আল-ফিকহুল আকবর মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
তাবি-তাবিয়ী ইমাম সুফইয়ান ইবন উআইনা (১০৭-১৯৮ হি) ও ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম প্রধান ছাত্র প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান শাইবানী (১৮৯ হি) বলেন

প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ইমাম সুফইয়ান ইবন উআইনা (১০৭-১৯৮ হি) বলেন:


كل ما وصف الله به نفسه في القرآن فقراءته تفسيره، لا كيف ولا مثل


‘‘আল্লাহ কুরআনে নিজের বিষয়ে যে সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তার পাঠই তার ব্যাখ্যা কোনো ‘কাইফ’ (স্বরূপ) নেই এবং কোনো ‘মিসল’ (তুলনা) নেই।’’[1]

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ ফকীহ ইমাম আওযায়ী আব্দুর রাহমান ইবন আমর (১৫৭ হি) বলেন:


كنا والتابعون متوافرون نقول إن الله على عرشه ونؤمن بما وردت به السنة من صفاته


‘‘যে সময়ে তাবিয়ীগণ বহু সংখ্যায় বিদ্যমান ছিলেন সে সময়ে আমরা বলতাম: মহান আল্লাহ তাঁর আরশের উপরে এবং সুন্নাতে (হাদীসে) মহান আল্লাহর যা কিছু বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে তা আমার বিশ্বাস করি।’’[2]

প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ওয়ালীদ ইবন মুসলিম (১৯৫ হি) বলেন:


سألت الأوزاعي ومالكا والثوري والليث بن سعد عن الأحاديث التي فيها الصفة فقالوا أمِرُّوهَا كما جاءت بلا كيف


‘‘ইমাম আওযায়ী (১৫৭ হি), ইমাম মালিক ইবন আনাস (১৭৯ হি), ইমাম সুফিয়ান সাওরী এবং ইমাম লাইস ইবন সা’দ (১৭৫ হি )-কে আমি মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক হাদীসগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তখন তাঁরা বলেন: এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নাও; কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে।’’[3]

মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক মূলনীতি ব্যাখ্যা করে ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাষ্য ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ গ্রন্থে ইমাম আযম বলেন:


لاَ يُوْصَفُ اللهُ تَعَالَى بِصِفَاتِ الْمَخْلُوْقِيْنَ. وَغَضَبُهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِهِ بِلاَ كَيْفٍ، وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ. وَهُوَ يَغْضِبُ وَيَرْضَى وَلاَ يُقَالُ: غَضَبُهُ عُقُوْبَتُهُ وَرِضَاهُ ثَوَابُهُ. وَنَصِفُهُ كَمَا وَصَفَ نَفْسَهُ أَحَدٌ صَمَدٌ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ حَيٌّ قَيُّوْمٌ قَادِرٌ سَمِيْعٌ بَصِيْرٌ عَالِمٌ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ لَيْسَتْ كَأَيْدِيْ خَلْقِهِ وَلَيْسَتْ جَارِحَةٌ وَهُوَ خَالِقُ الأَيْدِيْ وَوَجْهُهُ لَيْسَ كَوُجُوْهِ خَلْقِهِ وَهُوَ خَالِقُ كُلِّ الْوُجُوْهِ وَنَفْسُهُ لَيْسَتْ كَنَفْسِ خَلْقِهِ وَهُوَ خَالِقُ كُلِّ النُّفُوْسِ: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ


‘‘মহান আল্লাহ সৃষ্টির বিশেষণে বিশেষায়িত হন না। তাঁর ক্রোধ ও সন্তুষ্টি তাঁর বিশেষণসমূহের দুটি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ নির্ণয় ছাড়া। এটিই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর মত। মহান আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর ক্রোধ অর্থ তাঁর শাস্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্থ তাঁর পুরস্কার। আল্লাহ নিজে নিজেকে যেরূপে বিশেষিত করেছেন আমরাও তাঁকে সেভাবেই বিশেষিত করি। তিনি একক, অমুখাপেক্ষী, তিনি কারো জন্ম দেন নি, তিনি জন্মপ্রাপ্ত নন, কেউ তাঁর তুলনীয় নয়। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসংরক্ষক, ক্ষমতাবান, শ্রবণকারী, দর্শনকারী, জ্ঞানী, আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর, তাঁর হাত তাঁর সৃষ্টির হাতের মত নয়; তা অঙ্গ নয়; তিনি হস্তসমূহের স্রষ্টা। তাঁর মুখমণ্ডল তাঁর সৃষ্টির মুখমণ্ডলের মত নয়; তিনি সকল মুখমণ্ডলের স্রষ্টা। তাঁর নফস তাঁর সৃষ্টির নফসের মত নয়, তিনি সকল নফসের স্রষ্টা। (আল্লাহ বলেন[4]) ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, এবং তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[5]

