আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

ইবন মান্দাহ এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করেছেন। যয়ীফ হাদীসকে কিয়াসের উপর অগ্রগণ্য করা থেকে কেউ হয়ত বুঝেন যে, ইমাম আবূ হানীফা হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে ঢিলেমি করতেন। বিষয়টি ঠিক উল্টো। তিনি হাদীসের সনদ যাচাইয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। যে বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই সে বিষয়ে সামান্য দুর্বল ‘‘হাসান’’ বা ‘‘মুরসাল’’ হাদীস তিনি এবং সে যুগের সকল ফকীহই গ্রহণ করতেন। যে হাদীস ‘‘সহীহ’’ হাদীসের ৫টি শর্তই পূরণ করে, কিন্তু বর্ণনাকারীর স্মৃতি ও নির্ভুল বর্ণনা শক্তির কিছু দুর্বলতা ছিল, এরূপ হাদীসকে ‘‘হাসান’’ বলা হয়। তৃতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘‘হাসান’’ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হতো না। সহীহ হাদীসের শর্ত পূরণ করে না এরূপ সকল হাদীসকেই ‘‘যয়ীফ’’ বলা হতো। এজন্য ‘‘হাসান’’-ও যয়ীফের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতো।

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ মুরতাযা যাবীদী বলেন:


يروى عنه أنه كان يقول: ضعيف الحديث أحب إلي من آراء الرجال، وكأن المراد منه الضعيف الذي من قبل سوء حفظ راويه...


‘‘ইমাম আবূ হানীফা থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, ‘মানুষের ইজতিহাদী মতের চেয়ে যয়ীফ (দুর্বল) হাদীস আমার নিকট অধিক প্রিয়।’ এখানে যয়ীফ বলতে সে হাদীস বুঝানো হয়েছে যার দুর্বলতা শুধু রাবীর মুখস্থ শক্তির কারণে।’’[1]

হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়ে তাঁর কঠোরতার কারণে তিনি হাদীস শ্রবণের সময় থেকে বর্ণনার সময় পর্যন্ত পুরোপুরি মুখস্থ রাখাকে হাদীস বর্ণনার বৈধতার শর্ত বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেন:


لا يَنْبَغِي لِلرَّجُلِ أَنْ يُحَدِّثَ مِنْ الْحَدِيثِ إلا بِمَا يَحْفَظُهُ يَوْمَ سَمِعَهُ إلَى يَوْمِ يُحَدِّثُ بِهِ


‘‘যে হাদীস শ্রবণের দিন থেকে বর্ণনার দিন পর্যন্ত মুখস্থ আছে সে হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস বর্ণনা করা কোনো মানুষের জন্য সঠিক নয়।’’[2]

শুধুই সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসের উপর নির্ভর করার বিষয়ে তিনি বলেন:


إذا جاء الحديث الصحيح الاسناد عن النبي ﷺ عن الثقات أخذنا به فإذا جاء عن أصحابه لم نخرج عن أقاويلهم فإذا جاء عن التابعين زاحمتهم


‘‘যখন নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো হাদীস সহীহ সনদে আমাদের কাছে আসে তখন আমরা তা গ্রহণ করি। যখন এরূপ কথা সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হয় তখন আমরা তাঁদের কথার বাইরে যাই না। আর যখন তাবিয়ীগণের কথা বর্ণিত হয় তখন আমরা তাঁদের সাথে ভীড়ের মধ্যে প্রবেশ করি।’’[3]

তিনি দুর্বল মুহাদ্দিস বা রাবীদের শুধু বর্জনই করতেন না, উপরন্তু তাদের মিথ্যাচার বা দুর্বলতা প্রকাশ করে হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় সবাইকে সচেতন করতেন। কয়েকজন দুর্বল রাবী সম্পর্কে তিনি বলেন:


ما رأيت فيمن رأيت أفضل من عطاء وما لقيت فيمن لقيت أكذب من جابر الجعفي ما أتبته قط بشئ من رأي الا جاءني فيه بحديث وزعم ان عنده كذا وكذا ألف حديث عن رسول الله ﷺ لم يظهرها...


