আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

এ যুগের অন্য প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম আবূ আহমদ আব্দুল্লাহ ইবন আদী (রাহ)। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বিষয়ে তিনি বলেন:


وأبو حنيفة له أحاديث صالحة، وعامة ما يرويه غلط وتصاحيف وزيادات في أسانيدها ومتونها، وتصاحيف في الرجال، وعامة ما يرويه كذلك، ولم يصح له في جميع ما يرويه إلا بضعة عشر حديثاً، وقد روى من الحديث لعله أرجح من ثلاثمائة حديث من مشاهير وغرائب، وكله على هذه الصورة؛ لأنه ليس هو من أهل الحديث، ولا يحمل على من تكون هذه صورته في الحديث.


‘‘আবূ হানীফা কিছু গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীসই ভুল, বিকৃতি, সনদ বা মতনে সংযোজন, রাবীর নামের পরিবর্তন। তাঁর অধিকাংশ হাদীসই এরূপ। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ১৫-২০টি হাদীস সহীহভাবে বর্ণিত। সম্ভবত তিনি পরিচিত ও অপরিচিত সব মিলিয়ে সর্বমোট তিনশতের মত হাদীস বর্ণনা করেছেন। সবগুলোরই এ অবস্থা; কারণ তিনি মুহাদ্দিস ছিলেন না। আর হাদীস বর্ণনায় যার এ অবস্থা তাঁর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।’’[1]

পাঠক দেখছেন যে, দুজনের প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে বেজায় ফারাক। এখানে উল্লেখ্য যে, ইবন আদী সাধারণভাবে সুবিবেচক বলে গণ্য এবং তাঁর মতের গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কি এখানে সুবিবেচনার সাথে কথা বলেছেন? প্রসিদ্ধ সৌদি মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ ইমাম ইবন আদীর মাযহাবী পক্ষপাতদুষ্ট ও মাযহাবী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা প্রসঙ্গে বলেন:


أو ما قاله في ترجمة الإمام أبي حنيفة رحمه الله... وأبو حنيفة له أحاديث صالحة ... أقول: هذا الكلام غير صحيح، قال الإمام الذهبي في تذكرة الحفاظ ১/১৬৮: أبو حنيفة الإمام الأعظم ، فقيه العراق ... وكان إماماً ورعاً عالماً عاملاً، متعبدا، كبير الشأن، لا يقبل جوائز السلطان قال ابن المبارك: أبو حنيفة أفقه الناس، وقال الشافعي: الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة ... عن ابن معين قال: لا بأس به ... قال السبكي في طبقات الشافعية ১/১৯০: قد عرفناك أن الجارح لا يقبل فيه الجرح وإن فسّره في حق من غلبت طاعاته على معصيته، ومادحوه على ذاميّه ومزكوّه على جارحيه، إذا كانت هناك قرينة تشهد بأن مثلها حامل على الوقيعة فيه من تعصب مذهبي أو منافسة دنيوية وحينئذ فلا يلتفت لكلام الثوري في أبي حنيفة، وابن أبي ذئب وغيره في مالك، وابن معين في الشافعي، والنسائي في أحمد بن صالح ونحوه ... إذ ما من إمام إلا وقد طعن فيه طاعنون، وهلك فيه هالكون... وترجمه الحافظ ابن حجر في التهذيب ترجمة مطولة ولم يذكر رواية واحدة تطعن في روايته وعدالته ، بل أثبت عدالته وثقته ... وهذا هو الحق والمذهب الحنفي مملوء بآلاف الأحاديث المستدل بها على الأبواب وهذا يرد على كل من يطعن في مذهب الإمام أبي حنيفة رحمه الله وكل جرح لا يستند إلى أسس موضوعية سليمة مرفوض مهما كان قائله إذ لايعصم عن الخطأ إلا الأنبياء.


