি অক্ষর তথা ي এবং واو -এর মাঝখানে লাম অক্ষর বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনি তারা আল্লাহর বাণীঃ وَجَاءَ رَبِّكَ ‘‘এবং তোমার রব আগমণ করবেন’’ -এর মধ্যে একটি শব্দ বাড়িয়ে বলেছে وَجَاءَ أَمْرُ رَبِّكَ ‘‘এবং তোমার রবের আদেশ আগমণ করবে’’। এখানে তারা أمر শব্দটি বাড়িয়ে দিয়ে আল্লাহর ‘আসা’ সিফাতকে আল্লাহর আদেশ আসা দ্বারা পরিবর্তন করে ফেলেছে। এমনি তারা আল্লাহর বাণী:وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا﴾ ﴿ ‘‘আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়’’। (সূরা নিসাঃ ১৪৬) এখানে তারা আল্লাহ তাআলার সুমহান নাম اللهُ শব্দের ها অক্ষরের পেশকে যবর দ্বারা পাঠ করে থাকে। তখন অর্থ দাঁড়ায় যে, আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেন নি; বরং মূসা আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন। অর্থাৎ অহীর মাধ্যমে কথা বলা যে আল্লাহ তাআলার গুণসমূহের অন্যতম একটি গুণ, -এটিকে অস্বীকার করার জন্য তারা পেশকে যবর দ্বারা বদল করার মাধ্যমে আল্লাহর কালামকে মূসার কালামে পরিণত করতে চাচ্ছে।

(২) অর্থগত তাহরীফ: আর দ্বিতীয় প্রকার তাহরীফ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সিফাতসমূহের অর্থকে পরিবর্তন করে ফেলা। যেসব শব্দের মধ্যে আল্লাহর সিফাতের বর্ণনা এসেছে, সেগুলোর আসল অর্থ পরিবর্তন করে অন্য অর্থ প্রদান করাকে تحريف معنوي তথা শব্দগত পরিবর্তন বলা হয়। যেমন الرحمة (দয়া করা) আল্লাহর সিফাতসমূহের অন্যতম একটি সিফাত। কিন্তু বিদআতীরা এটিকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেনা। তারা বলে রহমত অর্থ হচ্ছে নেয়ামত প্রদানের ইচ্ছা করা। এমনি তাদের মতে আল্লাহ তাআলা ক্রোধান্বিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করা।

التعطيل বাতিল ও অচল করা: তা’তীল শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে খালি করা। যেমন বলা হয় عطله অর্থাৎ উহাকে খালী করে দিল। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সিফাতগুলো অস্বীকার করা।

তাহরীফ ও তা’তীলের মধ্যে পার্থক্য হলো কুরআন ও হাদীছের দলীলের মাধ্যমে যেই সঠিক অর্থটি সাব্যস্ত হয়, তা অস্বীকার করে তাকে অন্য একটি ভুল অর্থ দ্বারা বদল করাকে تحريف বলা হয়। আর সঠিক অর্থকে অন্য অর্থ দিয়ে বদল না করে সঠিক অর্থকেই অস্বীকার করার নাম تعطيل। যেমন ‘মুফাওবেযা’ সম্প্রদায়ের লোকেরা করে থাকে। এরা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করে; কিন্তু সেগুলোকে অন্য অর্থ দ্বারা বদল করেনা। সে হিসাবে প্রত্যেক محرف (রদবদলকারীই) معطل (বাতিল কারী); কিন্তু প্রত্যেক বাতিল কারী রদবদলকারী নয়।

التكييف আল্লাহর সিফাতের ধরণ ও কায়া নির্ধারণ করা: যেমন আরবীতে বলা হয় كيف الشيئ সে বস্ত্তটির ধরণ বর্ণনা করল। এই কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন সে বস্ত্তটির জন্য নির্দিষ্ট ও জ্ঞাত ধরণ ও আকার নির্ধারণ করে। আল্লাহর সিফাতের কাইফিয়াত বর্ণনা করার অর্থ হলো উহার জন্য নির্দিষ্ট ধরণ ও কায়া নির্ধারণ করা এবং তার জন্য বিশেষ কোন অবস্থা স্থির করা।

আল্লাহর সিফাতের ধরণ ও কায়া স্থির করা কোন মানুষের জন্য সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহর সিফাতের প্রকৃত অবস্থা ও ধরণ ঐ সব বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত, যার ইলম কেবল আল্লাহ তাআলার কাছেই রয়েছে। মাখলুকের পক্ষে সেই জ্ঞান অর্জন করা অসম্ভব। আল্লাহর সিফাত তাঁর পবিত্র সত্তার অনুগামী। তাই আল্লাহর পবিত্র সত্তার ধরণ সম্পর্কে মারেফত হাসিল করা যেমন সম্ভব নয়, অনুরূপ সিফাতের প্রকৃত রূপ ও ধরণ সম্পর্কে জানাও সৃষ্টির পক্ষে অসম্ভব।

ইমাম মালেক (রঃ) কে যখন الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾ ﴿ ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’ -আল্লাহ তাআলার এই বাণী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো كيف استوى আল্লাহ তাআলা কিভাবে আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন? জবাবে ইমাম মালেক (রঃ) বললেন, الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة ‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়। তার উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিদ্আত।[1] আল্লাহ তাআলার সব সিফাতের ক্ষেত্রে একই বক্তব্য প্রযোজ্য।

التمثيل তামছীল তথা আল্লাহর সিফাতের উপমা ও নমুনা বর্ণনা করাঃ আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে এই কথা বলা যে, আল্লাহর সিফাতগুলো মানুষের সিফাতসমূহের মতই। যেমন কেউ বললঃ আল্লাহর হাত আমাদের হাতের মতই এবং আল্লাহর শ্রবণ আমাদের শ্রবণের মতই। আল্লাহ তাআলা এই ধরণের কথার অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সূরা শুরার ১১ নং আয়াতে বলেনঃ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ ‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। সুতরাং আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবেনা যে, উহা আমাদের সিফাতের অনুরূপ কিংবা আমাদের সিফাতের সাথে তুলনীয় অথবা হুবহু আমাদের সিফাতের মতই। যেমন বলা জায়েয নয় যে, আল্লাহর সত্তা আমাদের সত্তার অনুরূপ অথবা উহা আমাদের সত্তার সাথে তুলনীয়।

সুতরাং তাওহীদপন্থী মুমিনগণ আল্লাহর সকল সিফাত ঠিক সেভাবেই সাব্যস্ত করেন, যেভাবে সাব্যস্ত করলে তাঁর মর্যাদাও বড়ত্বের জন্য শোভনীয় হয়। অপর পক্ষে معطلة (আল্লাহর সিফাতে অবিশ্বাসী) লোকেরা আল্লাহর সকল সিফাতকে অথবা তাঁর কতক সিফাতকে অস্বীকার করে এবং মুশাবেবহা (আল্লাহর সিফাতকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনাকারী) সম্প্রদায়ের লোকরা আল্লাহর সিফাতকে এমনভাবে সাব্যস্ত করে, যা আল্লাহ তাআলার শান ও মর্যাদার সাথে শোভনীয় নয়; বরং তা কেবল মাখলুকের জন্যই প্রযোজ্য হয়।

[1] - অতঃপর সেই বিদআতী লোককে ইমাম মালেক (রঃ)এর নির্দেশে তাঁর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হলো। কেননা এটি এমন প্রশ্ন, যা সালাফে সালেহীনের কোন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে করেন নি।