এখানে তিনি তিনটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন:

(১) মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোর অতুলনীয়ত্বে বিশ্বাস করতে হবে।

(২) মহান আল্লাহ নিজের বিষয়ে যে সকল শব্দ, বাক্য, কর্ম বা বিশেষণ ব্যবহার করেছেন মুমিনের দায়িত্ব সেগুলো সর্বান্তকরণে গ্রহণ, বিশ্বাস ও ব্যবহার করা।

(৩) তাঁর বিশেষণ রূপক অর্থে ব্যবহৃত বলে দাবি করা বা ব্যাখ্যা করা যাবে না।

মহান আল্লাহর বিশেষণ ব্যাখ্যায় কিছু বলার অর্থ মহান আল্লাহ সম্পর্কে মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি বা ইজতিহাদ দিয়ে কিছু বলা। আর মহান আল্লাহর বিষয়ে ইজতিহাদ করে কিছু বলা যাবে না। এজন্য ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:


لا ينبغي لأحد أن ينطق في الله تعالى بشئ من ذاته، ولكن يصفه بما وصف سبحانه به نفسه، ولا يقول فيه برأيه شيئاً تبارك الله تعالى رب العالمين.


‘‘মহান আল্লাহর বিষয়ে নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা কারো জন্য বৈধ নয়; বরং তিনি নিজের জন্য যে বিশেষণ ব্যবহার করেছেন তাঁর বিষয়ে শুধু সে বিশেষণই ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়ে নিজের মত, যুক্তি বা ইজতিহাদ দিয়ে কিছুই বলা যাবে না। মহাপবিত্র, মহাসম্মানিত-মহাকল্যাণময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক।’’[6]

ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম প্রধান ছাত্র প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান শাইবানী (১৮৯ হি) বলেন:


اتفق الفقهاء كلهم من المشرق إلى المغرب على الإيمان بالقرآن والأحاديث التي جاء بها الثقات عن رسول الله ﷺ في صفة الرب عز وجل من غير تغيير ولا وصف ولا تشبيه فمن فسر اليوم شيئا من ذلك فقد خرج مما كان عليه النبي ﷺ وفارق الجماعة فإنهم لم يصفوا ولم يفسروا ولكن أفتوا بما في الكتاب والسنة ثم سكتوا فمن قال بقول جهم فقد فارق الجماعة؛ لأنه قد وصفه بصفة لا شيء.


‘‘পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল দেশের ফকীহগণ সকলেই একমত যে, মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে, কোনোরূপ পরিবর্তন, বিশেষায়ন এবং তুলনা ব্যতিরেকে। যদি কেউ বর্তমানে সেগুলোর কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করে তবে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পথ ও পদ্ধতি পরিত্যাগকারী এবং উম্মাতের পূর্বসূরীদের ইজমার (ঐকমত্যের) বিরোধিতায় লিপ্ত। কারণ তাঁরা এগুলোকে বিশেষায়িত করেন নি এবং ব্যাখ্যাও করেন নি। বরং তাঁরা কুরআন ও সুন্নাতে যা বিদ্যমান তার ভিত্তিতে ফাতওয়া দিয়েছেন এবং এরপর নীরব থেকেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি জাহম-এর মত গ্রহণ করবে সে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ঐকমত্যের পথ পরিত্যাগ করবে; কারণ সে মহান আল্লাহকে নেতিবাচক ও অবিদ্যমানতার বিশেষণে বিশেষিত করে।’’[7]

[1] দারাকুতনী, আস-সিফাত, পৃ ৭০; বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত ২/১১৭।

[2] বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃষ্ঠা, ৫১৫; ইবন হাজার, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৬।

[3] ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৭।

[4] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।

[5] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫৭।

[6] সায়িদ ইবন মুহাম্মাদ, আল-ই’তিকাদ, পৃ, ৮৭-৮৯।

[7] সায়িদ নাইসাপূরী, আল-ই’তিকাদ, পৃ, ১৭০; লালকায়ী, ই’তিকাদ ৩/৪৩২; যাহাবী, আল-উলূ, পৃ ১৫৩।