‘‘ইবন আদীর পক্ষপাতদূষ্ট মন্তব্যের আরেকটি উদাহরণ ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহুর বিষয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি বলেন: ‘‘আবূ হানীফা কিছু গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীসই ভুল... গ্রহণযোগ্য নয়।’’ আমি বলব যে, এ কথাটি সঠিক নয়। ইমাম যাহাবী তাযকিরাতুল হুফায গ্রন্থের ১/১৬৮ পৃষ্ঠায় বলেন: আবূ হানীফা ইমাম আযম, ইরাকের ফকীহ... তিনি ছিলেন ইমাম, অত্যন্ত পরহেযগার, আলিম, আমলকারী, আবিদ, বড় মর্যাদার অধিকারী। তিনি শাসকদের কোনো হাদীয়া গ্রহণ করতেন না। ইবনুল মুবারাক বলেন: আবূ হানীফা মানুষদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ। শাফিয়ী বলেন: ফিকহের বিষয়ে মানুষ আবূ হানীফার উপর নির্ভরশীল। ... ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন: তাঁর বিষয়ে আপত্তি নেই। সুবকী ‘তাবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ গ্রন্থে ১/১৯০ পৃষ্ঠায় বলেন: আমরা আপনাকে বলেছি যে, জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ সমালোচক যদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও কারণ উল্লেখ করেও কারো ত্রুটি বর্ণনা করেন তাহলেও তার ত্রুটি বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি উক্ত মুহাদ্দিস তাকওয়া ও সততায় প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং তার নিন্দাকারীর চেয়ে প্রশংসাকারী এবং অবমূল্যায়নকারীর চেয়ে মূল্যায়নকারীর সংখ্যা বেশি হয়, যদি অবস্থার আলোকে বুঝা যায় যে, সমালোচক ত্রুটি বর্ণনার ক্ষেত্রে মাযহাবী কোন্দল, বা জাগতিক কোনো প্রতিযোগিতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আর এজন্যই আবূ হানীফার বিষয়ে সুফইয়ান সাওরীর বক্তব্য, মালিকের বিষয়ে ইবন আবী যিব ও অন্যান্যদের বক্তব্য, শাফিয়ীর বিষয়ে ইবন মায়ীনের বক্তব্য, নাসায়ীর বিষয়ে আহমদ ইবন সালিহের বক্তব্য এবং অনুরূপ সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। ... কারণ এমন কোনো ইমাম বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব নেই যার বিষয়ে অন্য কিছু লোক খারাপ মন্তব্য করেন নি বা ধ্বংসাত্মক কথা বলেন নি।’ ... ইবন হাজার তাহযীবুত তাহযীব গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি সেখানে তাঁর ত্রুটি বর্ণনামূলক একটি বর্ণনাও সংকলন করেন নি; বরং তাঁর বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। ... আর এটিই হলো হক্ক বা সত্য। হানাফী মাযহাব হাজার হাজার হাদীস দ্বারা পূর্ণ যেগুলি দ্বারা তাঁরা তাঁদের ফিকহী অধ্যায়গুলিতে প্রমাণ পেশ করেছেন। যারা ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর মাযহাবের নিন্দা-মন্দ বলেন তাদের সকলের বক্তব্যই এ বিষয়টি খন্ডন ও বাতিল করে দেয়। আর যে সমালোচনা বস্ত্তনিষ্ঠ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয় সে সমালোচনা প্রত্যাখ্যাত, এরূপ সমালোচক যত বড় মর্যাদার অধিকারীই হোন না কেন। কারণ নবীগণ ছাড়া কেউই ভুল থেকে মাসূম বা সংরক্ষিত নন।’’[2]

আমি ইবন আদীর এ গ্রন্থটির উপরে একটি আরবী প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা জার্নালের ২০০১ সালের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমি দেখেছি যে, ইবন আদী সাধারণভাবে নিরপেক্ষ হলেও মাযহাবী কোন্দলে খুবই প্রভাবিত ছিলেন। ইমাম শাফিয়ীর ঘনিষ্ঠতম উস্তাদ ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবী ইয়াহইয়ার (১৮৪ হি) আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখি যে, তিনি একজন মুতাযিলী, শীয়া, রাফিযী, কাদারী ও জাহমী ছিলেন। সকল মুহাদ্দিস তাকে দুর্বল বলেছেন এবং মালিক ইবন আনাস, ইয়াহইয়া আল-কাত্তান, ইবন মায়ীন, আলী ইবনুল মাদীনী ও অন্যান্য অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। কিন্তু ইমাম ইবন আদী বিভিন্ন অজুহাতে তাকে গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।[3]

পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা, তাঁর বংশধর ও অনুসারীদের বিষয়ে তার আক্রোশ খুবই স্পষ্ট।[4] এখানে শুধু ইমাম আবূ হানীফার প্রসঙ্গটি সামান্য পর্যালোচনা করব।

আমরা বলেছি যে, মুহাদ্দিসের মূল্যায়নে মুহাদ্দিসগণ আদালতের সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এখানে মূল বিষয় মুহাদ্দিস বর্ণিত হাদীসগুলোর তুলনামূলক নিরীক্ষা। একজন মুহাদ্দিস বর্ণিত হাদীসগুলো অন্যান্য মুহাদ্দিসের বর্ণনার সাথে তুলনা করার মাধ্যমে মুহাদ্দিসের নির্ভুল হাদীস বর্ণনা শক্তি নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য মুহাদ্দিসের মত ও উক্ত মুহাদ্দিসের ছাত্রগণের মান লক্ষ্য রাখা হয়। প্রত্যেক মুহাদ্দিসই কিছু ভুল করেন। যদি তুলনায় দেখা যায় যে, একজন মুহাদ্দিস অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসদের বর্ণনার ব্যক্তিক্রম করেন তবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল। এরূপ দুর্বলতার পরিমাণ, অনুপাত ও গভীরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসের গ্রহণযোগ্যতা ও দুর্বলতা নির্ধারিত হয়।

এ মূলনীতির ভিত্তিতেই ইবন আদী তাঁর ‘‘আল-কামিল’’ গ্রন্থে রাবীগণের দুর্বলতা প্রমাণের জন্য প্রত্যেক দুর্বল রাবীর বর্ণিত কিছু দুর্বল হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতা প্রমাণ করতে তিনি তাঁর বর্ণিত ছয়টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। ইবন আদীর দাবি অনুযায়ী ইমাম আবূ হানীফা বর্ণিত ৩০০ হাদীসের মধ্যে ২৮০টি ভুল। বাহ্যত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও নিশ্চিত ভুল এ ছয়টি হাদীসে বিদ্যমান; এজন্যই তাঁর দুর্বলতা প্রমাণে তিনি এগুলো উল্লেখ করেছেন। আমরা এ ছয়টি হাদীস আলোচনা করব।

(ক) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত প্রথম হাদীস


عن أبى حنيفة عن موسى بن أبى عائشة عن عبد الله بن شداد بن الهاد عن جابر بن عبد الله عن رسول الله ﷺ أنه قال من صلى خلف امام كان قرآنه له قراءة


‘‘আবূ হানীফা থেকে, তিনি মূসা ইবন আবী আয়িশা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ ইবনুল হাদ থেকে, তিনি জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে, তিনি বলেন: যদি কেউ ইমামের পিছনে সালাত আদায় করে তাহলে ইমামের কুরআন তিলাওয়াতই তার কিরাআত।

