আমরা দেখছি যে, সাহাবীগণের বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের আকীদা আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী ‘সালাফ সালিহীন’ বা পূর্ববর্তী নেককারগণ ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তী আলিম-বুজুর্গগণ বিষয়ক আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন।

এ বিষয়ক উগ্রতা তাঁর যুগে যেমন ব্যাপক ছিল, বর্তমান যুগেও তেমনি। আমরা দেখেছি যে, শীয়াগণ ভক্তির নামে আলী-বংশের ইমামগণ, তাঁদের খলীফাগণ এবং শীয়া সমাজের অগণিত আলিম, ইমাম ও পীরকে নির্ভুল, নিষ্পাপ, মাসূম বা ‘‘অভ্রান্ত’’ বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের কথা, কর্ম বা মতকেই দীনের জন্য চূড়ান্ত বলে গণ্য করেছেন এবং সেগুলোর ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য অস্বীকার, অমান্য বা ব্যাখ্যা ও বাতিল করেছেন। এভাবে তাঁদেরকে তারা নুবুওয়াতের মর্যাদায় সমাসীন করেছেন। পাশাপাশি সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ, চার ইমাম ও মূলধারার সকল আলিম-বুজুর্গর চরিত্র হরণ ও বিদ্বেষ প্রচারে বিভিন্ন প্রকারের জালিয়াতি ও নোংরামির আশ্রয় নিয়েছেন।

অপরদিকে খারিজীগণ এবং তাদের পাশাপাশি মুতাযিলা ও অন্যান্য বিভ্রান্ত ফিরকা পূর্ববর্তী আলিমগণের ইলম, ইজতিহাদ, জ্ঞান ও মতের গুরুত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তারা তাঁদের বিষয়ে কটূক্তি করেছেন। পূর্ববর্তী আলিমগণ কেউ বা তাদের মধ্যকার অমুক-তমুক ইসলাম মোটেও বুঝেন নি, অজ্ঞ ছিলেন, দালাল বা দুনিয়ামুখি ছিলেন ইত্যাদি অশালীন ও নোংরা মন্তব্য তারা করেছে।

এ দুটি বিভ্রান্ত ধারার পাশাপাশি ‘‘আহলুস সুন্নাত’’-এর হাদীসপন্থী ও ফিকহপন্থী নামধারীদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের বিষয়ে অশালীন মন্তব্য করা শুরু হয়। হাদীসপন্থীরা ফকীহদের বিষয়ে ঢালাওভাবে এবং কখনো কখনো বিশেষ কোনো ফকীহ, মুজতাহিদ বা ইমামের বিষয়ে ‘‘হাদীস-বিরোধী’’, ‘‘অজ্ঞ’’ ইত্যাদি মন্তব্য করতেন। এর বিপরীতে ফিকহপন্থী বা ফিকহ অনুসারীগণ মুহাদ্দিসদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে বা কোনো কোনো মুহাদ্দিসের বিষয়ে ‘‘প্রজ্ঞাহীন মুখস্তকারী’’, ‘‘নির্বোধ’’, ‘‘তোতাপাখি’’ ইত্যাদি মন্তব্য করতেন। এ প্রেক্ষাপটে কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত সঠিক পথ নির্দেশনার জন্য ইমাম তাহাবী ইমাম আবূ হানীফার আকীদা উল্লেখ করে বলেন যে, উম্মাতের পূর্ববর্তী আলিম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজতাহিদ, ইমাম সকলকেই সম্মান ও প্রশংসার সাথে স্মরণ করতে হবে।

বস্ত্তত সাধারণ মানুষ, এমনকি আলিম ও প্রাজ্ঞ মানুষেরাও মর্যাদার বিষয়ে বিশেষ প্রান্তিকতায় আক্রান্ত। তাঁরা মনে করেন যে, কাউকে সম্মান বা মর্যাদার আসনে বসানোর অর্থ তার সবকিছুকে সঠিক বলে গ্রহণ করা। অথবা মনে করা হয় যে, কারো কর্ম, মত বা কথার বিরোধিতা করার অর্থ তাকে অবমূল্যায়ন করা। কখনো মনে করা হয়, কারো মত বা কর্মে কিছু ভুল থাকার অর্থই তার অগ্রহণযোগ্যতা।

কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা ও সাহাবীগণের কর্মধারা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। নবীগণ ছাড়া কেউ মাসূম, অভ্রান্ত বা নির্ভুল নন। ভুলের কারণে কোনো মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বা বুজুর্গি নষ্ট হয় না। তেমনি কারো বেলায়াত বা বুজুর্গির কারণে তাঁর ভুলগুলি সঠিকে পরিণত হয় না। সাহাবীগণ, প্রসিদ্ধ ইমামগণ ও পরবর্তী প্রসিদ্ধ আলিমগণ অনেক সাহাবী-তাবিয়ীর অনেক মত গ্রহণ করেন নি বা বিরোধিতা করেছেন। কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী মোজার উপর মাস্হ করা সর্বাবস্থায় নিষেধ করেছেন, কেউ মোজাবিহীন পা মাস্হ করেছেন, কেউ তিনবার মাথা মাস্হ করেছেন, কেউ সালাত-রত অবস্থায় মুসাফাহা করেছেন, কেউ রুকুর মধ্যে দু হাটুর মধ্যে হাত রেখেছেন...।[1] এ সকল ক্ষেত্রে সুন্নাতে নববীর বিপরীতে দু-একজন সাহাবী বা তাবিয়ীর কর্ম, মত বা কথা তাঁরা গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কখনোই কোনোভাবে তাঁরা বিরূপ মন্তব্য করেন নি। বরং তাঁদের প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান ও ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। মুজতাহিদ তার সঠিক ইজতিহাদের জন্য দুটি সাওয়াব এবং ভুল ইজতিহাদের কারণে একটি সাওয়াব লাভ করেন।[2] তাঁর ভুল ইজতিহাদের কারণে তিনি অপরাধী হন না। কুরআন-সুন্নাহের আলোকে পূর্ববর্তী আলিমগণের মত আলোচনা, পর্যালোচনা, গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার পরবর্তী আলিমগণের রয়েছে। কিন্তু তাঁদের কারো কোনো বক্তব্য, কর্ম বা ভুল ইজতিহাদের জন্য তাঁদের প্রতি বিরূপ ধারণা বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। ইমাম তাহাবী সে বিষয়টিই উল্লেখ করেছেন।

এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

প্রথমত: আলিমের গ্রহণযোগ্যতার জন্য নির্ভুল হওয়া শর্ত নয়; কারণ নবীগণ ছাড়া কেউ মাসূম নন। একজন প্রসিদ্ধ আলিমকে প্রশ্ন করা হয়, অমুক ব্যক্তি আলিম হয়ে কিভাবে সুন্নাতের বিরোধিতা করলেন? কিভাবে এরূপ ভুল করলেন? কিভাবে এ বিষয়টি জানলেন না বা বুঝতে পারলেন না? উত্তরে তিনি বলেন: ‘‘যেন আলিমগণ নবীগণের মত না হন সেজন্যই আল্লাহ এ ব্যবস্থা করেছেন।’’

দ্বিতীয়ত: আলিমগণের মর্যাদা কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত। আলিমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। হাদীস, ফিকহ ও কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সকল প্রকার ইলমই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কাজেই সকল আলিমকে শ্রদ্ধা করা ও ভালবাসা মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। আকীদাহ তাহাবিয়্যার ব্যাখ্যাকারগণ, ইবন আবিল ইয্য হানাফী, সালিহ আল-ফাওযান, সালিহ ইবন আব্দুল আযীয আল-শাইখ ও অন্যান্য আলিম উল্লেখ করেছেন যে, এখানে ইমাম তাহাবী প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ সকল মুহাদ্দিস ও ফকীহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। তাঁদের কারো ইজতিহাদী ভুলের জন্য বিরূপ মন্তব্য করা, তাঁদের মর্যাদাহানি বা অবমূল্যায়নের উদ্দেশ্যে তাঁদের ভুলগুলি সংকলন বা প্রচার করা ইত্যাদি সবই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও সালফ সালিহীনের মত ও পথের সাথে সাংঘর্ষিক।

