হজ সফরে সহজ গাইড হজ পরবর্তী কার্যাবলী মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান ১ টি
  • মদীনা সফর করা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে নববী দর্শন করা হজের কোনো অংশ নয় বা হজের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটি হজের কোনো রুকন, ওয়াজিব বা সুন্নাতও নয়। তবে কেউ ইচ্ছা করলে হজের আগে বা পরে মসজিদে নববীতে গিয়ে সালাত আদায় করতে পারেন, সেখানে যাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত করতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মুস্তাহাব কাজ। একটি প্রচলিত হাদীস আছে ‘‘যে হজ করতে এসে আমার কবর জিয়ারতের জন্য এলো না সে আমার সাথে রূঢ় আচরণ করল।’’ এটি সম্পূর্ণ জাল ও মিথ্যা হাদীস।
  • নবীজীর কবর যিয়ারত মূখ্য উদ্দেশ্য মনে নিয়ে মদীনায় যাওয়া ঠিক নয় বা এমনটি করা নিয়ম নয়। মদীনায় যেতে হবে মসজিদে নববী দর্শন ও সালাত আদায় করার নিয়তে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘এবাদত বা প্রার্থনার নিয়তে তিনটি মসজিদ; মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও আল-আকসা মসজিদ ব্যাতীত অন্য কোনো স্থানে সফর করো না’’। শুধু তাই নয় বরং কবর কেন্দ্রিক সকল উরস-উৎসব কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘এবং আমার কবরকে তোমরা উৎসবে পরিণত করো না’’। উৎসবে পরিণত করার অর্থ; কবর কেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যার মধ্যে কবরকে উদ্দেশ্য করে সফর করাও শামিল। কিন্তু সফররত অবস্থায় পথিমধ্যে আপনার কোনো আত্মীয় বা কোনো ওলির কবর সামনে পড়লে তা যিয়ারত করা জায়েয আছে।[1]
  • মদীনায় হোটেল বা ভাড়া বাসায় উঠে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা করে (কাঁচা পেয়াজ, রসুন পরিহার করে) ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে মসজিদে নববী জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ুন। মসজিদে নববীতে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করুন এবং নিম্নোক্ত দো‘আটি পাঠ করুন:

بِسْمِ الله وَالصَّلاةُ وَالسَّلُامُ عَلٰى رَسُوْلِ الله اَللهم افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ

‘‘বিসমিল্লাহি ওয়াস সালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসুলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাফ তাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা’’।

‘‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দিন’’

  • মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে ‘রিয়াদুল জান্নাহ’ বা জান্নাতের বাগান নামক স্থানে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ সালাত আদায় করুন। ওই স্থানে হালকা সবুজ রঙের কার্পেট বিছানো থাকে। এখানে যদি অধিক ভিড় থাকে, তাহলে মসজিদের যে কোনো স্থানে সালাত আদায় করে নিন।
  • রিয়াদুল জান্নায় সহজে প্রবেশ করতে মসজিদে নববীর আস-সালাম গেট (১ নং গেট) দিয়ে প্রবেশ করুন এবং রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওজায় প্রবেশ করতে ঐ একই গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সহজ হয়।
  • এবার শান্ত ও বিনীতভাবে লাইন ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের দিকে একমুখি চলাচলের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যান। কবরে হাতের বামে প্রথমে স্বর্ণালী খাঁচার দরজা অতিক্রম করে পরবর্তী দ্বিতীয় স্বর্ণালী খাঁচার দরজা (বড় গোল চিহ্ন আছে) যে বরাবর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর তার সামনে এলে আদবের সাথে দাঁড়ান। দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলে চলমান অবস্থায়ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন:

اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ اَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ

‘‘আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান নাবীয়ু ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ’’

‘‘হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার ওপর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক’’।