ইবন আদী বলেন, এ হাদীসটি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ এ সনদে তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ থেকে ‘‘মুরসাল’’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ তাবিয়ী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন। মাঝে সাহাবী জাবিরের (রা) নাম বলেন নি। শুধু ইমাম আবূ হানীফা সাহাবীর নাম বলেছেন। সকল নির্ভরযোগ্য রাবীর বিপরীতে এভাবে সনদের মধ্যে সাহাবীর নাম বৃদ্ধি করা প্রমাণ করে যে, তিনি হাদীস সঠিকভাবে মুখস্থ রাখতে পারতেন না। উপরন্তু ইবন আদী পরোক্ষভাবে জালিয়াতির অভিযোগ করে বলেন:


زاد أبو حنيفة في إسناده جابر بن عبد الله ليحتج به في إسقاط الحمد عن المأمومين... ووافقه الحسن بن عمارة وهو أضعف منه


আবূ হানীফা সনদের মধ্যে জাবির ইবন আব্দুল্লাহকে সংযোজন করলেন; যেন এদ্বারা তিনি মুক্তাদিদের জন্য ফাতিহা পাঠ বাদ দিতে পারেন। .... (সমসাময়িক আরেক প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ, বাগদাদের কাযী ও হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দুর্বল) হাসান ইবন উমারাহ (১৫৩ হি) তাঁরই মত জাবিরের (রা) নাম উল্লেখ করেছেন, তিনি তো আরো বেশি দুর্বল।’’[5]
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:


(১) মুক্তাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ বাদ দিতে কি ইমাম আবূ হানীফার হাদীসের সনদে বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজন ছিল? হাদীস ও ফিকহে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে তিনি জানেন যে, মুরসাল হাদীস, বিশেষত আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ (মৃত্যু ৮০ হি)-এর মত প্রথম যুগের প্রসিদ্ধ তাবিয়ীর মুরসাল হাদীস সকল ফকীহের নিকট দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ইমাম আবূ হানীফার যুগে বিষয়টি প্রসিদ্ধ ও ঐকমত্যের বিষয় ছিল।

(২) ইমাম আবূ হানীফা এবং অন্যান্য ইমাম কখনোই সকল মাসআলা হাদীস থেকে গ্রহণ করেন নি। হাদীসের পাশাপাশি সাহাবী ও তাবিয়ীগণের কর্ম ও ফাতওয়ার উপর তাঁরা নির্ভর করেছেন। মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ না করার বিষয়েও ইমাম আবূ হানীফা পূর্ববর্তী কয়েকজন সাহাবী-তাবিয়ীর মতের উপর নির্ভর করেছেন। কাজেই এজন্য মুরসাল হাদীসকে মুত্তাসিল বানানোর কোনো প্রয়োজন তাঁর ছিল না।

(৩) ইমাম আবূ হানীফার কয়েকজন ছাত্র হাদীসটির সনদে জাবিরের (রা) নাম বলেছেন, পক্ষান্তরে ইবনুল মুবারাক হাদীসটি তাঁর সূত্রেই মুরসাল হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। এতে বুঝা যায় তিনিও হাদীসটি মুরসাল বর্ণনা করতেন।[6] মুত্তাসিল বর্ণনার দোষটি তাঁকে না দিয়ে তাঁর ছাত্রদের দেওয়া যেত। কিন্তু ইবন আদী তাঁকে দোষারোপ করতে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন।

(৪) সর্বোপরি হাদীসটি আরো কয়েকজন মুহাদ্দিস সাহাবীর নাম-সহ বর্ণনা করেছেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্যদের উস্তাদ, ৩য় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম আহমদ ইবন মানী (২৪৪ হি) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে বলেন:


أَنْبَأَنَا إِسْحَاقُ الأَزْرَقُ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ وَشَرِيْكٌ عَنْ مُوسَى بْنِ أَبِي عَائِشَةَ عَنْ عَبْدِ الله بْنِ شَدَّادٍ عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ الله ﷺ: مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ.


‘‘আমাদেরকে ইসহাক আল-আযরাক বলেন, আমাদেরকে সুফইয়ান ও শারীক বলেন, তাঁরা মূসা ইবন আবী আয়িশা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ থেকে, তিনি জাবির থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: যদি কারো ইমাম থাকে তবে ইমামের কিরাআতই তার কিরাআত।’’

ইসহাক ইবন ইউসূফ আল-আযরাক (১৯৫ হি) বুখারী-মুসলিম স্বীকৃত প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, তিনি হাদীসটি সুফইয়ান ও শারীকের সূত্রে ইমাম জাবিরের (রা) নাম-সহ বর্ণনা করেছেন। তাহলে আবূ হানীফা ছাড়াও সুফইয়ান সাওরী ও শারীক এ বর্ণনায় হাদীসটি মুত্তাসিল বর্ণনা করেছেন। এজন্য ইমাম বূসীরী বলেন, হাদীসটির সনদ বুখারী-মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ[7]। এছাড়া মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি হাসান ইবন সালিহ থেকে লাইস ইবন আবী সুলাইম ও জাবির আল-জুফী থেকে আবুয যুবাইর থেকে জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন। জাবির আল-জুফী খুবই দুর্বল রাবী, তবে লাইস ইবন আবী সুলাইম কিছুটা দুর্বল হলেও তাঁর হাদীস ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন।[8] ইবন আবী শাইবা হাদীসটি সহীহ সনদে জাবির আল-জুফীর মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি হাসান ইবন সালিহ থেকে আবুয যুবাইর থেকে জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন।[9]

