এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘যদি কোনো মানুষের কাছে ‘ইলমুত তাওহীদ’ বা আকীদার খুঁটিনাটি বিষয়ের সুক্ষ্ম তথ্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ে তবে তার দায়িত্ব এই যে, তৎক্ষণাৎ এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট যা সঠিক তাই আমার বিশ্বাস-এরূপ বিশ্বাস পোষণ করবে। এরপর যথাশীঘ্র সম্ভব কোনো আলিমকে জিজ্ঞাসা করে সঠিক তথ্য জেনে নিবে। সঠিক তথ্য জানার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দেরি করা তার জন্য বৈধ নয়। এরূপ বিষয়ে ‘দাঁড়িয়ে থাকা’ বা ‘বিরত থাকা’, অর্থাৎ ‘জানিও না এবং জানবও না বলে থেমে থাকা’, বা ‘কিছুই জানি না কাজেই কিছুই বিশ্বাস করব না’ এরূপ কথা বলা তার জন্য কোনো ওযর বলে গৃহীত হবে না। কেউ যদি এরূপ দাঁড়িয়ে থাকে বা বিরত থাকে তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে।’’

আমরা দেখেছি যে, প্রথম যুগে ইলমুল আকীদাকে ‘‘ইলমুত তাওহীদ’’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। শিরক-কুফর থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য তাওহীদের ইলম বিশদভাবে অর্জন করা মুমিনের জীবনের প্রধান ফরয দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন:


فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ


‘‘কাজেই জান (জ্ঞানার্জন করা) যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্ নেই।’’[1]

তাহলে ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই’’- তাওহীদুল ইবাদাতের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা মুমিনের জীবনের প্রথম ও প্রধান ফরয দায়িত্ব। স্বভাবতই এ জ্ঞান অর্জন করতে হবে ‘ওহী’ অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য পাঠ ও অনুধাবনের মাধ্যমে। তাওহীদের মৌলিক কোনো বিষয় কোনো মুমিনের অজানা থাকতে পারে না। তবে খুঁটিনাটি সুক্ষ্ম কোনো বিষয় হয়ত কারো অজানা থাকতে পারে। উপরের বক্তব্য এরূপ বিষয়ে মুমিনের করণীয় উল্লেখ করেছেন ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)।

আকীদার খুঁটিনাটি সুক্ষ্ম কোনো বিষয় মুমিনের অজানা থাকলে ‘‘আল্লাহর কাছে যেটি সঠিক আমি তাই বিশ্বাস করি’’ বলে দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করতে হবে। অনুমান বা অজ্ঞতার উপর নির্ভর করে তর্ক-বিতর্কে না জড়িয়ে কুরআন-হাদীস নির্দেশিত সত্য সর্বান্তকরণে গ্রহণ করার প্রেরণা-সহ মুমিন ঘোষণা দিবেন যে, এ বিষয়ে আল্লাহর কাছে যা সঠিক তাই আমার বিশ্বাস।

পাশাপাশি কুরআন-হাদীস এ বিষয়ে কী বলে তা জানার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। প্রাজ্ঞ আলিমগণের কাছে প্রশ্ন করে বা তাঁদের লেখা পাঠ করে সে বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জানার বিষয়ে অবহেলা অমার্জনীয় অপরাধ। কারণ তা দুটো বিষয় নির্দেশ করে: (১) বিশুদ্ধ ঈমানী জ্ঞান অর্জনে অবজ্ঞা এবং (২) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈমানের অনুপস্থিতি। এ বিষয়দুটো কুফর-এর নামান্তর।

তাওহীদের বিষয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনে অবহেলার আরেকটি দিক কুরআন-সুন্নাহের নির্দেশনা অনুসন্ধান ও গ্রহণ না করে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), তাঁর সাথীগণ ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী বলেন:


وَلا نَخُوضُ فِي اللَّهِ، وَلا نُمَارِي فِي دِينِ اللَّهِ، وَلا نُجَادِلُ فِي الْقُرْآنِ.