  • পাশাপাশি আপনি চাইলে সালাতের তাশাহুদের পর যে দুরূদ ইবরাহীম পাঠ করেন তা এখানেও এখন পাঠ করতে পারেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করার উত্তম পন্থা হলো দুরূদ ইবরাহীম পাঠ করা। বর্তমানে প্রচলিত অনেক ধরনের বানোয়াটি দুরূদ আছে যা সাহাবাদের থেকে বর্ণনা করা কোনো হাদীসে খুঁজে পাওয়া যায় না সেগুলো পরিহার করাই উত্তম।
  • এবার আপনি সামনে এক গজ মতো এগিয়ে বাম পাশের পরবর্তী স্বর্ণালী খাঁচার দরজা (ছোট গোল চিহ্ন আছে) যেখানে যথাক্রমে আবু বাকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার কবর আছে তার সামনে এলে আদবের সাথে তাদের উদ্দেশ্যে সালাম পেশ করবেন ও তাদের জন্য দো‘আ করুন। তারা যেহেতু কবরবাসী তাই তাদের উদ্দেশ্যে কবরবাসীদের দো‘আ পাঠ করতে পারেন।
  • কবর যিয়ারতের দো‘আ:

اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ، نَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةََ.

‘‘আসসালামু আলাইকুম আহলাদ্দিয়া-রি মিনাল মু’মিনীনা অলমুসলিমীনা, ওয়াইন্না ইনশা-আল্লাহু বিকুম লালা-হিকুন, নাসআলুল্লা-হা লানা ওয়ালাকুমুল ‘আ-ফিয়াহ’’।

‘‘আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, হে কবরবাসী মুমিন-মুসলিমগণ। আমরা (আপনাদের সাথে) মিলিত হব, ইনশাআল্লাহ। আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য আল্লাহর দরবারে পরিত্রাণ কামনা করি”।[2]