(খ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত দ্বিতীয় হাদীস


عن أبي حنيفة عن أبي سفيان عن أبي نضرة عن أبي سعيد عن النبي ﷺ قال: "مفتاح الصلاة الطهور، وتحريمها التكبير، وتحليلها التسليم، وفي كل ركعتين تسليم..، ولا تجزئ صلاة إلا بفاتحة الكتاب ومعها شيء"،


আবূ হানীফা থেকে, তিনি আবূ সুফইয়ান থেকে তিনি আবূ নাদরাহ থেকে তিনি আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘পবিত্রতা সালাতের চাবি, তাকবীর তার তাহরীম-শুরু, সালাম তার তাহলীল-শেষ, প্রতি দু রাকাতে সালাম, সূরা ফাতিহা ও তার সাথে কিছু (কুরআন তিলাওয়াত) ছাড়া সালাত বৈধ হবে না।’’

ইবন আদী বলেন:


زاد أبو حنيفة في هذا المتن: "وفي كل ركعتين تسليم....


‘প্রতি দু রাকাতে সালাম’ এ কথাটি আবূ হানীফা বাড়িয়েছেন। অর্থাৎ যে সকল নির্ভরযোগ্য রাবী হাদীসটি এ সনদে বর্ণনা করেছেন তাঁদের বর্ণনায় এ বাক্যটি নেই; শুধু আবূ হানীফা এ কথাটি বাড়িয়েছেন; এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি হাদীসের সনদ বা মতন ঠিকমত মুখস্থ রাখতে পারতেন না, অনেক কিছু বেশি কম করে ফেলতেন।[10]

এখানেও ইবন আদী ভুল তথ্য দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা ছাড়াও অন্যান্য রাবী হাদীসটির মধ্যে এ বাক্যটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবূ ইয়ালা মাউসিলী আলী ইবন মুসহির থেকে আবূ সুফইয়ান থেকে এ সনদে এ বাক্যসহ হাদীসটি সংকলন করেছেন।[11] আলী ইবন মুসহির বুখারী-মুসলিম স্বীকৃত প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য রাবী।[12] এতে প্রমাণ হয় ইমাম আবূ হানীফা হাদীসটি খুব ভালভাবেই মুখস্থ রেখেছিলেন।

ইমাম বাইহাকী বলেন:


قَالَ أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ فَقُلْتُ لأَبِى حَنِيفَةَ : مَا يَعْنِى فِى كُلِّ رَكْعَتَيْنِ تَسْلِيمٌ؟ قَالَ : يَعْنِى التَّشَهُّدَ. وَكَذَلِكَ رَوَاهُ عَلِىُّ بْنُ مُسْهِرٍ وَغَيْرُهُ عَنْ أَبِى سُفْيَانَ.


‘‘(ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীসটির বর্ণনাকারী) আবূ আব্দুর রাহমান বলেন: আমি আবূ হানীফাকে প্রশ্ন করলাম: ‘প্রত্যেক দু রাকাতে সালাম’- এ কথার অর্থ কী? তিনি বললেন: তাশাহ্হূদ পাঠ। বাইহাকী বলেন: আলী ইবন মুসহির ও অন্যান্য রাবীও হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন।[13]

(গ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত তৃতীয় হাদীস


عن أبي حنيفة: ثنا أبو حجية، عن ابن بريدة عن أبي الأسود الدئلي عن أبي ذر عن النبي ﷺ: "إن أحسن ما غيرتم به الشعر الحناء والكتم


আবূ হানীফা থেকে, তিনি বলেন: আমাদেরকে আবূ হুজাইয়াহ বলেন, তিনি ইবন বুরাইদা থেকে, তিনি আবুল আসওয়াদ দুয়িলী থেকে, তিনি আবূ যার গিফারী (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে, তিনি বলেন: তোমাদের চূল (চুলের শুভ্রতা) পরিবর্তনের জন্য যা ব্যবহার কর তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো মেন্দি এবং কাতম।’’

ইবন আদী বলেন: ‘‘এ হাদীসটি আবূ হানীফা থেকে কেউ কেউ এভাবে বর্ণনা করেছেন। মুআফী তাঁর থেকে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন: আবূ হানীফা একব্যক্তি থেকে... তিনি আবূ বুরাইদা থেকে তিনি আবুল আসওয়াদ থেকে...। হাসান ইবন যিয়াদ, মাক্কী ও ইবন বাযী হাদীসটি নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন: আবূ হানীফা আবূ হুজ্জিয়া থেকে, তিনি আবুল আসওয়াদ থেকে ..., এ সনদে ইবন বুরাইদার কথা উল্লেখ করেন নি। এভাবে এ সনদটি আবূ হানীফা থেকে বিভিন্নরূপে বর্ণিত।’’[14]

এখানে ইবন আদী প্রমাণ করছেন যে, এ হাদীসটির সনদ ইমাম আবূ হানীফা ঠিকমত মুখস্থ রাখতে পারেন নি। যে কারণে একেক ছাত্রকে একেকভাবে বলেছেন।

কোনো হাদীস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা রাবীর দুর্বলতা প্রকাশ করে। তবে এরূপ ভিন্নতার জন্য শিক্ষক বা ছাত্র দায়ী হতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক নির্ভরযোগ্য রাবীই এরূপ ব্যতিক্রমের মধ্যে নিপতিত হন। বুখারী সংকলিত একটি হাদীস নিম্নরূপ:


