আল-ফিকহুল আকবর আল-ফিকহুল আকবার ও ইসলামী আকীদা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ইসলামী ধর্ম-বিশ্বাস। বিশ্বাস বুঝাতে কুরআন-হাদীসে ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহৃত। তাবিয়ীগণের যুগ থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোর অন্যতম:

(১) আল-ফিকহুল আকবার: শ্রেষ্ঠতম ফিকহ। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) আকীদা বিষয়ে রচিত তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম রেখেছেন ‘আল-ফিকহুল আকবার’। সম্ভবত ‘আকীদা’ বুঝাতে এটিই প্রাচীনতম পরিভাষা।

(২) ইলমুত তাওহীদ: একত্ববাদের জ্ঞান বা তাওহীদ শাস্ত্র। ‘তাওহীদ’ অর্থ একত্ব বা মহান আল্লাহর একত্বের বিশ্বাস। ইসলামী ঈমান বা বিশ্বাসকে ‘তাওহীদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ বিষয়ক জ্ঞানকে ‘ইলমুত তাওহীদ’ বা তাওহীদের জ্ঞান বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফা আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থে ‘ইলমুল আকীদা’-কে ‘ইলমুত তাওহীদ’ নামে অভিহিত করেছেন। এ পরিভাষাটিও দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে বিশেষ পরিচিত লাভ করে।

(৩) আস-সুন্নাহ। ‘সুন্নাত’ বা ‘সুন্নাহ’ শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ‘সুন্নাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ: মুখ, ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তে ‘সুন্নাত’ অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা, কর্ম, অনুমোদন বা এক কথায় তাঁর সামগ্রিক জীবনাদর্শ।[1] আমরা দেখব যে, ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসে বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে বিশ্বাসের বিষয়ে সুন্নাত বর্জন করে যুক্তির উপর নির্ভর করার কারণে। এজন্য বিশ্বাসের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের মূলনীতি আলোচনা করতে তৃতীয় শতাব্দী থেকে অনেক আলিম ‘আস-সুন্নাহ’ নামে ‘আকীদা’ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এদের অন্যতম ছিলেন ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল (২৪১ হি)। তাঁর পর অনেক প্রসিদ্ধ আলিম ‘আস-সুন্নাহ’ নামে আকীদা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন।

(৪) আশ-শারী‘আহ। ‘শারীয়াত’ বা ‘শারী‘আহ’ অর্থ নদীর ঘাট, জলাশয়ে পানি পানের স্থান, পথ ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ‘শারী‘আহ’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে একটি অর্থ ‘‘ধর্ম বিশ্বাস’’ বা বিশ্বাস বিষয়ক মূলনীতিসমূহ।[2] তৃতীয় শতকের কোনো কোনো ইমাম ‘‘আশ-শারী‘আহ’’ নামে আকীদা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন।

(৫) উসূলুদ্দীন বা উসূলুদ্দিয়ানাহ: দীনের ভিত্তিসমূহ। চতুর্থ শতক থেকে কোনো কোনো আলিম আকীদা বুঝাতে এ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন।

(৬) আকীদা। ধর্ম-বিশ্বাস বিষয়ক প্রসিদ্ধতম পরিভাষা ‘আকীদা’। আকীদা ও ই’তিকাদ শব্দদ্বয় আরবী ‘আক্দ (عقد) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। ভাষাবিদ ইবন ফারিস এ শব্দের অর্থ বর্ণনা করে বলেন: ‘‘শব্দটির মূল অর্থ একটিই: দৃঢ় করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহীত।[3]

‘বিশ্বাস’ বা ধর্মবিশ্বাস অর্থে ‘আকীদা’ ও ‘ই’তিকাদ’ শব্দের ব্যবহার কুরআন ও হাদীসে দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে বা তাঁর পূর্বের যুগে আরবী ভাষায় ‘বিশ্বাস’ অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে ‘আকীদা’ শব্দের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় না। তবে ‘দৃঢ় হওয়া’ বা ‘জমাট হওয়া’ অর্থে ‘ই’তিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শক্ত বিশ্বাস বা ধর্ম-বিশ্বাস বুঝাতে আকীদা শব্দের ব্যবহার পরবর্তী যুগগুলিতে ব্যাপক হলেও প্রাচীন আরবী ভাষায় এ ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। ‘আকীদা’ শব্দটিই কুরআন, হাদীস ও প্রাচীন আরবী অভিধানে পাওয়া যায় না। হিজরী চতুর্থ শতকের আগে এ শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় না। চতুর্থ হিজরী শতক থেকে এ পরিভাষাটি প্রচলন লাভ করে। পরবর্তী যুগে এটিই একমাত্র পরিভাষায় পরিণত হয়।

(৭) ইলমুল কালাম: কথাশাস্ত্র। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক আলোচনা বা গবেষণাকে অনেক সময় ‘ইলমুল কালাম’ বলা হয়। ইলমুল আকীদা ও ইলমুল কালাম- এর পার্থক্য বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।[4]

[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃষ্ঠা ২৯-৫০।

[2] আল-ফাইঊমী, আল-মিসবাহুল মুনীর ১/৩১০; মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-হামদ, আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ, পৃ. ১৬-১৭

[3] ইবন ফারিস, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৪/৮৬।

[4] উপরের পরিভাষাগুলো বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ২১-৩২।