আল-ফিকহুল আকবর আল-ফিকহুল আকবারের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

মহান আল্লাহ বলেন:


وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ


‘‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।’’[1]

এ থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের একাধিক পর্যায় রয়েছে, এক পর্যায়ে ঈমানের সাথে সাথে শিরক্ একত্রিত হতে পারে। এর ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো।[2]

এ ভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের অন্তত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং কাফিরগণ একটি বিশ্বাস করতো এবং একটি অস্বীকার করত। কুরআন কারীমের এজাতীয় অগণিত নির্দেশনা ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের এ সকল তাফসীরের আলোকে পরবর্তী যুগের আলিমগণ ‘তাওহীদ’-কে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফাই প্রথম তাওহীদকে (১) রুবূবিয়্যাত (প্রতিপালন) ও (২) উলূহিয়্যাত (উপাসনা) দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। পরবর্তী অধিকাংশ আকীদাবিদ এ বিষয়ে তাঁর অনুসরণ করেন। আল-ফিকহুল আবসাত গ্রন্থে তিনি বলেন:


وَاللهُ تَعَالَى يُدْعَى مِنْ أَعْلَى لاَ مِنْ أَسْفَلَ لَيْسَ مِنْ وَصْفِ الرُّبُوْبِيَّةِ وَالأُلُوْهِيَّةِ فِيْ شَيْءٍ


‘‘মহান আল্লাহকে ডাকতে হয় ঊর্ধ্বে, নিম্নে নয়। নিম্নে থাকা রুবূবিয়্যাত (রবব হওয়ার) এবং উলূহিয়্যাতের (উপাস্য হওয়ার) কোনো বিশেষত্ব নয়।’’[3]

কেউ কেউ দুটি পর্যায়কে আরো বিস্তারিতভাবে তিনটি বা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা সাদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ইয্য দিমাশকী (৭৩১-৭৯২ হি) তাঁর রচিত ‘শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তকে তাওহীদকে প্রথমত দু পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা’রিফাহ (توحيد الإثبات والمعرفة) বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ এবং (২) তাওহীদুত তালাবি ওয়াল কাসদি (توحيد الطلب والقصد) বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।[4] অন্যত্র তিনি উক্ত প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত, (২) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত ও (৩) তাওহীদুল ইলাহিয়্যাহ।[5]

প্রসিদ্ধ ভারতীয় আলিম ও সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (১১৭৬ হি) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেন এবং এভাবে তিনি তাওহীদকে চার পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:

(১) আল্লাহকে একমাত্র অনাদি অনন্ত সত্তা বলে বিশ্বাস করা।

(২) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করা।

(৩) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্বাস করা।

(৪) আল্লাহকে একমাত্র মা‘বুদ বা উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করা।[6]

এভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের মূলত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং প্রথম পর্যায়টির একাধিক পর্যায় রয়েছে। এগুলি অনুধাবন করা ঈমানের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য, অন্যথায় ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত হয়ে যেতে পারে। আমরা এখন এ পর্যায়গুলো বুঝতে চেষ্টা করব, ইনশা আল্লাহ।

[1] সূরা (১২) ইউসূফ: ১০৬ আয়াত।

[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৯।

[3] ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫০-৫১।

[4] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৯।

[5] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৮।

[6] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৬।