‘‘আমরা আল্লাহর বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হই না। আমরা আল্লাহর দীন নিয়ে বিতর্ক করি না, এবং আমরা কুরআন নিয়ে তর্ক-ঝগড়া করি না।’’[2]

বস্ত্তত তাওহীদ ও আকীদার ভিত্তি ওহীর জ্ঞানের নিকট আত্মসমর্পণ। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা বলেছেন তাই বলা, তাঁরা যা বলেন নি তা না বলা এবং ওহীর অতিরিক্ত কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা বা সমালোচনায় লিপ্ত না হওয়া আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূল বৈশিষ্ট্য।

কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে মুমিনের দায়িত্ব জ্ঞান সন্ধান করা। জ্ঞান সন্ধানে মুমিনের নিজের কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না। তিনি ওহী ও সত্য অনুসন্ধান করেন এবং সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি আলোচনা করেন কিন্তু বিতর্ক করেন না। আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যে পার্থক্য খুবই সুস্পষ্ট। আলোচনাকারী নিজের জ্ঞানের অপূর্ণতার বিষয়ে সচেতন। তিনি সত্য জানতে চান। তিনি প্রশ্ন করেন। উত্তরে তার তৃপ্তি না হলে পুনরায় প্রশ্ন করেন, আলোচনা করেন বা অন্যান্য আলিমের সাথে আলোচনা করেন। সকল ক্ষেত্রে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ওহীর নির্দেশনা সঠিকভাবে জানা।

পক্ষান্তরে বিতর্ককারী নিজের জ্ঞান বা মতকে চূড়ান্ত সত্য বলে গণ্য করে তাকে বিজয়ী করতে ও বিপক্ষের মতকে বাতিল প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। বিতর্কের মধ্যে ‘‘নফসানিয়্যাত’’ বা প্রবৃতির অনুসরণ ও আত্মগরিমা থাকে, আল্লাহর জন্য সত্য অনুসন্ধানের প্রেরণা থাকে না। বিতর্কে পরাজিত হলেও মানুষ সত্য গ্রহণ করে না, বরং পরাজয়কে অস্বীকারের জন্য বা পরাজয়ের গ্লানি মুছার জন্য চেষ্টা করে। দীন নিয়ে বিতর্ক বিভ্রান্ত ও বিদআতী গোষ্ঠীগুলোর বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে ‘আহলুস সুন্নাত’ আন্তরিক ভালবাসা ও সত্যসন্ধানের আগ্রহ-সহ আলোচনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلا أُوتُوا الْجَدَلَ


‘‘কোনো জাতি হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার পরে বিভ্রান্ত হওয়ার একটিই কারণ তা হলো তারা ঝগড়া-বিতর্কে লিপ্ত হয়।’’[3]

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,


مَنْ تَرَكَ الْمِِرَاءَ وَهُوَ مُبْطِلٌ، بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِيْ رَبَضِ الْجَنَّةِ، وَمَنْ تَرَكَهُ وَهُوَ مُحِقٌّ بُنِيَ لَهُ فِيْ وَسَطِهَا، وَمَنْ حَسُنَ خُلُقُهُ بُنِيَ لَهُ فِيْ أَعْلاَهَا


‘‘নিজের মত ভুল বুঝতে পেরে যে বিতর্ক পরিত্যাগ করবে তার জন্য জান্নাতের পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করা হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের মত সঠিক হওয়া সত্ত্বেও বিতর্ক পরিত্যাগ করবে তার জন্য জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে বাড়ি নির্মাণ করা হবে। আর যার আচরণ সুন্দর তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে বাড়ি নির্মাণ করা হবে।’’[4]

[1] সূরা (৪৭) মুহাম্মাদ: ১৯ আয়াত।

[2] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৩।

[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৩৭৮ (কিতাবু তাফসীরিল কুরআন, বাব ৪৪ ওয়া মিন সূরাতিয যুখরুফ)। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।

[4] হাদীসটি সহীহ। মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৭৭; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১৩২।