  • কবর যিয়ারত শেষে দো‘আ করার বাধ্যগত কোনো নিয়ম নেই। এবার বাকীউল গারকাদ বা বাকী কবরস্থান যিয়ারতে যেতে পারেন। সেখানে শায়িত কবরবাসীর উদ্দেশ্যে আপনার সালাম পৌঁছে দিন বা কবর যিয়ারতের দো‘আ পড়ুন।
  • অনেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের সামনে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে অতিরঞ্জিত কাজ করে ফেলেন যা মোটেই শরী‘আত সম্মত নয়। যেমন; কবরের সামনে গিয়ে একাকী জোরে তাকবীর বলা, বিলাপ করে কান্নাকাটি করা, দুই হাতের আঙুল চিমটির মতো করে চুমু খেয়ে চোখে দিয়ে ফের চুমু খাওয়া, একাকি বা দলবদ্ধ হয়ে কবরের দিকে হাত তুলে দো‘আ করা, খাঁচার দরজা ধরতে চেষ্টা করা বা হাত বুলিয়ে হাতে চুমু খাওয়া ইত্যাদি। অনেকে রীতিমত কবরের সামনে মাথা নিচু করে সম্মান দেখায় বা সিজদায় পড়ে যায় যা সম্পূর্ণ শির্ক করা হয়ে যায়। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের স্বর্ণালী খাঁচার দরজার সামনে বেশ কিছু আরব পুলিশ ও শাইখ/আলেমগন অবস্থান করেন। তারা হাজীদেরকে এসব আবেগতাড়িত কাজ করা থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকেন।
  • দেখুন; আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বা আরো অন্যান্য সাহাবীদের মতো আমরা কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালোবাসতে পারবো বলে মনে হয় না, তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবো তাদের সমপর্যায়ে বা বেশি ভালোবাসতে। ভালোবাসতে গিয়ে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরন করতে গিয়ে আমরা যেন এমন নতুন কোনো কিছু করে না বসি যা আগে কেউ কোনো সাহাবী করেন নি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত বা মৃত থাকা অবস্থায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নিজকে নিয়ে প্রশংসা করা ও তার গুণগান করা এমন পছন্দ করতেন না। সাহাবায়ে কেরাম যতটুকু যা করেছেন, আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে যদি আমরা ততটুকু পালন করতে পারি।
  • আর একটি বিষয়; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর কবরের সামনে গিয়ে সালাম পেশ করা আর ঘরে বসে বা মসজিদের যে কোনো জায়গায় বসে বা হাজার মাইল দূর থেকে সালাম পেশ করা একই সমমান ও মর্যাদার। মদীনায় কবরের সামনে গিয়ে দেওয়া খাস ব্যাপার! এমন বলে কোনো কথা নেই। এসবই মানুষের বানানো অতিভক্তি। অনেকে আবার বলেন, আমার সালামটি মদীনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের কাছে পৌছে দিয়েন! এসব ভিত্তিহীন। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের বাড়িগুলোকে কবর বানিও না এবং আমার কবরকে উৎসবের কেন্দ্রস্থল করো না। আমার প্রতি তোমরা দুরূদ ও সালাম পেশ করো। কেননা (দুনিয়ার) যেখান থেকেই তোমরা দুরূদ পেশ করো তাই আমার কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়”।[3]
  • রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলার একদল ফিরিশতা রয়েছে যারা পৃথিবী জুড়ে বিচরণ করছে। যখনই আমার কোনো উম্মত আমার প্রতি সালাম জানায় ঐ ফিরিশতারা তা আমার কাছে তখন পৌঁছিয়ে দেয়’’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন, ‘‘যে কেউই আমাকে সালাম দেয় তখনই আল্লাহ তা‘আলা আমার রুহকে ফেরত দেন, অতঃপর আমি তার সালামের জবাব দেই”।[4]
  • নারীদের কবর যিয়ারত নিয়ে আলেমগণের মাঝে বিতর্ক আছে। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের লা‘নত করেছেন। পরবর্তীতে এক হাদীসের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে মনে হয়। তাই বিতর্ক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নারীদের জন্য উত্তম হবে কবর যিয়ারতকে উদ্দেশ্য করে কোথাও না যাওয়া; যেহেতু সালাম যে কোনো জায়গা থেকে দেওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে যে কোনো কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কবরবাসীদের সালাম দেওয়া ও দো‘আ করা জায়েয আছে।
  • আরো কয়েকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। যদিও বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়। অনেকে দেখবেন এ ধারণা, বিশ্বাস বা আকীদা পোষণ করেন যে - ১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরি (তিনি মাটির তৈরি মানুষ নন)। ২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হায়াতুন নবী (তিনি জীবিত আছেন, মারা যান নি।)। ৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলায় এ বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে (তাঁকে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি হত না)। ৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েবের খবর রাখেন (তিনি অদৃশ্যের জ্ঞান রাখতেন)। ৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের চারপাশের মাটির মর্যাদা আল্লাহ তা‘আলা আরশের চেয়েও বেশি। ৬. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে শুয়ে এ পৃথিবীর সব কিছু দেখছেন ও খবর রাখছেন এবং প্রয়োজনে তিনি বিভিন্ন পরহেজগার বান্দাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে হাযির হওয়ার ক্ষমতা রাখেন (বিভিন্ন মিলাদ মাহফিলে হাযির হন)। বস্তুত এ সবই পথভ্রষ্টতা ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস। এগুলোর কোনো কোনোটি শির্ক, আবার কোনো কোনোটি মারাত্মক ভুল ও কুসংস্কার।
  • শিক্ষিত, সুবিজ্ঞ ও ঈমান বিষয়ে সচেতন পাঠকমন্ডলীর ওপর এ বিষয়গুলো দলীল ভিত্তিক সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সহ জ্ঞান আহরণ ও বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আল্লাহ তা‘আলার হিদায়াতের ওপর ছেড়ে দিলাম। ‘রাবিব যিদনী ইলমা’।
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৭; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৪৬

[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৭৫

[3] আবু দাউদ, হাদীস নং ২০৪২

[4] নাসাঈ, হাদীস নং ১২৮২