৫. ২. ৩. কারামাত বিষয়ক অস্পষ্টতা / ৫. ২. ৩. ১. অলৌকিক ক্ষমতার ধারণা

‘‘ওলীগণের কারামত সত্য’’ কথাটির বিষয়ে অনেকের মনে অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তিকর ধারণা বিদ্যমান। সেগুলির মধ্যে রয়েছে:

৫. ২. ৩. ১. অলৌকিক ক্ষমতার ধারণা

অনেকে কারামত অর্থ ‘‘অলৌকিক ক্ষমতা’’ বলে ধারণা করেন। তারা মনে করেন ওলীগণকে আল্লাহ অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন, যে ক্ষমতা তারা ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারেন। আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন জাতির কাফিরগণও এরূপ ধারণা করত। তারা নবী-রাসূলদের কাছে ‘সুলতান’ বা ক্ষমতা এবং আয়াত প্রদর্শনের দাবি করত। তাদের ধারণা ছিল, নবী-রাসূল হলে তাঁর মুজিযা প্রদর্শনের ক্ষমতা থাকতে হবে। কুরআনে এরূপ ধারণা খন্ডন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ‘আয়াত’ প্রদর্শনের ক্ষমতা কোনো নবী-রাসূলের থাকে না, অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি যখন ইচ্ছা করেন তখন নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তা প্রদর্শন করেন। নবী-রাসূলগণ ইচ্ছামত তা প্রদর্শনের ক্ষমতা রাখেন না।

ওলীগণের ‘‘আয়াত’’ বা ‘‘কারামত’’-ও একইরূপ। কোনো ওলী বা নেককার ব্যক্তি কর্তৃক কোনো অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, কর্মটি সম্পাদন করা সে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা তার নিজের ক্ষমতা। এর অর্থ হলো একটি বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক চিহ্ন প্রদান করেছেন। অন্য কোনো সময়ে তা নাও দিতে পারেন।

একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে এক শুক্রবারে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মসজিদে নববীতে খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেন: (يا سارية، الجبلَ) ‘‘হে সারিয়া, পাহাড়ে যাও।’’ সে সময়ে একজন মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবন যুনাইম পারস্যের এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি উমারের এই বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন।[1]

এ ঘটনায় আমরা উমার (রা)-এর একটি কারামত দেখতে পাই। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ‘অবলোকন’ করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন। এ কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এ মহান ওলীকে এ দিনের এ মুহূর্তে এ বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি জনতে পারেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার নিকট পৌঁছে দেন। এর অর্থ এ নয় যে, উমার (রা)-এর হাজার মাইল দূরের কিছু অবলোকন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচছা করলেই দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন।

এ বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর যুলহাজ্জ মাসের ২৭ তারিখে উমার (রা) যখন ফজরের সালাত শুরু করেন, তখন তাঁরই পিছেন চাদর গায়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবূ লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ লু’লু। তিনি বলেন, আল-হামদু লিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের হাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন।[2]

আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা উমারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানান নি। কারণ ‘কারামত’ কখনোই ক্ষমতা নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া সম্মাননা মাত্র।

‘আয়াত’ বা অলৌকিক কর্মকে ‘অলৌকক ক্ষমতা’ মনে করে শিরকে নিপতিত হয়েছে পূর্ববর্তী অনেক জাতি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃস্টানগণ। ঈসা মাসীহ (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিতে। কিন্তু খৃস্টানগণ একে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে ধারণা করে শিরকে নিপতিত হন। তারা দাবি করেন যে, ‘মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই, যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যীশু ঈশ্বর বা তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল। বস্ত্তত মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনোরূপ ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ আছে বলে বিশ্বাস করা শির্ক।

[1] তাবারী, তারীখ ২/৫৫৩-৫৫৪; বাইহাকী, আল-ই’তিকাদ,পৃ. ৩১৪; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৩/৫-৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৬৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫১৪-৫১৫।

[2] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৭/১৩০-১৩৮।