اقْرَءُوا الْقُرْآنَ مَا ائْتَلَفَتْ عَلَيْهِ قُلُوبُكُمْ ، فَإِذَا اخْتَلَفْتُمْ فَقُومُوا عَنْهُ


‘‘তোমরা কুরআন পাঠ কর যতক্ষণ তোমাদের অন্তরগুলো মিল-মহববতে থাকবে। যখন তোমরা মতভেদ করবে তখন উঠে যাবে।’’

ইমাম বুখারী এ হাদীসের সনদ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, হাদীসটি সকলেই প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য তাবিয়ী মুহাদ্দিস আবূ ইমরান জাওনী আব্দুল মালিক ইবন হাবীব (১২৮ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি কখনো সাহাবী জুনদুব ইবন আব্দুল্লাহ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস হিসেবে, কখনো জুনদুব (রা)-এর নিজের বক্তব্য হিসেবে এবং কখনো তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনুস সামিতের সূত্রে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেব।[15]

ইমাম বুখারী সংকলিত আরেকটি হাদীস নিম্নরূপ:


مَا بَعَثَ اللَّهُ مِنْ نَبِىٍّ وَلاَ اسْتَخْلَفَ مِنْ خَلِيفَةٍ ، إِلاَّ كَانَتْ لَهُ بِطَانَتَانِ ، بِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالْمَعْرُوفِ وَتَحُضُّهُ عَلَيْهِ ، وَبِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالشَّرِّ وَتَحُضُّهُ عَلَيْه


আল্লাহ কোনো নবী প্রেরণ করলে বা কাউকে শাসকের দায়িত্ব প্রদান করলে তার দু প্রকারের পরামর্শক থাকে: একদল পরামর্শক তাকে ভাল কাজের আদেশ ও উৎসাহ দেয় এবং একদল তাকে খারাপ কাজের আদেশ ও উৎসাহ দেয়।

ইমাম বুখারী উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইমাম ইবন শিহাব যুহরী (১২৫ হি) থেকে তাঁর ছাত্ররা তিনভাবে বর্ণনা করেছেন: (১) ইউনুস ইবন শিহাব থেকে আবূ সালামাহ থেকে আবূ সায়ীদ খুদরী থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী হিসেবে, (২) শুআইব যুহরী থেকে আবূ সালামাহ থেকে আবূ সায়ীদ থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে এবং (৩) আওযায়ী ও মুআবিয়া ইবন সাল্লাম যুহরী থেকে আবূ সালামাহ থেকে আবূ হুরাইরা থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী হিসেবে।[16]

(ঘ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত চতুর্থ হাদীস


أَبُو حَنِيفَةَ عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ مَرْثَدٍ عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ (بريدة بن الحصيب) أنَّه قَالَ : قَالَ رَسُولُ الله ﷺ: الدَّالُّ عَلَى الْخَيْرِ كَفَاعِلِهِ.


‘‘আবূ হানীফা আলকামা ইবন মারসাদ থেকে, তিনি সুলাইমান ইবন বুরাইদাহ থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: কল্যাণ কর্মের নির্দেশক তা পালনকারীর মতই (সাওয়াব পাবেন)।’’

ইবন আদী বলেন:


هذا حديث لا يجود إسناده غير أبى حنيفة... وتابعه حفص بن سليمان روى عن علقمة أحاديث مناكير لا يرويها غيره ...


‘‘এ হাদীসটি এ সনদে আলকামা থেকে আবূ হানীফা ছাড়া কেউ বর্ণনা করেন নি। ... হাফস ইবন সুলাইমানও তাঁরই মত এটি আলকামা থেকে বর্ণনা করেছেন। হাফস আলকামার সূত্রে কয়েকটি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা অন্য কেউ বর্ণনা করেন না।[17]

এ অর্থের হাদীস অন্যান্য সহীহ সনদে আনাস (রা) ও আবূ মাসঊদ (রা) থেকে বর্নিত। এ সনদে হাদীসটি অন্য কেউ বর্ণনা করেন নি। ইমাম আবূ হানীফার সূত্রে হাদীসটি ইমাম আহমদ, আবূ ইয়ালা মাউসিলী, ইমাম তাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। শাইখ শুআইব আরনাউত বলেন:


إسناده صحيح رجاله ثقات رجال الصحيح غير أبي حنيفة النعمان بن ثابت الإمام الثقة المشهور فقد روى له الترمذي والنسائي


‘‘হাদীসটির সনদ সহীহ, সনদের রাবীগণ বুখারী-মুসলিমের রাবী, শুধু ইমাম আবূ হানীফা ছাড়া। তিনি প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত রাবী। তিরমিযী ও নাসায়ী তাঁর বর্ণনা সংকলন করেছেন।’’[18]

(ঙ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত পঞ্চম হাদীস


أبو حنيفة: حدثنا عطاء بن أبي رباح عن أبي هريرة عن النبي ﷺ قال إذا ارتفع النجم ارتفعت العاهة عن أهل كل بلد


‘‘আবূ হানীফা: আমাদেরকে আতা ইবন আবী রাবাহ বলেছেন, তিনি আবূ হুরাইরা (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে, তিনি বলেন: ‘‘যখন সুরাইয়া নক্ষত্রপুঞ্জ (Pleiades) বা সপ্তর্ষিম-ল উর্দ্ধে উঠে তখন সকল জনপদের ফল-ফসলের বিপদ চলে যায়।’’