‘‘আমি যাদেরকে দেখেছি তাদের মধ্যে আতা ইবন আবী রাবাহের চেয়ে উত্তম কাউকে দেখি নি এবং জাবির জুফীর চেয়ে অধিক মিথ্যাবাদী আর কাউকে দেখি নি। আমি যে কোনো কিয়াসী মাসআলা তাকে বললেই সে তার পক্ষে একটি হাদীস বলে দিত। সে দাবী করত যে, তার কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এত হাজার হাদীস রয়েছে, যা সে এখনো প্রকাশ করে নি।’’[4]

সাইমারী (৪৬৩হি) তাঁর সনদে ইবনুল মুবারাক থেকে উদ্ধৃত করেছেন:


قدم محمد بن واسع إلى خراسان ... فاجتمع عليه قوم فسألوه عن أشياء من الفقه فقال إن الفقه صناعة لشاب بالكوفة يكنى أبا حنيفة فقالوا له إنه ليس يعرف الحديث فقال ابن المبارك كيف تقولون له لا يعرف لقد سئل عن الرطب بالتمر قال لا بأس به فقالوا حديث سعد فقال ذاك حديث شاذ لا يؤخذ برواية زيد أبي عياش (مداره على زيد بن عياش وهو مجهول).. فمن تكلم بهذا لم يكن يعرف الحديث


‘‘(ইরাকের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস) মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি (১২৩ হি) খুরাসানে আগমন করেন। তখন কিছু মানুষ তাঁর নিকট সমবেত হয়ে ফিকহের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন: ফিকহের বিষয়ে পারদর্শী কূফার আবূ হানীফা নামক এক যুবক। তারা বলেন: তিনি তো হাদীস জানেন না। তখন ইবনুল মুবারাক বলেন: আপনারা কিভাবে বলছেন তিনি হাদীস জানেন না? খুরমা খেজুরের বিনিময়ে গাছ পাকা খেুজর ক্রয় করার বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: এতে অসুবিধা নেই। তখন তাঁকে বলা হয়, সা’দ (রা)-এর হাদীসে এর আপত্তি রয়েছে? তিনি বলেন: এ হাদীসটি শায (দুর্বল); যাইদ আবী আইয়াশের বর্ণনা গ্রহণ করা যায় না।’- এ হাদীসের একমাত্র রাবী যাইদ ইবন আইয়াশ, তিনি অজ্ঞাতপরিচয়।- ইবনুল মুবারাক বলেন: যে ব্যক্তি এভাবে সনদ যাচাই করতে পারে তাঁর বিষয়ে কিভাবে বলা যায় যে, তিনি হাদীস জানতেন না?’’[5]

উল্লেখ্য যে, এ বিষয়ক হাদীসটি ইমাম মালিক, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবন মাজাহ ও তিরমিযী সংকলন করেছেন। হাদীসটির সনদের সকল রাবী নির্ভরযোগ্য, শুধু তাবিয়ী যাইদ ইবন আইয়াশ আবূ আইয়াশ কিছুটা অপরিচিত। এজন্য ইমাম আবূ হানীফা ছাড়াও প্রসিদ্ধ যাহিরী ফকীহ ইবন হাযম তাঁকে অজ্ঞাত পরিচয় বলেছেন এবং হাদীসটিকে যয়ীফ বলে গণ্য করেছেন। আর শুধু এ রাবীর কারণেই বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি গ্রহণ করেন নি। এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের সনদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফার শর্ত অনেকক্ষেত্রে বুখারী ও মুসলিমের শর্তের মতই।

আরো লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধতম দু ছাত্র আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ এ হাদীসটিকে গ্রহণ করেছেন এবং টাটকা গাছপাকা খেজুরের বিনিময়ে খুরমা খেজুর ক্রয়বিক্রয় নিষেধ করেছেন।[6] এ জাতীয় হাদীসের মান-নির্ধারণে হাদীসতাত্ত্বিকভাবে এরূপ মতভেদ হওয়া স্বাভাবিক।

[1] যাবীদী, উকূদুল জাওয়াহির, পৃ. ২২।

[2] ইবন আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/১৫২; কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ, পৃ. ২৫৭।

[3] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ৭৪; ইবন আব্দুল বার, আল-ইনতিকা পৃ. ১৪৪।

[4] আইনী, মাগানীল আখইয়ার ৩/৩৬৯; ইবন আদী, আল-কামিল ২/১১৩; ইবন হাজার, তাহযীব ২০/৮০; তিরমিযী, আস-সুনান ১২/৪৯২।

[5] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ২৬। মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, মুআত্তা ৩/১৬২।

[6] মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মাবসূত ৫/৬৮; আল-মুআত্তা ৩/১৬২; মারগীনানী, আল-হিদায়া ৩/৬৪; আব্দুল্লাহ ইবন মাহমূদ মাউসিলী, আল-ইখতিয়ার ২/৩৩; ইবন নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক ৬/১৪৪।