তৃতীয়ত: তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও ইসলামী জ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রসিদ্ধ আলিমগণের মাধ্যমেই উম্মাতের সাধারণ মানুষ দীন লাভ করেছেন। তাঁদের প্রতি বিরূপ ধারণা, মন্তব্য ও অশ্রদ্ধা সাধারণ মানুষের মনোজগতে দীনী ইলম চর্চায়-রত আলিমগণের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়, দীনের বিষয়ে তাঁদেরকে প্রশ্ন করতেও তারা উৎসাহ পায় না এবং ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নিপতিত হয়। শাইখ সালিহ ইবন আব্দুল আযীয আল-শাইখ বলেন: ‘‘আলিমগণের বিষয়ে খারাপ মন্তব্য মূলত সাহাবীদের বিষয়ে খারাপ মন্তব্যের মতই। আর এজন্যই ইমাম তাহাবী সাহাবীদের পরে আলিমগণের কথা উল্লেখ করেছেন। সাহাবীদের বিষয়ে কু-ধারণা বা খারাপ মন্তব্য দীনের বিশুদ্ধতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। তেমনি প্রাজ্ঞ, প্রসিদ্ধ নেককার আলিম, ইমাম, ফকীহ, মুজতাহিদ বা মুহাদ্দিসগণের ইজতিহাদী ভুলভ্রান্তির কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য বা কু-ধারণাও দীন ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।[3]

ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশসহ সমালোচনা ইসলাম সম্মত। কিন্তু বর্তমানে আমরা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে আলিমদের চরিত্রহননে লিপ্ত। এতে প্রত্যেক দলের অনুসারীরা খুশি হচ্ছেন। কিন্তু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ও যুব সমাজ কোনো ধর্মীয় দলের অনুসারী না। তারা এতটুকুই বুঝছেন যে, আলিমরা অজ্ঞ, অসৎ ও অযোগ্য। ধর্মীয়, সামাজিক বা নৈতিক কোনো বিষয়ে তাঁদের সাথে কথা বলে লাভ নেই। খৃস্টান মিশনারি, কাদিয়ানী, বাহায়ী, নাস্তিক ও অন্যান্যরা এ বিষয়টি খুব ভালভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।

সম্মানিত পাঠক, আমরা দেখেছি, পূর্ববর্তীদের প্রতি পরবর্তীদের দায়িত্ব বর্ণনা করে আল্লাহ বলেছেন: ‘‘যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের যে সকল ভাই আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছেন তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মু’মিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু’।’’[4]

মহান আল্লাহ আমাদেরকে এভাবে পূর্ববর্তী আলিম-বুজুর্গদের জন্য দুআ করার এবং পূর্ববর্তী ও সমকালীন সকল আলিম ও মুমিনকে ভালবাসার এবং তাদের প্রতি অতিভক্তি ও বিদ্বেষ থেকে হৃদয়কে পবিত্র করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

[1] দেখুন: আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী, আল-মুসানণাফ ১/১৮-২৮, ১৯১-১৯৯; ইবনু আবী শাইবা, আল- মুসানণাফ ১/২৫-২৭; ১৬৯-১৭০, ২২২-২২৫; ৪১৮-৪১৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ২/৩০৫-৩০৯; মোললা আলী কারী, শারহুল ফিকহুল আকবার, পৃ: ১০৬, ৩০৪; ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ১০৫-১০৭।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫২ (কিতাবুল ইতিসাম, বাবু আজরিল হাকিমি ইযাজতাহাদা) মুসলিম, আস-সহীহ ৫/১৩১-১৩২ (কিতাবুল আকদিয়া, বাবু বায়ানি আজরিল হাকিমি ...)

[3] সালিহ ইবনু আব্দুল আযীয আল-শাইখ, ইতহাফুস সায়িল বিমা ফিল আকিদাতি তাহাবিয়্যা, ৪৫/২১।

[4] সূরা (৫৯) হাশর: ১০ আয়াত।