অর্থাৎ গ্রীষ্মের শুরুতে বা মে মাসের মাঝামাঝি যখন আরবে বা হেজাজে সুরাইয়া (Pleiades) নক্ষত্রমন্ডল (সপ্তর্ষিমন্ডল) প্রভাতে বা সকালে উদিত হয় তখন গাছের ফল মোটামুটি পরিপক্ক হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের বিপদাপদ কেটে যায়। এখানে মূল শর্ত ফল-ফসলের পরিপক্কতা, নক্ষত্রের উদয় শুধু পরিপক্কতার মৌসূম শুরুর আলামত। এজন্য বিভিন্ন সহীহ হাদীসে সুরাইয়া নক্ষত্র উদয়ের পূর্বে ফল বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, পরিপক্কতার আগে ফল বিক্রয় করলে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ইবন আদী বলেন:


ولا يحفظ عن عطاء إلا من رواية أبى حنيفة عنه وروى عن عسل عن عطاء مسندا وموقوفا وعسل وأبو حنيفة سيان في الضعف على أن عسل مع ضعفه أحسن ضبطا للحديث منه


‘‘এ হাদীসটি আতা-এর সূত্রে পূর্ণ সনদে আবূ হানীফা ছাড়া আর কারো মাধ্যমে জানা যায় না। শুধু (ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক অন্য রাবী) ইসল ইবন সুফইয়ানও হাদীসটি আতা-এর সূত্রে মারফূ এবং মাউকূফ দুভাবে বর্ণনা করেছেন। আবূ হানীফা ও ইসল উভয়ে দুর্বলতায় সমান; তবে ইসল তার দুর্বলতা সত্ত্বেও হাদীস নির্ভুল বর্ণনায় আবূ হানীফার চেয়ে উত্তম।’’[19]

এ হাদীসটিকেও ইবন আদী ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন, অথচ তিনিই বলছেন যে, তাঁর চেয়ে শক্তিশালী একজন রাবী হাদীসটি একই সনদে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কথা থেকে সুস্পষ্ট যে, এ হাদীসটিকে ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায় না। কারণ একাধিক মুহাদ্দিস যখন একই সনদ বা মতন বলেন এবং একজন থেকে অন্যজন গ্রহণ করেছেন বলে প্রমাণ না পাওয়া যায় তখন প্রমাণ হয় যে, এ সনদ বা মতনের একটি ভিত্তি আছে।

উল্লেখ্য যে, ইসলের সনদে হাদীসটি মুসনাদে আহমাদের সংকলিত। ইসলকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস দুর্বল ও ইবন হিব্বান নির্ভরযোগ্য বলেছেন। সমকালীন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শাইখ শুআইব আননাঊত হাদীসটিকে ‘‘হাসান’’ বলেছেন।[20] পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফার হাদীসটিকে তিনি সহীহ বলেছেন। তিনি বলেন:


روى محمد بن الحسن في الآثار عن أبي حنيفة...يرفعه "إذا طلع النجم ذا صباح... " وإسناده صحيح.


মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান কিতাবুল আসারে আবূ হানীফা থেকে ... রাসূলুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত করেছেন: যখন সুরাইয়া নক্ষত্র প্রভাতে বা সকালে উদিত হয় ... ফল-ফসলের বিপদ চলে যায়।’’ এ হাদীসটির সনদ সহীহ।[21]

(চ) ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার প্রমাণে পেশকৃত ষষ্ঠ হাদীস

ইবন আদী বলেন,


ثنا عبدان ثنا زيد بن الحريش ثنا أبو همام الأهوازي عن مروان بن سالم عن أبي حنيفة عن حماد عن إبراهيم عن علقمة عن عبد الله أن النبي ﷺ أكل ذبيحة امرأة" ... لم يروه موصولاً غير أبي حنيفة، زاد فيه علقمة وعبد الله والنبي ﷺ.. يرويه منصور، ومغيرة عن إبراهيم قوله"


‘‘আমাদেরকে আবদান বলেছেন, আমাদেরকে যাইদ ইবনুল হুরাইশ বলেছেন, আমাদেরকে আবূ হাম্মাম বলেছেন, আমাদেরকে মারওয়ান ইবন সালিম বলেছেন, আবূ হানীফা থেকে, হাম্মাদ থেকে, ইবরাহীম নাখয়ী থেকে, আলকামা থেকে ইবন মাসঊদ থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একজন মহিলার জবাইকৃত পশুর মাংস ভক্ষণ করেন।’’... এ হাদীসটি এভাবে সনদসহ আবূ হানীফা ছাড়া কেউ বলেন নি। তিনি এর সনদে আলকামা, ইবন মাসঊদ ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নাম বৃদ্ধি করেছেন। মানসূর ও মুগীরা এটিকে ইবরাহীমের নিজের কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।’’[22]

তাহলে এ হাদীসটি অন্যান্য রাবী ইবরাহীম নাখয়ীর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন। ইবন আদীর মতে এতে প্রমাণ হয় যে, তিনি হাদীসের সনদ-মতন মুখস্থ রাখতে পারতেন না; যে কারণে এভাবে সনদের মধ্যে কমবেশি করতেন।

পাঠক লক্ষ্য করেছেন যে, উপরে আমি ইবন আদী থেকে ইমাম আবূ হানীফা পর্যন্ত সনদ উল্লেখ করেছি, যা অন্যান্য হাদীসের ক্ষেত্রে করি নি। এর কারণ ইমাম আবূ হানীফা থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ‘‘মারওয়ান ইবন সালিম’’। ইবন আদী নিজেই তাঁর এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এ ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী।[23] তাহলে এ হাদীসের ত্রুটির দায়ভার এ অতি দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবীর উপর না চাপিয়ে ইমাম আবূ হানীফার উপরে চাপানোর কারণ কি? অথচ ইবন আদী নিজে অন্যান্য রাবীর ক্ষেত্রে বারংবার বলেছেন, তাঁর হাদীসের মধ্যে যে ভুলভ্রান্তি পাওয়া যায় তা সম্ভবত তার থেকে যারা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাদের কারণে।
ইবন আদীর সমালোচনায় এ বিষয়টি ছাড়াও নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:


(১) ইবন আদী অন্যান্য মুহাদ্দিসের ক্ষেত্রে তাঁর ছাত্রদের বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। কোনো মুহাদ্দিস থেকে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের হাদীস শিক্ষা তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বলে গণ্য করেছেন। এমনকি তার হাদীসের ভুলভ্রান্তি ও অন্যান্য মুহাদ্দিসদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি তাকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। আমরা দেখেছি যে, ইবন মায়ীন ও ইবনুল মাদীনী ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে এ বিষয়টি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী ও অন্যান্যরা উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা থেকে শতাধিক মুহাদ্দিস হাদীস শিক্ষা করেছেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন সে যুগের তাবি-তাবিয়ী পর্যায়ের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস।[24] কিন্তু ইবন আদী তাঁর ক্ষেত্রে এ বিষয়টির মোটেও গুরুত্ব দেন নি।

(২) ইবন আদীর নিরপেক্ষতা ও সুচিন্তিত মতামতের একটি অতি পরিচিত চিত্র যে, তিনি মুহাদ্দিসগণের ভুলভ্রান্তির ওজর পেশ করেছেন। এমনকি অন্যান্য মুহাদ্দিস যাকে দুর্বল বলেছেন, তিনি তার পক্ষে ওযর পেশ করেছেন। যেমন শারীক ইবন আব্দুল্লাহ নাখয়ী (১৭৮ হি)-কে অধিকাংশ মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন। ইবন আদী তাঁদের মত উদ্ধৃত করেন এবং শারীকের ভুলত্রটির অনেক নমুনাও উল্লেখ করেন। এরপর বলেন:


والذي يقع في حديثه من النكرة إنما أتي فيه من سوء حفظه، لا أنه يتعمد في الحديث شيئاً مما يستحق أن ينسب فيه إلى شيء من الضعف"


‘‘শারীকের বর্ণিত হাদীসের যে ভুলভ্রান্তি তা তাঁর দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে; এমন না যে তিনি ইচ্ছা করে হাদীসের মধ্যে পরিবর্তন করতেন; কাজেই তাঁকে কোনোরূপ দুর্বলতার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় না।[25]

বুখারী-মুসলিম স্বীকৃত প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আফ্ফান ইবন মুসলিম আবূ উসমান (২১৯ হি)। তিনি নির্ভরযোগ্য রাবী, তবে কিছু ভুল তাঁর হতো। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাঁকে দুর্বল বলেছেন। ইবন আদী বলেন:


وعفان أشهر وأوثق وأصدق من أن يقال فيه شيء مما فيه ينسب إلى الضعف.. ولا أعلم لعفان إلا أحاديث....... مراسيل فوصلها، وأحاديث موقوفة فرفعها وهذا مما لا يتنقصه؛ لأن الثقة وإن كان ثقة قد يهم في الشيء بعد الشيء


‘‘আফ্ফান এমন পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য ও সত্যপরায়ণ যে তাঁকে কোনোরূপ দুর্বলতায় আখ্যায়িত করা যায় না। আমার জানা মতে আফ্ফানের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু মুরাসাল হাদীস রয়েছে যেগুলি তিনি মুত্তাসিল বানিয়ে দিয়েছেন এবং কিছু মাউকূফ (সাহাবীর বক্তব্য) আছে যেগুলিকে তিনি মারফূ (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য) বানিয়েছেন। এর কারণে তাঁর মর্যাদা কমে না। কারণ নির্ভরযোগ্য রাবীও মাঝে মাঝে কিছু ভুলভ্রান্তি ও ধারণা-অনুমানের মধ্যে নিপতিত হন।...’’[26]

আমরা ইবন আদীর সাথে একমত যে, একজন রাবীকে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ঢালাওভাবে দুর্বল বলা যায় না। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস স্বীকৃত শতশত রাবী রয়েছেন যারা নির্ভরযোগ্য রাবীদের বিপরীতে মুরসাল হাদীসকে মুত্তাসিল বর্ণনা করেছেন, সনদে বা মতনে কিছু পরিবর্তন করেছেন। এগুলোকে তাদের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করে তাদেরকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন ইবন আদীর নিরপেক্ষতা নিয়ে। তিনি বললেন যে, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা, অনিচ্ছাকৃত ভুল, মুরসালকে মুত্তাসিল বা মাউকূফকে মারফূ বানানোর কারণে মুহাদ্দিসকে দুর্বল বলা যায় না। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে তিনি এ মূলনীতি পুরোপুরিই লঙ্ঘন করে শুধু একারণেই তিনি তাঁকে দুর্বল বলেছেন।

আমরা ওজরখাহি বাদ দিয়ে ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতা যাচাই করি। উপরের ছয়টি হাদীসের মধ্যে ১ম, ২য় ও ৫ম হাদীস কোনো অবস্থাতেই তাঁর দুর্বলতার প্রমাণ নয়; বরং তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। কারণ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবী- ইবন আদীর ভাষায় আবূ হানীফার চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য রাবী- তাঁর মতই বর্ণনা করেছেন। ৬ষ্ঠ হাদীসটিও কোনোভাবেই তাঁর দুর্বলতার প্রমাণ নয়; কারণ এ হাদীসটি তাঁর নামে প্রচার করেছে একজন পরিত্যক্ত রাবী। তৃতীয় হাদীসটির সনদ তাঁর ছাত্ররা বিভিন্নভাবে বলেছেন। এর জন্য তিনি বা তাঁর ছাত্ররা দায়ী হতে পারেন। আমরা দেখলাম যে, বুখারী সংকলিত হাদীসেও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো এরূপ করেছেন।

৪র্থ হাদীসটি তাঁর চেয়ে শক্তিশালী কেউ বর্ণনা করেন নি। আর কোনো মুহাদ্দিসের ক্ষেত্রে যদি প্রমাণিত হয় যে, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল বর্ণনা করেন, তাহলে যে হাদীসগুলো তিনি একক বর্ণনা করেন সেগুলোও সহীহ বলে গণ্য হয়। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল গ্রন্থে এরূপ অনেক সহীহ ‘‘গরীব’’ হাদীস বিদ্যমান। এজন্য অন্যান্য হাদীসে তাঁর দুর্বলতা প্রমাণিত না হলে এ হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমরা শাইখ আরনাউতের মন্তব্যে তা দেখেছি।

ইমাম ইবন আদীর দাবি অনুসারে ইমাম আবূ হানীফা ৩০০ হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলির মধ্যে ২৮০টিতে ভুল করেছেন এবং সে ভুল প্রমাণ করতে তিনি তাঁর বর্ণিত সবচেয়ে মারাত্মক ভুলের ছয়টি প্রমাণ পেশ করেছেন। আমরা দেখলাম এগুলোর ৪টিই বাতিল প্রমাণ, বাকি দুটোও নিরেট প্রমাণ নয়। এথেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাকী ২৭৬টি ভুল হাদীসের অবস্থাও এর থেকে ভিন্ন হবে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইমাম আবূ হানীফাকে যারা দুর্বল বলেছেন তাঁরা মূলত উপরের ছয়টি হাদীসের কয়েকটি বা সবকয়টি উল্লেখ করেছেন। আর এগুলোর অবস্থা আমরা দেখছি। এথেকে প্রতীয়মান হয় যে, তৃতীয় শতক ও পরবর্তী শতকগুলোতে যারা তাঁকে হাদীস বর্ণনায় দুর্বল বলেছেন তাঁরা ইনসাফ করেন নি।

[1] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা: দারুল ফিকর) ৭/১২ (মুদ্রিত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা-৯৭) ৮/২৪৬।

[2] আলী নাইফ আশ-শাহহূদ, আল-খুলাসাতু ফী ইলমিল জারহ ওয়াত তাদীল, পৃ. ৩১২-৩১৩।

[3] ইবন আদী, আল-কামিল (মুদ্রিত) ১/৩৫৩-৩৫৭; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৫৭-৬১; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১/১৪৩-১৪৪; তাকরীবুত তাহযীব, পৃ. ৯৩, নং ২৪১।

[4] জার্নাল অব দি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ (পার্ট-এ), ভলিউম ৯, নং ২, জুন ২০০১, পৃ ২১৫-২৫২। আর্টিকেলটি অনলাইনে দেখতে ভিযিট করুন: www.assunnahtrust.com

[5] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/১০; (মুদ্রিত) ৮/২৪৩।

[6] আবূ ইউসূফ, কিতাবুল আসার, পৃ. ১১৯; বাইহাকী, মারিফাতুস সুনান ৩/১৩০।

[7] বূসীরী, ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারাহ ২/৮০। আরো দেখুন: আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/২৭২-২৭৩।

[8] ইবনুল আরাবী, আল-মুজাম ৪/২১৭; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২/১৫৯।

[9] ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ১/৩৭৭ (নং ৩৮২৩); আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/২৬৯-২৭০।

[10] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/১১-১২ (মুদ্রিত ৮/২৪৩।

[11] আবূ ইয়ালা আল-মাউসিলী, মুসনাদ ২/৩৩৬।

[12] ইবন হাজার, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ. ৪০৫।

[13] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২/৩৮০।

[14] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/১২ (মুদ্রিত) ৮/২৪৫।

[15] বুখারী (৬৯-কিতাব ফাযয়িলিল কুরআন, ৩৭- ইকরাউল কুরআন..) ৪/১৯২৯ (ভারতীয় ২/৭৫৭)।

[16] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৩২।

[17] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/১২; (মুদ্রিত) ৮/২৪৫।

[18] মুসনাদ আহমদ ইবন হাম্বাল, আরনাঊতের টীকাসহ ৫/৩৫৭।

[19] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/১১-১২; (মুদ্রিত) ৮/২৪৫।

[20] মুসনাদ আহমদ ইবন হাম্বাল, আরনাঊতের টীকাসহ ২/৩৪১।

[21] মুসনাদ আহমদ ইবন হাম্বাল, আরনাঊতের টীকাসহ ২/৪২

[22] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/১১; (মুদ্রিত) ৮/২৪৪।

[23] ইবন আদী, আল-কামিল ৬/৩৮৪-৩৮৫ (৮/১১৯-১২১)

[24] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৩৯৩-৩৯৪, ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭/৮৬; ড. মুহাম্মাদ কাসিম আব্দুহু হারিসী, মাকানাতু আবী হানীফা, পৃ. ১৫১-১৯০।

[25] ইবন আদী, আল-কামিল ৪/২২ (৫/৩৫)

[26] ইবন আদী, আল-কামিল ৫/৩৮৪-৩৮৫ (৭/১০৫)